Image description

মতাদর্শগত ভিন্নতা ও বাস্তব রাজনীতির হিসাব-নিকাশের কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলো এক প্ল্যাটফর্মে আসতে পারছে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক। ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ অভিমত জানান দীর্ঘদিন ধরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এ নেতা। সাক্ষাৎকারে তিনি বর্তমান সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ, ইসলামী রাজনীতির বাস্তবতা ও নারী নেতৃত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। 

তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের চিফ অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্টেট অ্যাফেয়ার্স আদিত্য রিমন।

ঢাকা পোস্ট : আপনারা ছয়টি ধর্মভিত্তিক দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, পিআর পদ্ধতিসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন করছেন। এর মধ্যে ঐকমত্য কমিশন থেকে সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়টি এসেছে। আপনারা কোন প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চান?

 

মামুনুল হক : ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় আমিও ছিলাম। আমাদের আলোচনায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দুটি প্রক্রিয়া ছিল। একটি গণভোটের মাধ্যমে, আরেকটি গণপরিষদ গঠন করে। পরবর্তীতে আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে যে, রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমেও তা করা যেতে পারে। অথবা অন্য কোনো উপায়েও হতে পারে। আমরা চাই যেকোনো উপায়ে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক।

 

ঢাকা পোস্ট : ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি এসেছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আর কোনো ধর্মীয় বিষয়ে অন্তর্ভুক্তির দাবি করা হয়েছে কি?

মামুনুল হক : এই মুহূর্তে আমরা সনদে নতুন কোনো ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্তির জোরালো দাবি করছি না। বরং এখন আমরা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তিটাকে প্রাধান্য দিচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : গণভোট ও ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশ ইস্যুতে বিএনপি একটি অবস্থান নিয়েছে। জামায়াত তাদের বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। এদিকে, এনসিপিও ভিন্নরকম কিছু দাবি করছে। এই যে ত্রিমুখী অবস্থান, এর থেকে বেরিয়ে নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করা সম্ভব? আপনি কী মনে করেন?

মামুনুল হক : সম্ভব। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন শুধু সম্ভব নয়, সহজও। যেকোনো একটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা যেতে পারে। পরবর্তীতে গণভোট বা গণপরিষদের মাধ্যমেও তা করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, তখন একই আয়োজনে গণভোট বা গণপরিষদ করা সম্ভব। অর্থাৎ, আলাদা সময় বা আয়োজনের দরকার নেই। কাজেই এখানে সিদ্ধান্তটাই মূল বিষয়।

ঢাকা পোস্ট : যদি গণভোটে জনগণ সনদ বাস্তবায়নের বিপক্ষে রায় দেয়, তাহলে কি এতদিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না?

মামুনুল হক : জনগণ যদি না চায়, তাহলে আমাদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। আমরাও জনগণের মতামত মেনে নেব। জনগণের মতই আমাদের কাছে চূড়ান্ত।

ঢাকা পোস্ট : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সফরের সময় এক সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা একসময় উঠে যেতে পারে। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বলে আপনি মনে করেন?

মামুনুল হক : আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার যে ভিত্তি, সেটি স্পষ্টভাবে সামনে আনা জরুরি। ড. ইউনূস হয়তো বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাননি, তাই তিনি কৌশলী উত্তর দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম, বিশেষ করে জুলাই আন্দোলন এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে যেভাবে তারা মানুষকে হত্যা করেছে, এজন্য গোটা আওয়ামী লীগ এবং তাদের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরাই দায়ী। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে তারা বাংলাদেশের মানুষকে নির্বিচারে গুলি করেছে, যা গণমাধ্যম ও বিভিন্ন প্রামাণ্য চিত্র সূত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরাসরি গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং, তাদের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা যেত। তবে, সেটি বিচার বিভাগের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও আওয়ামী লীগের এসব হত্যাকাণ্ড, গুম ও খুনের বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, স্বীকৃতি ও বিবরণ আছে। তাই আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের এই মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের রাজনীতিতে ফেরার কোনো নৈতিক বা আইনগত সুযোগ নেই।

ঢাকা পোস্ট : আপনার কথার সূত্র ধরে জানতে চাই—আপনি যে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের কথা বলছেন, সেখানে শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে, একই প্রতিবেদনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আপনি এই অবস্থানকে কীভাবে দেখছেন?

মামুনুল হক : সেটি আসলে তাদের পরামর্শমূলক মতামত। কিন্তু অপরাধটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং প্রমাণিত। এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। এখন প্রশ্ন হলো, এই জাতীয় অপরাধ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণ কী চায়?

স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে একটি সাধারণ নীতি অনুসরণ করে, তারা সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দলের নিষিদ্ধকরণ সমর্থন করে না। এটি একটি নীতিগত বা সাধারণ বক্তব্য। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তারা সরাসরি এসব (খুন, গুম ও হত্যা) কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকে, তখন সেই অপরাধ উপেক্ষা করার বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।

ঢাকা পোস্ট : আপনারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেন। সাধারণভাবে বললে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করেন, আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেও অংশ নিচ্ছেন। এটা কি ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়?

মামুনুল হক : ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কিংবা আরও সরাসরি বললে আমরা ইসলামী রাজনীতি করি। ইসলামী আদর্শ থেকে আমরা যে রাজনীতি করি তার স্পষ্ট বার্তা হলো—আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে ইসলামী জীবনধারা ও শরিয়াহর আদলে দেশ পরিচালিত করব। ইসলামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ক্ষমতা গ্রহণের জন্য একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ আছে। কিন্তু আমাদের দেশ সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাই ভিন্ন। কাজেই এই পরিস্থিতিতে পরিপূর্ণ ইসলামিক পদ্ধতি অনুযায়ী আমরা যেসব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারছি, সেগুলো করছি। আর যেসব ক্ষেত্রে পুরোপুরি ইসলামের পদ্ধতি অনুসরণ করা যাচ্ছে না, বাধ্যবাধকতা আছে, সেগুলোতে আমরা সীমিত পরিসরে ইসলাম যতটুকু অনুমোদন করে ততটুকুর সংশ্লিষ্টতা রাখছি, এর বেশি নয়।

ঢাকা পোস্ট : প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বা আলেম সমাজ ওয়াজ-মাহফিলে বিপুল জনসমাগম ঘটাতে পারলেও ভোটের রাজনীতিতে তাদের সেই জনপ্রিয়তা প্রতিফলিত হয় না। মানুষ তাদের কথা শুনতে ভালোবাসে, কিন্তু ভোট দেয় না। আপনারা কি এ বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণ করেছেন?

মামুনুল হক : অবশ্যই, এটা খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামো বা বন্দোবস্তে দীর্ঘদিন ধরে নানা উপায়ে মানুষের মনে এক ধরনের ভুল ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ বা নিরীহ মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে পেশিশক্তি ও বিপুল অর্থবিত্তের মালিক (কালো টাকা) হতে হবে। এই জাতীয় একটা ধারণা ব্যাপকভাবে মানুষের মনের মধ্যে বদ্ধমূল আছে। এটি একটি বড় কারণ।

আরেকটি কারণ হলো—দুর্বৃত্তায়নের যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অথবা দ্বি-দলীয় রাজনীতির যে চক্রে জাতি আটকে আছে, সেখানে মানুষ মনে করে আলেম-ওলামা বা ইসলামী দলকে ভোট দিলে হয়তো তারা জিতবে না। ফলে তার ভোটটা ‘নষ্ট’ হবে। তাই ঘুরে ফিরে দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক চক্রেই মানুষ রয়ে যাচ্ছে। এটি থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। আমি মনে করি, যদি দেশে সত্যিকারের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা যায়, দল ও আদর্শকে মানুষ বেছে নিতে পারে, তাহলে ইসলামী দলগুলোর প্রতিও মানুষের সমর্থন অনেক বৃদ্ধি পাবে।

ঢাকা পোস্ট : ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রায়ই ‘উগ্রবাদী’ বা ‘অসহিষ্ণু’ বলে সমালোচনা করা হয়। অনেকে বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কিছু কর্মকাণ্ডে এই ধারণার ভিত্তি তৈরি হয়েছে। আপনি কি এটাকে সমর্থন করেন?

মামুনুল হক : না, একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এই পর্যায়ে এসে বিষয়টা উপনীত হয়েছে। ঐতিহাসিক ধারাটা হলো, এক হাজার বছরেরও বেশি সময় মুসলমানরা বিশ্ব শাসন করেছে। এরপর দীর্ঘ পরিকল্পনা করে ইহুদিরা একটা ভিন্ন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সেখানে ইহুদিদের প্রধান ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়। খ্রিস্টানদের তারা দুই ভাগে ভাগ করে, বিশেষত প্রোটেস্ট্যান্ট; এরা আসলে খ্রিস্টান না, ইহুদি মতাদর্শে দীক্ষিত। এরা বেনামি ইহুদি। কাজেই ইহুদিরা খ্রিস্টানদের সিংহভাগকে মোটিভেট করে ইসলামবিরোধী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মূলত বিশ্বব্যাপী সভ্যতার লড়াই হলো ইহুদিবাদ এবং ইসলামের মধ্যে। সেই লড়াইয়ে ইহুদিবাদ এখন বিশ্বকে শাসন করছে এবং ইসলামপন্থীরা সেই আগ্রাসনকে পরাস্ত করে আবার পুরাতন ধারায় ফিরে যেতে চায়। এটা শত শত বর্ষের একটা লড়াই।

এখন আপনার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বলব- এটা মূলত সেই ইহুদিবাদী চক্র, যারা বিশ্বমোড়ল। তারা কখনোই চায় না যে কোথাও রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিপূর্ণ ইসলাম বাস্তবায়ন হোক। কারণ, ইসলামের হাতে রাষ্ট্রশক্তি এলে এবং ইসলাম স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করলে, খুব দ্রুত মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ইসলামী রাজনীতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে। মুসলিম উম্মাহ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে তখন ইহুদিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটবে।

মূলত, ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘উগ্রবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা বা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নানা ধরনের ট্যাগ দেওয়া, এটা সম্পূর্ণরূপে বৈশ্বিক ইহুদিবাদী শক্তির একটা খেলা।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচন কমিশনের নিয়মে প্রত্যেক দলকে ৩০ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে, যা কোনো দলই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ধর্মভিত্তিক দলগুলো এক্ষেত্রে খুব পিছিয়ে আছে এবং শীর্ষ পর্যায়েও নারী নেতৃত্ব দেখা যায় না—এটা নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী?

মামুনুল হক : ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নারীকেন্দ্রিক যাবতীয় কর্মকাণ্ড নারীদের মাধ্যমেই পরিচালনা করে। আমাদের মূল ধর্মীয় যে বাইন্ডিংসটা, সেখানে নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতা রয়েছে। এটাও সেই আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্রের একটা অংশ, যেখানে তারা এদেশীয় এজেন্ট এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে ইসলামী ব্যবস্থাপনাটা যেন পরিপূর্ণ ইসলামী রূপে ফুটে উঠতে না পারে সেজন্য এসব বিষয় সামনে নিয়ে আসে।

প্রশ্ন হলো, ৩০ শতাংশ নারী রাখার বাধ্যবাধকতা কেন? তুমি যে গণতন্ত্রের কথা বলো, সেই গণতন্ত্রে তো বলা হয় মানুষ যেভাবে চাইবে সেভাবে চলবে, তাদের স্বাধীনতা আছে। আমাদের নারীরাও যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেভাবেই কাজ করবে। ইসলামের বাইন্ডিংস (বাধ্যবাধকতা) বাদ দিয়ে কেন নারীদের আমাদের সঙ্গে একসাথে এসে কাজ করতে বাধ্য করা হবে—এই বাধ্যবাধকতা কেন?

আমি মনে করি, আমরা এখন একটি সিস্টেমের অধীনে থেকেই সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। তাই এই সংগ্রামটা অনেক কঠিন। তবে আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমরা সফল হবো। আমরা যে সিস্টেমের মধ্যে থেকে অগ্রসর হচ্ছি, আল্লাহ যখন আমাদের সুযোগ দেবেন, তখন আমরা এই সিস্টেমটাকেও ইহুদিবাদী চক্রান্ত থেকে মুক্ত করে ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী গড়ে তুলব।

ঢাকা পোস্ট : প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে, আপনারাসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতির দাবিতে আন্দোলন করছেন। এই প্রেক্ষাপটে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের শঙ্কা দেখেন কি না?

মামুনুল হক : প্রথম কথা হলো, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা সম্ভব। আমরা মনে করি না, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া নিয়ে বড় ধরনের কোনো দ্বিধা বা সংশয়ের জায়গা আছে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ব্যাপারে প্রায় সব দলের মধ্যেই এক ধরনের ঐকমত্য আমরা দেখতে পাই। আর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে তার আইনি ভিত্তি দেওয়ার যে দাবিটা, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটিকে কেন্দ্র করে আল্লাহ না করুক, কোনো অস্থিরতা বা জটিলতা হবে বলে আমরা মনে করি না। কারণ, সবাই তো জুলাই বিপ্লবের অংশীজন। কাজেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কারো বড় ধরনের আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই আমরা মনে করি, জুলাই সনদ আইনি ভিত্তি পাবে এবং তার ভিত্তিতেই ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীদের বাইরে রেখে ইনক্লুসিভ নির্বাচন করা সম্ভব কি না?

মামুনুল হক : ইনক্লুসিভ নির্বাচনের প্রশ্ন উঠেছে, ঠিক আছে। এখন কথা হলো, যারা দুর্বৃত্তায়ন করেছে, মানুষ খুন করেছে, দলগতভাবে অপরাধ করেছে, তাদের যদি ন্যূনতম শাস্তি না হয়, সেটা কি মানা যায়? এখনও তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না, তারা এত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, প্রকাশ্যে ঘোষণা করে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনা ও ১৪ দলীয় জোটের বেশিরভাগ নেতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ এসেছে যে তারা সরাসরি এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এই অবস্থায় যদি এসব অপরাধীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া হয় তাহলে সেটাকে ইনক্লুসিভ বলা হবে না? সেক্ষেত্রে এ কথাও তো বলা যায় যে অন্যান্য যারা খুনি, হত্যাকারী; তাদেরকে জেলখানার ভেতরে রেখেও নির্বাচন ইনক্লুসিভ হবে না!

অপরাধীর অপরাধের বিচার হবে—এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং, কোনো অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে বোঝাবে ‘বাকি জনগণ’, যারা এই অন্যায় ও অপরাধে জড়িত নয় তাদের অংশগ্রহণ। তারা অংশ নিলেই ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে এবং তাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হবে।

ঢাকা পোস্ট : আপনার দল প্রায় ২৬৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এদিকে, আপনাদের ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একটা জোট গঠনের প্রচেষ্টাও চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মামুনুল হক : ৩০০ আসনে নির্বাচনের জন্য দলীয়ভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে, বৃহত্তর স্বার্থে আমরা যেকোনো জোটের জন্যও প্রস্তুত আছি। কাজেই আমরা সমান্তরাল দুটি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। এককভাবে নির্বাচন করতে হলে ৩০০ আসনেই করব। আবার যদি কোনো জোটে যেতে হয় এবং নির্বাচনী আসন নিয়ে সমঝোতা হয় তখন কিছু আসনে আমরা ছাড় দেব। আমাদের সব মনোনীত প্রার্থীকে আগেই এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্মভিত্তিক দলগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে জামায়াতসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল জোটবদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে কিছু দল বিএনপির সঙ্গে অবস্থান নিচ্ছে। এর মধ্যে হেফাজতে ইসলাম বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কেন আসলে ধর্মভিত্তিক দলগুলো এক জায়গায় আসতে পারছে না?

মামুনুল হক : ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের পথে দুটি বিষয় বাধা সৃষ্টি করে। প্রথমত, এই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ আছে। এটা একটা বড় কারণ। দ্বিতীয়ত, জোট করার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে হিসাবের জায়গায় অনেক সময় সমন্বয় হয় না। ধর্মভিত্তিক দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধও হয় তাহলেও ছোট দলগুলোর পক্ষে কোনো আসন থেকে বিজয়ী হওয়া কঠিন—এমন ধারণা কাজ করে। পক্ষান্তরে, ছোট দলগুলো বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করলে তারা দু-চারটি আসনে লড়াই করে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে তুলনামূলকভাবে সহজ মনে করে। এই দুই কারণেই ঐক্যের পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে বলে আমি মনে করি।

ঢাকা পোস্ট : ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এক বছরের বেশি সময় পার করেছে। আপনার দৃষ্টিতে এই সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মামুনুল হক : এই সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা—দুটোই আছে। সফলতার বড় দিক হলো—বিগত সরকার দেশের অর্থনীতিকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিল, রিজার্ভের সংকটসহ নানা জটিলতার মধ্যে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা তার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে অনেকটা সফলভাবে তা মোকাবিলা করতে পেরেছেন। সেই অবস্থা থেকে দেশকে টেনে এনে নির্বাচনমুখী করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, যা তারা কিছুটা হলেও করতে পেরেছেন।

দ্বিতীয় সফলতা হলো—তারা সব রাজনৈতিক দলকে অন্তত এক টেবিলে বসিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশের একটা রোডম্যাপ তৈরির চেষ্টা করেছেন।

আর সরকারের ব্যর্থতা হলো—সরকার ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। সরকারের শক্তিমত্তা কমে যাওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারা বাস্তবায়ন করতে সাহস পাচ্ছে না। বরং এখন মনে হচ্ছে, সরকার একটি সেফ এক্সিট চাচ্ছে, যেন সুন্দরভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে। অথচ সরকারের উচিত ছিল জরুরি সংস্কারগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচনমুখী হওয়া। কিন্তু তারা সংস্কার প্রক্রিয়াতে এত সময় নিয়েছে যে, এখন তার বাস্তবায়ন প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া, এই সরকার রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই দুর্বল। বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তির অভাব স্পষ্ট। অনেকে বলছেন, এটি এনজিওনির্ভর একটি সরকার। ফলে রাজনৈতিক বাস্তবতা মোকাবিলায় তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। সর্বোপরি, সরকার যে কঠিন অবস্থায় দেশের দায়িত্ব নিয়েছে, সেই অবস্থা থেকে দেশকে চালিয়ে নেওয়াটাও একটা বড় বিষয় ছিল। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তারা অনেক সুযোগ হাতছাড়া করেছে।

ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

মামুনুল হক : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।