
বদরুদ্দীন উমর, লেখক-গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। ৯৪ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে আজ রোববার তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি নেন। দেশে ফিরে এসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। আলোচিত সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে বদরুদ্দীন উমরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশিত হলো।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
আপনাকে ৯০তম জন্মবার্ষিকীর শুভেচ্ছা। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
বদরুদ্দীন উমর: আমি এত দিন যে বাঁচব, ভাবিনি। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কীভাবে জীবন যাপন করেছেন যে এত দিন বেঁচে আছেন? কিন্তু আমি তো বলতে পারব না কীভাবে জীবন যাপন করার ফলে এত দিন বেঁচে আছি। সবাই তো একই কারণে বাঁচে না। কে, কী কারণে বাঁচে, তা বলা মুশকিল। তবে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য সবার একটা জিনিস খুব বেশি করে করা দরকার, সেটা হলো, খাওয়াদাওয়ার হেফাজত। বেহিসাবি খাওয়াদাওয়া করলে কোনো মানুষই বেশি দিন বাঁচে না।
আপনার বেঁচে থাকা তো শুধু নিজের জন্য না, অন্যদের জন্যও বেঁচে থাকা। তাদের কতটা প্রাণিত করতে পেরেছেন?
বদরুদ্দীন উমর: সেটা তো বুঝতে পারি না। আমার বেঁচে থাকা মানুষকে অনুপ্রাণিত করলে, বাস্তবে তো দেখতাম। আমি বলব, আমি একধরনের উপেক্ষিত। আমি যে এত কাজ করেছি, আমাকে নিয়ে কোনো জায়গায় কোনো লেখা পাবেন না। এখানে এত লোকের ওপর লেখা হয়, কিন্তু আমার লেখা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। এমনকি আমার ভাষা আন্দোলনের বইয়ের ওপরও কোনো আলোচনা নেই। কলকাতায় আমার বই ও লেখার ওপরে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক কৃতবিদ্য মানুষ আমার ওপরে লিখেছেন। সেটা বাংলাদেশে চিন্তাও করা যায় না। কাজী আবদুল ওদুদ, মৈত্রেয়ী দেবী, নারায়ণ চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, অশোক মিত্র—এঁরা আমার কাজ নিয়ে লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। এঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে উঁচু স্তরের মানুষ। দলনির্বিশেষে তাঁরা আমার ওপরে লিখেছেন। কিন্তু এখানে দলনির্বিশেষ উপেক্ষা করা হয়েছে।
উপেক্ষা করার পেছনে কারণ কী? ভয়ও পায় বোধ হয়?
বদরুদ্দীন উমর: আমি যে একজন কমিউনিস্ট, সেটাই এখানকার লোকে জানে না। তারা আমাকে বুদ্ধিজীবী বলে। ভয় পায় এ কারণে যে আমি লোকের ভণ্ডামি, নির্বুদ্ধিতা, মূর্খতা, এসব প্রকাশ করি। আমি ঘটনা বিশ্লেষণ করি, ভুলত্রুটি নির্দেশ করি এবং অনেকের মুখোশ খুলে দিই। এটাই হচ্ছে আমার ওপর তাদের রাগের কারণ।
উপমহাদেশের রাজনীতির বড় ক্ষতটা তৈরি করেছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। সেটা কি এড়ানো যেত না?
বদরুদ্দীন উমর: ইতিহাসে যেটা ঘটে গেছে, সেটা এড়ানো যেত কি না, বলে লাভ নেই। একটা বিষয় বলা যেতে পারে, কী কারণে ভারত ভাগ ও বাংলা ভাগ হলো। ভারত ভাগ জিন্নাহ করেননি। ভারত ভাগ করেছে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা। ভারতের সব গ্রহণযোগ্য ইতিহাস এটা এখন স্বীকার করে। দ্বিজাতিতত্ত্ব এসেছে উনিশ শতকে, হিন্দু মেলার মাধ্যমে। নবকুমার মিত্র, রাজ নারায়ণ রায় এর প্রবক্তা। মুসলমানরা পিছিয়ে, এখন তাঁরা যদি হিন্দুদের ধরে ফেলে—সেই চিন্তা থেকেই এই দ্বিজাতিতত্ত্ব। আমি সম্প্রতি একটা লেখায় লিখেছি, হিন্দুদের দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল অফেনসিভ। আর মুসলমানদের যে দ্বিজাতিতত্ত্ব, সেটা ডিফেন্সিভ। গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারক। সে কারণেই ভারত ভাগের পর মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করা হয়েছিল। এর থেকে বড় কেলেঙ্কারি কি হতে পারে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম সাহেব যে যুক্ত বাংলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা সফল হলো না কেন?
বদরুদ্দীন উমর: এর উত্তর এককথায় কি বলা যায়? সাধারণ হিন্দুরা দেশভাগ চায়নি। কংগ্রেসের অনেক নেতাও দেশভাগ চাননি। যুক্ত বাংলার পক্ষে আন্দোলন হলে, সেটা সফল হতো। কিন্তু সেই সময়টা ইংরেজরা দেয়নি। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে এলেন মাউন্টব্যাটেন। আর ৩ জুনের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। কাউকে তো চিন্তা করার সময় দেওয়া হলো না। হুড়মুড় করে সব হয়ে গেল। মিছিল–আন্দোলনের সুযোগ থাকলে দেশভাগ হতো না।
এ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা কী ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: কমিউনিস্ট পার্টি কখনোই মনে করেনি যে তারা ক্ষমতা দখল করতে পারবে। কমিউনিস্ট পার্টি মনে করত, কংগ্রেস তাদের প্যারেন্টস সংগঠন। ১৯৪৪ সালে যখন কংগ্রেস মুসলিম লীগ আলোচনা হচ্ছে, তখন কমিউনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলল, ‘কংগ্রেস লীগ এক হও হাতে হাত বেঁধে নাও।’ তখন আমরা কিশোর বাহিনী করতাম। এই স্লোগান দিতাম। এই হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান। তারা বিপ্লব করার চিন্তা করত না; নিজেদের সহযোগী হিসেবে চিন্তা করত। বড় বড় আন্দোলন করেছে। কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন করেছে। কিন্তু সেগুলো কংগ্রেসের গোলায় তুলে দিয়েছে। এখানে যেমন কমিউনিস্টরা সবকিছু মাওলানা ভাসানীর হাতে তুলে দিয়েছে। দেশভাগের আগে তার থেকেও বেশি খারাপ অবস্থা ছিল কমিউনিস্টদের। মাওলানা ভাসানী জনদরদি নেতা ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বে অনেক দুষ্ট লোক ছিলেন।
দেশ বিভাগের পর আড়াই বছর তো বর্ধমানেই ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাটা কি বলবেন?
বদরুদ্দীন উমর: বর্ধমানে আমাদের একটা ভালো অবস্থান ছিল। ৪৭-এর পর খুব একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে—এ রকম কিছু বোধ করিনি। তারপর হঠাৎ করে ১৯৫০ সালে একটা দাঙ্গা হলো। তবে বর্ধমানেও একটা-দুইটা ঘটনা ঘটেছিল। কিছু লোক আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল। এ ঘটনায় আব্বা (আবুল হাশিম) খুব ভেঙে পড়লেন। তারপর উনি আর ওখানে থাকতে চাইলেন না। কিন্তু এমনিতে আমাদের কোনো অসুবিধা ছিল না।
সার্বিকভাবে ভারতে মুসলমানদের অবস্থা কেমন ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: সার্বিকভাবে মুসলমানদের অবস্থা ইংরেজ আমলে যেমনটা ছিল, সাতচল্লিশের পর কংগ্রেসের পাল্লায় পড়ে খারাপ হলো। ভারতে জনসংখ্যার ১৪-১৫ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু চাকরিতে তাদের অনুপাতে ২ শতাংশের বেশি নয়। পশ্চিম বাংলার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে ৩০ শতাংশের ওপরে মুসলমান। কিন্তু চাকরির হিস্যা ২ শতাংশ। কংগ্রেসের পর ৩৪ বছর ধরে পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় মার্ক্সিস্ট বলে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও এর থেকে বের হতে পারেননি। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বড় বড় কথা বলেন। কিন্তু মুসলমানদের শিক্ষার জন্য বেশি ব্যয় করেছেন মাদ্রাসায়। সেই পড়াশোনায় চাকরি–বাকরি কিছু হবে না।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বদরুদ্দীন উমর: সাম্প্রদায়িকতা বলে এখানে আসলে কিছু নেই। এখানে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিভূমির যে শর্ত, সেটা সাতচল্লিশে শেষ হয়ে গেছে। কারণ, এর সামাজিক ভিত্তি নেই। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি ছিল হিন্দু–মুসলমানের দ্বন্দ্ব। হিন্দুরা শক্তিশালী ছিল, অর্থশালী ছিল, বিদ্যাশালী ছিল। মুসলমানদের অবস্থান তার থেকে নাজুক ছিল। সাতচল্লিশ সালের পর মুসলমানরা প্রাধান্যে চলে আসায় এই দ্বন্দ্বটা চলে গেল। এরপর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় উন্মেষের চিন্তা সামনে চলে এল। ভিত্তিভূমিটা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন নতুন দ্বন্দ্ব বাঙালি-অবাঙালি, পূর্ব পাকিস্তান-পশ্চিম পাকিস্তান। ৭১-এর পর সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিভূমি ছিল না। এখানে এখন যেটা আছে, সেটা হলো, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। এই যে এখন যে সাম্প্রদায়িকতার কথা বলা হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় হামলা হচ্ছে, সেগুলো করছে কারা? শাসকশ্রেণির লোকেদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যের সম্পত্তি দখল করছে। মুসলমানদের সম্পত্তিও দখল করছে তারা।
আপনি বলছেন ভাষা আন্দোলনের পর নতুন দ্বন্দ্ব এল। সেই দ্বন্দ্বে কমিউনিস্টরা কি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারলেন?
বদরুদ্দীন উমর: কমিউনিস্টরা শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী ছিল। কিন্তু সে সময় এখানে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বেশির ভাগই হিন্দুরা থাকলেন। মুসলমান নেতৃত্ব খুব কমই ছিল। ফলে এ নেতৃত্ব মুসলমানদের মধ্যে সেভাবে যাওয়া, তাদের সংগঠিত করার কাজ—সেগুলো যথাযথভাবে করতে পারলেন না।
মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কি সেই দ্বন্দ্বটা বুঝতে পেরেছিল?
বদরুদ্দীন উমর: এখানে দুটো বিষয় ছিল। শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতীয় দ্বন্দ্ব। কমিউনিস্টরা না বুঝেছিল শ্রেণি সংগ্রাম, না বুঝেছিল জাতীয় সংগ্রাম। শ্রেণি সংগ্রামের আওয়াজ তুলেছিল তারা, কিন্তু শ্রমিকের মধ্যে, কৃষকের মধ্যে কতখানি কাজ তাদের ছিল? সাতচল্লিশের পর তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেল। তারা জনগণের মধ্যে কতটা যেতে পেরেছিল? তারা যেটুকু সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল, সেটা আদিবাসীদের এলাকায়। সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তাদের তেমন আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনের পরে, এখানে জাতীয় দ্বন্দ্ব যেটা তৈরি হচ্ছিল, সেটা আসলে শ্রেণিদ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। এ দুটোর মধ্যে একটা মিল আছে। কিন্তু মিলের জায়গাটা কমিউনিস্টরা ধরতে পারেননি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব ছিল জাতীয় সংগ্রামের বিকাশ তথা পাকিস্তানিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যে প্রধান বিষয়, সেটা ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন। মাওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানদের কাণ্ডজ্ঞান কমিউনিস্ট নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এই কাণ্ডজ্ঞানের মধ্য দিয়ে তাঁরা বুঝেছিলেন, এখন জাতীয় সংগ্রামের বিকাশ ঘটানো দরকার।
কমিউনিস্ট আন্দোলনে আপনার যুক্ততা কীভাবে হলো?
বদরুদ্দীন উমর: কমিউনিস্টদের সঙ্গে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্ধমানে আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কমিউনিস্টে ভর্তি ছিল। ছেলেবেলা থেকেই তাঁদের দেখেছি। এখানে আসার পর সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হয়েছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়ার পর।
আপনার এই রূপান্তর কী অক্সফোর্ডে অধ্যয়নের কারণে?
বদরুদ্দীন উমর: আমার মধ্যে দুটো চিন্তা বরাবরই ছিল। আমার বাবার রাজনীতি ও কমিউনিস্ট আদর্শের রাজনীতি। প্রথম দিকে বাবার রাজনীতির প্রভাব একটা ছিল। তবে সেটাকে আদর্শ বলে মনে করতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সেই প্রভাবটা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ছাড়ি, তখন এ প্রভাবটা আমার চলে গিয়েছিল। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা পর্যন্ত সময়টাকে অন্তর্বর্তীকাল বলা চলে। এই সময়টা বেশ দীর্ঘ। এর পর থেকে কমিউনিস্ট চিন্তাধারাতেই আমি চলেছি। আমার সাম্প্রদায়িকতা বইটি মার্ক্সবাদী ধারাতেই লেখা।
আপনি তো মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছিলেন?
বদরুদ্দীন উমর: আমি চাকরি ছেড়ে দেব, রাজনীতি করব, সেটা অনেক আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। পরে মোনায়েম খানের কর্মকাণ্ডে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। আমাকে তারা তাড়াতে কিংবা বরখাস্ত করতে পারত না, কিন্তু নানা রকম হয়রানি করছিল। চাকরি ছেড়ে গেলাম রাজনীতি করতে। মাওলানা ভাসানী বললেন, তুমি কৃষক সভার সম্পাদক হও। আমি বললাম, কি বলছেন আপনি? আমি বাংলাদেশের গ্রাম কিছুই জানি না। কৃষক কিছুই জানি না। কৃষক সভার সম্পাদক কী করে হব? তারপর উনি বললেন, তুমি ন্যাপের সম্পাদক হও। আমি তখন বললাম, আমি ন্যাপ করব না। আমি চাকরি ছেড়ে ন্যাপ করতে আসিনি। আমি কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছি। অন্য কোনো পার্টি করব না।
কমিউনিস্ট পার্টি তখন নানা ভাগে বিভক্ত। আমি সুখেন্দু দস্তিদার-আবদুল হকদের দলে যোগ দিলাম। অন্য যে পার্টিগুলো ছিল, সেগুলোর কোনোটাকেই কমিউনিস্ট পার্টি বলা যাবে না। নেতাদের কারও লেখাপড়া ছিল না। কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে আবদুল হকই মার্ক্সের ডাস ক্যাপিটাল পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি ‘পাঠ’ করেছেন, গভীরে যাননি। গণশক্তি পত্রিকায় তিনি যেসব লেখা লিখেছেন, সেগুলোও ছিল সুপারভিসিয়াল। শরতের মেঘের মতো দেখতে সুন্দর, ভেতরে প্রাণ নেই, জীবন নেই। সে কারণে একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে আমি পার্টি ছেড়ে দিলাম। এটা যেমন ঠিক, আবার এটাও ঠিক, এখন যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে, আবার যদি সুযোগ হয় তুমি কোন পার্টিতে যোগ দেবে? আমি বলব, সুখেন্দু দস্তিদারের ওই পার্টিতেই যোগ দেব।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট আন্দোলন তো সংকটে পড়ল?
বদরুদ্দীন উমর: এই সংকট তো তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও ইয়াহিয়া খানকে একই পাল্লায় মাপলেন। এটি কখনো হয় নাকি? যেখানে দেশের মানুষ লড়াই করছে, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে, সেখানে তাঁরা বলে দিলেন ‘দুই কুকুরের লড়াই।’ এর চেয়ে সর্বনাশা কিছু হতে পারে না। তাঁদের উচিত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একত্রে মুক্তিযুদ্ধ করা। এপ্রিলের শুরুতে একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহার সঙ্গে আমিও ছিলাম। সেখানে মাওলানা ভাসানীর একটি চিঠিও দেখানো হলো। ঠিক হলো কমিউনিস্টরাও একসঙ্গে লড়াই করবে। কিন্তু এপ্রিলের ১৩ বা ১৪ তারিখে আমি যশোরে ছিলাম। চৌ এন লাইয়ের বিবৃতি দেখানো হলো, যেখানে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলেছেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে সৈয়দ জাফর নামের এক কর্মী ছিলেন, তাড়াতাড়ি তাঁকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এরপর তাঁরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ও শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন নিলেন। যেখানে জাতীয় সংগ্রাম চলছে, সেখানে তাঁরা শ্রেণিশত্রু খতম করতে গেলেন। আপনি যখন একটি মানুষকে হত্যা করবেন, তখন তাঁর আত্মীয়স্বজন, পরিবার, প্রতিবেশী সবাই বিরুদ্ধে চলে যাবে। সেটাই হয়েছে। ফলে জনগণ তাঁদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করল এবং ৭১-এর আগস্টে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। নিজের বোকামি ও মূর্খতার কারণেই তাঁদের এই অবস্থা হয়েছে।
ষাটের দশকে আপনিই লিখেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। সেই প্রত্যাবর্তনটা কেমন ছিল?
বদরুদ্দীন উমর: দেশভাগের আগে এখানে একশ্রেণির মুসলমান নিজেদের আরবি ফারসি সংস্কৃতির ধারক-বাহক ভাবতেন। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর সেই ভাবনার লোক আর দেখা গেল না। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের পর সেই প্রচারণা সমাজে ভিত্তি পেল না। তরুণ প্রজন্ম নিজেদের পরিচয় খুঁজতে লাগল। ধীরে ধীরে বাঙালির মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটল। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন লিখলাম।
আপনি যে সংস্কৃতির সংকটের কথা লিখেছিলেন পাকিস্তান আমলে, সেই সংকট তো এখনো আছে?
বদরুদ্দীন উমর: সংকট তো আছেই। আবার সেই সংকটকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, তার উদ্দেশ্য হলো লুটপাট করা ও ভারতের তোয়াজ করা। তারা নরেন্দ্র মোদিকে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিমূর্তি হিসেবে দাঁড় করার চেষ্টা করছে। সেখানকার লেখক ইতিহাসবিদেরা কিন্তু তাঁর ও অমিত শাহর কঠোর সমালোচনা করছেন। তাঁরা ভারতের সব মুসলমান নাম মুছে দিচ্ছে। এর জবাবে ইরফান হাবিব বলেছেন, অন্যদের নাম মোছার আগে অমিত শাহর উচিত নিজের নাম থেকে শাহ বাতিল করা। কেননা শাহ শব্দটি এসেছে ইরান থেকে।
আপনি বহু বছর থেকে সংস্কৃতি পত্রিকা বের করছেন। সমাজে কতটা প্রভাব রাখতে পারছে?
বদরুদ্দীন উমর: সংস্কৃতি পত্রিকা আমি ১৯৭৪ সাল থেকে বের করছি। সমাজে প্রভাব ফেলবে কী, আপনারাই তো পড়েন না। তারপরও সীমিতসংখ্যক মানুষের কাছে পত্রিকাটি পৌঁছেছে। নভেম্বর সংখ্যায় আমি লিখেছি, কংগ্রেস থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি। এর আগের সংখ্যায় ছিল ভারতের ইতিহাসচর্চা নিয়ে। এ দেশের লোকজন তো পড়াশোনা তেমন করেন না। আমার লেখালেখি নিয়ে যা আলোচনা ভারতেই হয়েছে। আমি একটি কথা বলি, এই বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মননশীলতা বলে কিছু নেই। ফাঁপা জিনিস নিয়ে লাফালাফি হচ্ছে। মননশীলতা নেই। সে রকম লেখকও নেই।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা—এর কোনটিকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
বদরুদ্দীন উমর: একসময় আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সংগঠিত করেছি। কিন্তু এই নব্বই বছর বয়সে তো সেটি সম্ভব নয়। এখন তো ঘরের বাইরে যেতে পারি না। এখন লেখালেখিও কম করি। সংস্কৃতি ও কলকাতার দু–একটি পত্রিকায় লিখি। তবে পড়ি বেশি। চারতলায় আমার পাঠাগারটি পড়ার মতো অনেক বই আছে। আবার অনলাইনে কিনেও অনেক বই সংগ্রহ করি।
তা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মননশীলতা তৈরি হলো না কেন?
বদরুদ্দীন উমর: শরীরে ইনজেকশন দিয়ে তো মননশীলতা তৈরি করা যায় না। রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেও এটি পাওয়া যাবে না। এর জন্য চর্চা দরকার। আজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই। কিন্তু ভারতে মোদি সরকার যতই দুর্বৃত্তায়ন চালাক না কেন, সেখানে প্রগতিশীলেরা, কমিউনিস্টরা ইতিহাসচর্চা করছেন। রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব, অমিয় কুমার বাগচীর মতো অনেক ইতিহাসবিদ আছেন। আর আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকান, কোনো ইতিহাসবিদ নেই। এমনকি সৃজনশীল সাহিত্যেও তো আখতারুজ্জামান, হাসান আজিজুল হকের পর উল্লেখ করার মতো কাউকে দেখছি না। এই যে সাতচল্লিশ সাল থেকে এত সংগ্রাম করে এখন যে অবস্থা দাঁড়াল, তা খুবই হতাশাজনক। অর্থনীতির দিকে তাকালেও দেখব একদিকে মেট্রোরেল হচ্ছে, টানেল, পাতাল রেল হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই, সেতু নেই। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। ঢাকা থেকে দু-ঘণ্টায় চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু আমাদের দেশ তো জাপান নয়। এই অর্থ স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা যেত। স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবস্থা খুবই শোচনীয়। উন্নয়নের সুফল তো ১ বা ২ শতাংশ মানুষের কাছে যাচ্ছে। জিনিসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে না ঠিক, তারা অপুষ্টিতে ভুগছে। বৈষম্য সর্বত্র।
আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে শিক্ষার হাল কী?
বদরুদ্দীন উমর: শিক্ষাব্যবস্থার কথা কী বলব? নতুন প্রজন্মের কেউ তো এখন বাংলা পড়ে না। আমার আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েরাও বাংলা জানে না। ইতিহাস জানে না। বাংলাদেশই এমন একটি দেশ, যেখানে ইতিহাস পাঠ্য থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষার ভিত শক্ত না হলে উচ্চশিক্ষা কী করে হবে? এর অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে মেধাবী ছাত্র নেই। বাইরে যারা চলে যায়, তারা ভালো করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এখানে পারছে না। এখানে চর্চা-গবেষণার সুযোগ নেই।
যে বাংলাদেশ ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আপনারা লড়াই করেছেন, মননশীলচর্চায় রত আছেন, তা বাস্তবে রূপ পেল না কেন?
বদরুদ্দীন উমর: একটা চালু কথা হলো, সমাজতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে। আমাকে অনেকেই বলেন, আপনি তো অনেক দিন ধরে চেষ্টা করলেন। কিছুই হলো না। ম্যাগনেট যেভাবে লোহাকে আকর্ষণ করে, সেভাবে পারেননি। আমি বলি, এটি দুই তরফা। ম্যাগনেট লোহাকে আকর্ষণ করে, কাঠকে নয়। বিপ্লবের পর রাশিয়ায় ও চীনে মানুষকে রাজনীতিতে দীক্ষিত করে তাদের জীবনমান উন্নয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে কোনো রাজনৈতিক অরিয়ন্টেশনই ছিল না। হঠাৎ করে একটি লুটেরা শ্রেণি গড়ে উঠল। এখন পত্রিকায় দেখি, সরকারি অফিসের পিয়ন-দারোয়ানও অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করার কেউ নেই। সবাই ‘ইয়া নফসি ইয়া নফসি’ করছেন। এখানে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন নেই, কমিউনিস্ট আন্দোলন নেই। সে কারণেই ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসেছে, যা ইচ্ছে তা–ই করছে। কিন্তু পরিবর্তন হবেই।
সমাজতন্ত্র নিয়ে আপনার এখনকার ভাবনা কী?
বদরুদ্দীন উমর: চীন বা সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে এর ভবিষ্যৎ নেই। সমাজতন্ত্র মানব ইতিহাসের সংগ্রামে অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজতন্ত্র দেখিয়ে দিয়েছে, তারা কী দিতে পারে। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? আমি বলি, পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ কী? যুক্তরাষ্ট্র একবার ভিয়েতনাম থেকে কমিউনিস্টদের হাতে মার খেয়ে পাততাড়ি গুটিয়েছিল। সর্বশেষ মৌলবাদী তালেবানদের হাতে মার খেয়ে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এটাই পুঁজিবাদের পতনের ঘণ্টাধ্বনি। পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থাও একদিনে আসেনি। যাঁরা সমাজতন্ত্রের দিন শেষ হয়েছে বলেন, তাঁরা এক হাতের বেশি দূরত্বে দেখতে পারেন না। বর্তমানই শেষ কথা নয়; শত শত বছরের ইতিহাস পরিক্রমায় একটি মুহূর্ত। আমরা থাকব না। পরের প্রজন্ম লড়বে, লড়তেই হবে। মানবজাতি বেঁচে থাকলে পরিবর্তন হবেই; যদি পুঁজিবাদী বিশ্ব গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করে না দেয়। তারা কেবল শ্রমিককে ধ্বংস করছে না। মানুষ ও পরিবেশকেও ধ্বংস করছে।
বাংলাদেশে বামেরা এত বিভক্ত কেন?
বদরুদ্দীন উমর: বামেরা বিভক্ত কারণ, তাদের চিন্তা নেই। বুদ্ধি নেই, লড়াই করার মানসিকতা নেই। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ে না, লড়াই করতে করতে ঐক্য হয়। মুশকিল হলো, এখানে সত্যি কথা বলার উপায় নেই। সত্যি কথা বললে গুম হয়ে যেতে হয়।
আপনি এত কড়া কড়া লিখেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত জেলে যেতে হয়নি।
বদরুদ্দীন উমর: পশ্চিমবঙ্গের সুনীতি ঘোষও কথাটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের অনেককে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন ওনার বিরুদ্ধে কিছু হচ্ছে না। তারা বলছেন, রিঅ্যাকশনটা বেশি হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে ঘিরে আপনাদের একটি বৃদ্ধিবৃত্তিক সার্কেল গড়ে উঠেছিল। সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
বদরুদ্দীন উমর: তিনি ছিলেন সক্রেটিসের মতো। তিনি লিখেননি। কিন্তু অনেক পড়েছেন। যেকোনো বিষয়ের ওপর বলতে পারতেন। বইয়ের খোঁজখবর দিতেন। তাঁর নিজের সংগ্রহ ছিল বিশাল।
আপনাকে ধন্যবাদ।
বদরুদ্দীন উমর: আপনাকেও ধন্যবাদ।