ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শেখ মো. আরমান মনে করেন, সমালোচনার প্রতি সহিষ্ণুতাই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে পারে। তার মতে, কোনো সরকার যদি জন-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে বা সমালোচনা গ্রহণে অক্ষম হয়, তবে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসির লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের নিজস্ব প্রতিবেদক তাওসিফুল ইসলাম।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর দেশে বেশ কয়েকটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ‘ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসি’ একটি উল্লেখযোগ্য নাম। এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য কী?
শেখ আরমান: ‘ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসি’ মূলত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সদ্য পাস করা তরুণদের জন্য একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, যারা রাজনীতি ও দেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন। এই প্ল্যাটফর্ম তৈরির ধারণা আমার অনেক দিন ধরেই ছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র বর্তমানে একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় থাকা দলগুলো প্রায়শই গণতন্ত্রকে নিজেদের স্বার্থে সংজ্ঞায়িত করে। ফলে গণতন্ত্রের সর্বজনীন রূপ পরিলক্ষিত হয় না। বিশেষ করে বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, গণমাধ্যম সাধারণত তাদের অনুগত হয়ে যায়।
মিডিয়া গণতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রকৃত চিত্র বুঝতে হলে সেই দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করা অত্যাবশ্যক। তবে বাংলাদেশে, শুধু গত ১৫ বছর নয়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের যে কোনো শাসক দল গণমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাদের বিরুদ্ধে বড় কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ পেতে দেখা যায়নি। কিন্তু এখন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, প্রতিদিনই তাদের বিরুদ্ধে লিড নিউজ এবং ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এটি আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকটকে স্পষ্ট করে তোলে।
উল্লেখ্য, ‘ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসি’ এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা এই সংকট এবং গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা পুনরুদ্ধারে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে চায়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কিন্তু গণমাধ্যমে অনেক বড় বড় রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, রূপপুরের বালিশকাণ্ড।
শেখ আরমান: একেবারে কিছুই আসেনি, তা বলছি না। তবে খুবই সীমিত মাত্রায় এসেছে। তাছাড়া গণমাধ্যমগুলো কার্যত তাদের কাজ করার স্বাধীনতাও পায়নি। এখন যেমন দেখুন, ইউনুস সরকার ক্ষমতায়। এই সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়া কিছুটা ভোকাল হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সরকারের সমন্বয়ক বা উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের নিয়ে বড় প্রতিবেদন করতে গণমাধ্যম দশবার ভাবে। অথচ এ ধরনের দ্বিধা থাকা উচিত নয়।
গণমাধ্যম হলো গণতন্ত্রের প্রহরী—ডেমোক্রেসির ওয়াচডগ। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার এই দায়িত্ব থেকেই ‘ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসি’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এই প্ল্যাটফর্মে যেকোনো বিষয় নিয়ে মুক্ত আলোচনা করা যাবে, এবং সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকবে।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এমন একটি পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছি যেখানে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের মতামত দেবেন এবং গণতন্ত্রের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। এটি একটি মুক্ত ও সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, যা তরুণ প্রজন্মকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় উৎসাহিত করবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি সর্বজনীন গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। এই সার্বজনীন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আপনার কাছে কী?
শেখ আরমান: গণতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থার প্রতিফলন যেখানে জনগণের ইচ্ছা এবং চাহিদার প্রতি সরকার সাড়া দেয়। এর একটি প্রধান শর্ত হলো, সরকার ব্যবস্থায় অধিকাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত, এবং তারা যাকে চান, সেই ব্যক্তির মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হবে।
দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলাদেশে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। যেসব সরকার ক্ষমতায় আসে, তারা সাধারণ জনগণের স্বার্থ ও চাহিদাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয় না। তারা সমালোচনা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মতামত প্রকাশ করা একটি অগ্রহণযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তবে যদি আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে যে, সেখানে সরকাররা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে হলেও, মতামত প্রকাশ এবং সমালোচনাকে স্বাগতম জানায়। সেখানে সমালোচনা একটি ইতিবাচক প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য হয়, যা গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক।
আমাদের দেশে, দুর্ভাগ্যবশত, এই সংস্কৃতিটি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের যদি সামান্য সুযোগও মেলে, আমরা এই সংস্কৃতির পরিবর্তন সাধন করার জন্য চেষ্টা করবো। আমাদের লক্ষ্য হলো এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে সমালোচনা এবং মতামত প্রকাশ করা হবে গ্রহণযোগ্য, এবং এটি গণতন্ত্রের উন্নতির পথপ্রদর্শক হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তাহলে এটি কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠান? এখানে শুধুমাত্র কি ডায়ালগ হবে? কারা আপনার সঙ্গে কাজ করছেন?
শেখ আরমান: আমাদের পরিকল্পনা হলো আগামী দুই বছর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ডায়ালগের আয়োজন করা। বিশেষভাবে আমরা গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব। দুই বছর পর, আমাদের লক্ষ্য হলো এটি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
এই প্রতিষ্ঠানে আমরা গণতন্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পিলার নিয়ে গবেষণা চালাবো এবং সেই গবেষণার ওপর পাবলিকেশন প্রকাশ করব। শুধু ডায়ালগ নয়, এখানে সেমিনার, পাঠচক্র এবং টকশো আয়োজন করা হবে।
বর্তমানে, এই প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এবং তাই এখানে আমাদের প্রধান প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আপাতত, তারা আমাদের প্রধান টার্গেট অডিয়েন্স, এবং আমরা তাদের জন্যই মূলত কাজ করছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি বলছেন, যারা গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তা করেন এবং রাজনীতি সচেতন নাগরিকরা এখানে সংযুক্ত আছেন। তবে বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশ রাজনীতি নিয়ে সচেতন নয়, তারা রাজনীতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেন না। তাদের জন্য আপনারা কী আয়োজন করছেন?
শেখ আরমান: আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ৫ আগস্টের পর থেকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। পূর্বে মানুষ মূলত আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের বাইনারি অবস্থানে ছিল, কিন্তু সেই চিন্তা ধারা এখন বদলেছে। এখন, মূল শক্তি হয়ে উঠেছে তরুণ সমাজ। আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স মূলত জেন-জি, কিন্তু আমাদের আলোচক গ্রুপটি অভিজ্ঞ এবং গতিশীল।
আমরা চাই, জেন-জি’র মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা আরো সমৃদ্ধ হোক এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃত হোক। ইতোমধ্যে, আমরা যে সকল অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি, সেখানে বেশ ভালো ফিডব্যাক পেয়েছি। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, আমরা আশা করি আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হবো।
আমাদের লক্ষ্য হলো একটি সুস্থ, সচেতন রাজনৈতিক সমাজ তৈরি করা, যেখানে কোন সরকারই জনগণের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আপস করবে না। আমরা চাই, ভবিষ্যতে কোনো সরকারই জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে না পারে, এবং তারা যেন স্বৈরাচারী রূপ নিতে না পারে। এই পরিবর্তনে, আমরা মনে করি, জেন-জি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তারা সরকারের গতিপথ নির্ধারণে সহায়ক হবে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনা করেছে। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেছে? এবং সরকার আদৌ এই আলোচনাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছে কি?
শেখ আরমান: সরকার আলোচনা শুনে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তর ৫ আগস্টের আগে হয়তো ভিন্ন হত। তবে ৫ আগস্টের পর দেশের জনগণের চিন্তাভাবনায় এক মহাবৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখন আমরা দেশকে নতুনভাবে গঠনের চেষ্টা করছি। সেই প্রেক্ষাপটে, শিক্ষার্থীদের চিন্তা, শিক্ষকদের আলোচনা এবং বিশিষ্টজনদের মতামত সরকারের জন্য গুরুত্বহীন হতে পারে না; বরং তাদেরকে এসব কণ্ঠ শোনার জন্য বাধ্য করতে হবে।
আমাদের উদাহরণ হিসেবে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটগুলো দেখতে পারেন। এসব ডিবেট নির্বাচনে কে জিতবে, সেটা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে, কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকে আপনি খুঁজে পাবেন না, যারা ওপেন প্ল্যাটফর্মে, জনসম্মুখে বিতর্ক করছেন।
আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীরা অন্য দলগুলোর প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনের পূর্বে বিতর্ক করবেন। আমরা তাদের সঙ্গে ডায়ালগের আয়োজন করব, যেখানে আলোচনা হবে—তারা কী চায়, শিক্ষার্থীরা কী চায়, দেশের সাধারণ জনগণ কী চায়। এই ধরনের মুক্ত আলোচনা গণতন্ত্রের অনুভূতি এবং আবেদন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে।
যতদিন না জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, ততদিন ভবিষ্যতে কোনো সরকার টিকতে পারবে না। গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশের জন্য জনগণের কণ্ঠ শুনে তাদের চাহিদা ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইতোমধ্যে আপনারা কী কী প্রোগ্রাম করেছেন? আর ভবিষ্যতে কোন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা আছে কি?
শেখ আরমান: ইতোমধ্যে আমরা তিনটি প্রোগ্রাম আয়োজন করেছি এবং আগামী সপ্তাহে আরেকটি প্রোগ্রাম করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমি শুরুতেই বলেছিলাম, গণমাধ্যম গণতন্ত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। প্রথম প্রোগ্রামটি ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে—অতীতে তা কেমন ছিল এবং ভবিষ্যতে কীভাবে তা রূপ নেবে। এই প্রোগ্রামে গণমাধ্যমের গণতন্ত্রের চরিত্রায়নে কী ভূমিকা থাকতে পারে, সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। আলোচক হিসেবে ছিলেন, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাপকভাবে নির্যাতিত আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
দ্বিতীয় প্রোগ্রামটি ছিল বাংলাদেশের প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নিয়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছিলেন। সেই আলোচনায় আমাদের চেষ্টা ছিল, দেশের সকল রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সহিষ্ণুতা তৈরি করার। আমরা আলোচনা করেছি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতি কীভাবে হতে পারে, এবং অতীতে তা কেমন ছিল।
আগামী দুটো প্রোগ্রামের বিষয়বস্তু থাকবে ডাকসু এবং নির্বাচন কমিশন—প্রত্যেকটি বিষয় গণতন্ত্রের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আরও শক্তিশালী করতে চাই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যে সংলাপ হয়েছে, সেখানে ছাত্রনেতারা কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন?
শেখ আরমান: ছাত্ররাজনীতি নিয়ে যে আলোচনা আমরা করেছি, তা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। এতে সক্রিয় দলগুলো উপস্থিত ছিল, তবে খুবই দুঃখজনক যে ছাত্রদল অংশগ্রহণ করেনি। ছাত্রদল এখনও আগের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা থেকে বের হতে পারেনি। তাদের মধ্যে যে বিভাজন—যেমন শিবির থাকলে ছাত্রদল অংশগ্রহণ করবে না, একজন থাকলে অন্যজন যাবে না—এই ধরনের মনোভাব থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
এখন, এই আলোচনা থেকে সব ছাত্রনেতারা প্রতিজ্ঞা করেছেন যে তারা আর পূর্বের মতো লেজুরভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িত থাকবেন না। তারা শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি, চাহিদা এবং মনোভাব বুঝে কর্মসূচি প্রণয়ন করার উপর জোর দিয়েছেন।
আর তারা একমত হয়েছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘গেস্টরুম-গণরুম’ কালচার থাকতে দেওয়া হবে না। এই বিষয়ে তারা একটি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা এবং মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ছাত্রদলের লেজুড়বৃত্তি প্রসঙ্গে আপনি কথা বলেছেন। সম্প্রতি জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ছাত্রদল নেতাকর্মীদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে কিছু ব্যক্তিকে পরিবারিকভাবে বিএনপি করায় ছাত্রদল কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আপনি কীভাবে এটি দেখছেন?
শেখ আরমান: একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় কখনো তার পারিবারিক ঐতিহ্য বা লিগ্যাসি হতে পারে না। যদিও এটা ঠিক নয়, তবে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একটি পরিবারের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা একটি ব্যক্তির ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ১৮ বছরের পর, তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব হতে হবে।
এটি ভাবা ভুল যে, একজনের বাবা যদি আওয়ামী লীগে থাকে, তবে সে আওয়ামী লীগ সমর্থক হবে, অথবা যদি তার বাবা বিএনপিতে থাকে, তবে সে বিএনপির সমর্থক হবে। উদাহরণস্বরূপ, জামায়াত ইসলামের মূল চিন্তাবিদ মাওলানা মওদুদী ছিলেন, কিন্তু তার ছেলে জামায়াত ইসলামের সদস্য হননি; বরং তিনি জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
এছাড়া, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্রাবণের বাবা একটি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, কিন্তু তার ছেলে দলের প্রতি সেভাবে আনুগত্য দেখাননি। পরিবারের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে একজন ছেলে বা মেয়ে তার নিজের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করবে না, এই নিম্নমানের চিন্তা-ভাবনা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের দলীয়করণ করাও বিএনপির সংকীর্ণ রাজনীতির অংশ। আবার জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকেও আমরা দেখেছি, তাদের শহীদদের তালিকায় ছাত্রদলের ওয়াসিম নেই। এই চিন্তাধারা সংকীর্ণ এবং ক্ষতিকর।
আমার মনে হয়, আমাদের এই ধরনের সংকীর্ণ চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আমাদের সবাইকে সম্মান জানানো উচিত, যারা স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছে। তাদের সবাইকে সম্মান এবং সমর্থন জানানো উচিত, কোনো দলীয়করণ ছাড়াই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসির ভবিষ্যৎ কী?
শেখ আরমান: ডায়ালগ ফর ডেমোক্রেসির ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। তবে আমি এভাবে বলছি না যে, এর মাধ্যমে এখনই গণতন্ত্র পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়তো এখনই গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন হবে না, কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিন ধরে একটি জটিল ও সংকীর্ণ অবস্থায় চলছে। আমরা এখনো সংকীর্ণ মনের রাজনীতি থেকে বের হতে পারিনি। তবে, ভবিষ্যতে আমাদের কাজের ক্ষেত্র অনেক বড়।
যতদিন না জেন-জি ক্ষমতায় আসবে, ততদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের ভূমিকা খুব সীমিত থাকবে। রাজনীতিতে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার চিন্তাভাবনা, দলীয়করণ এসব বিষয় থাকবে। তবে, যখন জেন-জি আগামী ২০-৩০ বছর পর ক্ষমতায় যাবে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হবে, তখন রাজনৈতিক সংকীর্ণতা কেটে যাবে এবং গণতন্ত্র আরও সমৃদ্ধ হবে।
ততদিন পর্যন্ত আমাদের কাজ করার অনেক ক্ষেত্র থাকবে, এবং আমরা গণতন্ত্রের প্রসারের জন্য আমাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখব।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি বলছেন, জেন-জি ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। তবে জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করলে সেটাকে সহিষ্ণুতার সাথে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করেনি কেউ কেউ। তাহলে সহনশীলতার জায়গাটুকু কোথায়?
শেখ আরমান: আমি আগেই বলেছি, আমরা এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হয়েছি যেখানে ক্ষমতাবানদের সমালোচনা সহ্য করা হয়নি। আমাদের সংস্কৃতিতে যে ক্ষমতাধরদের প্রতি কোনো ধরণের সমালোচনা বা বিতর্ক মেনে নেওয়া হয় না, এটা একটি দীর্ঘদিনের অভ্যেস। এর সাথে আরও একটি বিষয় জড়িত, যেমন ধরুন, যদি একজন সমন্বয়কের খারাপ কাজ নিয়ে সমালোচনা করা হয়, তার অনুসারীরা মনে করেন যে, তার পক্ষে কথা বললে তাদের সুবিধা হবে, ভবিষ্যতে তার কাছ থেকে উপকৃত হতে পারবে। এই ধরনের ধারণাও পরিবর্তিত হবে, আমি বিশ্বাস করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
শেখ আরমান: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।