Image description
যুগান্তরকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার - দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহজেই ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব * দুদেশের মধ্যে শিগগিরই সরাসরি বিমান চলাচল * সার্কের প্রক্রিয়া রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থাকা উচিত

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম বন্ধুত্ব ও সহযোগিতায় আরও শক্তিশালী বন্ধন আশা করে। তাই আমাদের অবশ্যই সদিচ্ছা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার চেতনায় এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের দুই দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমার সফরকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করার এবং আরও নিয়মিত এবং গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ হিসাবে দেখছি। ঢাকায় রোববার যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মোহাম্মদ হাসান শরীফ।

প্রশ্ন : বহু আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ-পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আয়োজক হিসাবে ঢাকা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

ইসহাক দার : আমাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানানোয় এবং ঢাকায় আমাকে চমৎকার আপ্যায়ন করায় আমি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। ঐতিহাসিক ঢাকা শহর পরিদর্শন করা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের। ঢাকা বেশ প্রাণবন্ত একটি শহর এবং বাংলাদেশি জনগণের অগ্রগতির প্রতীক।

এক দশকেরও বেশি সময় বিরতির পর আমার এই সফর আমাদের ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ করে দিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠুক-এটাই আমার আন্তরিক কামনা।

প্রশ্ন : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আপনার বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী কী ছিল?

ইসহাক দার : এক বছরে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশকিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে, বিশেষ করে উচ্চপর্যায়ের মতবিনিময়, বাণিজ্য, ভ্রমণ এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। আমার সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো সম্পর্কের এই ইতিবাচক ধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে আমি পারস্পরিক স্বার্থের সব পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলো অনুসন্ধান করেছি।

আমার সফরকালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের জন্য ভিসা বাতিলের চুক্তি, দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সমঝোতা স্মারক, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান করপোরেশন এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মধ্যে সমঝোতা স্মারক, ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ অব ট্রেড এবং একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রোগ্রাম (২০২৫-২০২৮)। এই উদ্যোগগুলো উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পৃক্ততা এবং পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই চুক্তিগুলো চূড়ান্ত করা এটাই ইঙ্গিত করে যে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে উভয়পক্ষই তীব্র আগ্রহী।

প্রশ্ন : দীর্ঘ ১৩ বছর পর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতদিন ধরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো ধরনের বাধা ছিল? এখন থেকে কি নিয়মিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হবে?

ইসহাক দার : হ্যাঁ, ১৩ বছর পর আমার এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে, আমি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সামোয়া, জেদ্দা, ইস্তাম্বুল এবং নিউইয়র্কে বিভিন্ন বহুপক্ষীয় অনুষ্ঠানের ফাঁকে দেখা করেছি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এবং কায়রোতে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেছেন। বলা যায় নেতৃত্ব পর্যায়ে যোগাযোগ পুনরায় শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণ পাওয়ার পর আমি ঢাকা সফরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতেও উভয়পক্ষের উচ্চপর্যায়ের সফর অব্যাহত থাকবে।

গত কয়েক বছরে আমাদের সম্পর্কে নির্লিপ্ততার অনেক কারণ ছিল। আমি বিস্তারিত বিবরণে যেতে চাই না। অতীতে ফিরে না গিয়ে, আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত। এই পটভূমিতে আমি আমার সফরকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করার এবং আরও নিয়মিত এবং গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ হিসাবে দেখছি।

প্রশ্ন : বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ খুবই কম। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অব্যবহৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

ইসহাক দার : প্রকৃত সম্ভাবনা অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কম। ২০২৪-২৫ সালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ৮৬৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বাণিজ্য করেছে। এই সংখ্যাটি সহজেই ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা যেতে পারে।

পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেয়। এ বছর পাকিস্তানের ১৬টি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে। জানুয়ারিতে ফেডারেশন অব পাকিস্তান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) মধ্যে একটি জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সরকার টু সরকার চুক্তির আওতায়, আমরা কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে ৫০ হাজার টন সাদা চাল সরবরাহ করেছি। করাচি ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচলের সংযোগও পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সুতরাং, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময় বৃদ্ধির জন্য মঞ্চ তৈরি হয়ে আছে। দ্বিপক্ষীয় সফর এবং বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলকে আপ্যায়ন করতে পারলে আমরা আনন্দিত হব।

প্রশ্ন : দুই দেশের সাধারণ জনগণ কবে সরাসরি বিমান যোগাযোগের সুবিধা পাবে?

ইসহাক দার : উভয়পক্ষই এই লক্ষ্য অর্জনে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি দুটি বেসরকারি পাকিস্তানি বিমান সংস্থা ‘ফ্লাই জিন্নাহ’ এবং ‘এয়ার সিয়াল’কে দুই দেশের মধ্যে বিমান পরিচালনার অনুমতি দেওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ। আমরা তাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য উৎসাহিত করছি, যাতে শিগগিরই বিমান চলাচল শুরু করা যায়।

প্রশ্ন : এপ্রিলে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কনসালটেশনের (এফএসএলসি) সময় উত্থাপিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের দাবির বিপরীতে পাকিস্তান কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

ইসহাক দার : ১৫ বছর পর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কনসালটেশন আবার চালু করা পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে সম্পাদিত সমঝোতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মনোভাব নিয়ে পরিচালিত হওয়া উচিত।

বর্তমানে উভয় দেশের তরুণ প্রজন্ম বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার আরও শক্তিশালী বন্ধন আশা করে। তাই আমাদের অবশ্যই সদিচ্ছা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার চেতনায় এগিয়ে যেতে হবে, আমাদের দুই দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের সম্পর্কের বিবর্তন পারস্পরিক বিশ্বাস এবং এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর গড়ে উঠা উচিত যা অতীতকে ছাড়িয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত ভবিষ্যতে উভয়পক্ষই টেকসই সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এবং একটি অনুকূল দ্বিপক্ষীয় পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে একে অপরের উদ্বেগের সমাধান করতে সক্ষম হবে।

প্রশ্ন : সার্ককে একটি সচল আঞ্চলিক সংস্থা হিসাবে কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তান কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

ইসহাক দার : সৌভাগ্যবশত সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয়েরই মতামতের মিল রয়েছে। উভয়পক্ষই একমত যে সার্কের পুনঃসক্রিয়করণ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২শ কোটি মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। পাকিস্তান পৃথকভাবে আঞ্চলিক সহযোগিতায় একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে বাংলাদেশের অতীত নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেছে। আমরা আরও বিশ্বাস করি সার্কের প্রক্রিয়া রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থাকা উচিত।

প্রশ্ন : ফিলিস্তিনের জনগণ প্রতিদিন ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে। আমরা ওআইসি বা ইসলামী উম্মাহর পক্ষ থেকে কোনো সক্রিয় ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি না। পাকিস্তান কি এখানে ভূমিকা রাখতে পারে?

ইসহাক দার : নিঃসন্দেহে আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের দুর্দশা শুধু একটি মানবিক ট্র্যাজেডিই নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি নৈতিক পরীক্ষাও।

পাকিস্তান সব সময় ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। আমরা আল-কুদস আল-শরিফকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন, কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিকভাবে আহ্বান জানিয়ে আসছি। আমরা ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর চলমান নৃশংসতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ওআইসি এবং মানবাধিকার কাউন্সিলসহ প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে আমাদের আওয়াজ তুলেছি।

ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে। পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি এবং অবাধ মানবিক সহায়তার জন্য ওআইসি সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করে আসছে। আমরা ওআইসির ভেতরে-বাইরে একই মনোভাবসম্পন্ন দেশগুলোর সঙ্গে সহিংসতা বন্ধে এবং ফিলিস্তিনি প্রশ্নের ন্যায্য ও স্থায়ী সমাধানে চাপ দেওয়ার জন্য কাজ কাজ করতে প্রস্তুত।

প্রশ্ন : আপনি আর কোনো বিষয় বলতে চান?

ইসহাক দার : আমি জোর দিয়ে এটাই বলব, পাকিস্তান পারস্পরিক স্বার্থের সব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের জন্য প্রস্তুত। অব্যাহত সম্পৃক্ততা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, উভয়পক্ষই একটি ফলপ্রসূ এবং স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে যা শান্তি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। আমি পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একই পরিবারের সদস্য হিসাবে দেখি। তাই এই সম্পর্ক ভ্রাতৃত্ব এবং সৌহার্দের অনুভূতির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত।