
আমাদের সময় : দীর্ঘ সময় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। আপনিও সরকারের একজন অংশ। বিগত এক বছরে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহফুজ আলম : দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদকে সরাতে পেরেছি। এখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রথম দিকে তো সবকিছু বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। জায়গায় জায়গায় ডাকাতিসহ নানা অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এখন তো সেটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এটা সরকারের প্রথম সাফল্য। দ্বিতীয়ত, দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের যে নাভিশ্বাস, সেটাও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। আগে যেমন হতো, মৌসুমের বাইরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে যেত, এখন সেটা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে। আরেকটি সফলতা হলো, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো আছে। এই সেক্টর তো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। এখন সেটাও অনেকটা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষ অনেক বেশি দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছে। আন্দোলনের পর আন্দোলন। এর কারণ মানুষের আগে কথা বলার অধিকার ছিল না। এখন তারা সে অধিকার ফিরে পেয়েছে। তাদের সুবর্ণ সময় এখন দাবি-দাওয়া আদায়েরÑ এমনটি ভাবছেন তারা। এসব আন্দোলন সরকার আন্তরিকভাবে দেখেছে। তবে শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, যেটা দুঃখজনক। সরকারের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের নাগালের মধ্যে আনা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা আগের সরকারের তল্পিবাহক ছিল, যারা নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল; তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দাগি নেতাদেরও ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সুতরাং, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা সব ক্ষেত্রেই সরকার সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
ব্যর্থতার কথা বলতে গেলে সরকার একটা জায়গায় ব্যর্থ; সেটি হচ্ছে- ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপ করা যায়নি। এখনও রাষ্ট্রের নানা অংশে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবশেষ আছে। আন্দোলনের পলিটিক্যাল স্টেকহোল্ডারদেরও পরবর্তীতে অবহেলা রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা ঐকান্তিক চেষ্টা করলে এই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার স্থায়ী বিলুপ্তিও করতে পারব।
আমাদের সময় : আপনারা সরকারে আছেন। এখনও কিন্তু আগের সরকারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সিস্টেমের খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। এসব বিষয়ে ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর দায় কেন থাকবে?
মাহফুজ আলম : বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটা দীর্ঘ সংস্কৃতির অংশ। প্রশাসনকে আগের সরকার এভাবেই ব্যবহার করেছে। সেই সংস্কৃতি থেকে তারা বের হতে পারছে না। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এ জন্য পুরো প্রশাসন, বিচারব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। পুলিশ সংস্কারের একটা প্রস্তাবনা ছিল আমাদের। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন চাওয়া হয়েছে। সবার সমর্থন পেলে আমরা এসব সংস্কার করতে পারতাম। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও আছে। সুতরাং, এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
আমাদের সময় : সংস্কার তো আসলে দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। এখন বলা হচ্ছেÑ সংস্কারকে নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মাহফুজ আলম : ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে, সংস্কার কমিশন কাজ করছে। সবগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের মধ্যদিয়ে সংস্কারের চেষ্টা চলছে। একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তারা এভাবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বসে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। নিরপেক্ষতার ভূমিকায় রাজনৈতিক দলীয় সরকারের পক্ষে শতভাগ নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়। আর নির্বাচনের সময়সীমা এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে।
আমাদের সময় : ‘জুলাই ফাউন্ডেশন’ গঠিত হয়েছে জুলাই শহীদদের পরিবারকে সহযোগিতা করতে আর আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে। সেই কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। অথচ সরকারের প্রথম প্রায়োরিটি এটা হওয়া উচিত ছিল।
মাহফুজ আলম : অবশ্যই সরকারের ফার্স্ট প্রায়োরিটি এটা ছিল। সরকার এ লক্ষ্যে কাজ অব্যাহত রেখেছে। জুলাই ফাউন্ডেশন ছাড়াও জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর গঠন করা হয়েছে। আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই শহীদের তালিকা প্রস্তুত করতে পেরেছি, এটা তো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনন্য উদাহরণ। কতজন খুন হয়েছে, কারও লাশ গায়েব করা হয়েছে, তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। বেওয়ারিশ লাশও কম নয়। এগুলোর মধ্যেও একটি তালিকা চূড়ান্ত করা এবং সবার সহযোগিতা নিশ্চিত করতে পারাটা আসলে অনেক বড় কাজ আমি মনে করি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যতগুলো ম্যাসাকার হয়েছে, এটা সবচেয়ে বড়। আমি মনে করি, এটি আসলে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সামনে আরও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এই কাজগুলো সম্পন্ন হবে। তবে আমাদের আন্তরিকতা ও কর্মতৎপরতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ নেই।
আমাদের সময় : গণ-অভ্যুত্থানের সরকাকে আপনি অনেক সময় ‘বিপ্লবী সরকার’ বলেছেন। আসলে এটা কি গণ-অভ্যুত্থানের সরকার, নাকি বিপ্লবের?
মাহফুজ আলম : এটা আসলে ইতিহাস নির্ধারণ করবে। এটা বিপ্লব ছিল না কী অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান হলেও এটা বিপ্লবে রূপান্তর হয়নি কেন? আমরা তো আসলে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছি এবং সেটি সংবিধান মেনেই। বিপ্লবী সরকার হলে সংবিধান স্থগিত করা যেত। তখন সবার অংশগ্রহণে বিপ্লবী সরকার গঠন করে নতুন করে সংবিধান রচনার সুযোগ ছিল। অভ্যুত্থান-পরবর্তী কয়েক দিন আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি যে, মানুষের মধ্যে বিপ্লবী মনোভাব বিরাজ করছে। সবাই একটি বিপ্লব ঘটানোর জন্য উন্মুখ। কিন্তু এই বিপ্লবী মনোভাব কাজে লাগানোর মতো সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও নেতৃত্ব ছিল না। ফলে সুযোগ থাকলেও আমরা একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারিনি।
আমাদের সময় : নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেও কিন্তু বিপুল পরিমাণ ছাত্র-জনতা অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সরকার গঠনে কোনো ছাত্র প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। এবার তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি এই সরকারের দায়িত্ব পেয়েছিল। এটা কি জনআকাক্সক্ষার ভিত্তিতেই করা হয়েছে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
মাহফুজ আলম : এটা সে সময়ের মানুষের রিঅ্যাকশন, সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজনদের আলোচনা-পর্যালোচনা লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন। জন-আকাক্সক্ষা তো ছিলÑ অর্ধেক ছাত্র প্রতিনিধি আর অর্ধেক অভিজ্ঞ লোকদের নিয়ে সরকার গঠনের। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নির্দলীয় ছাত্র-জনতাও সেটি চেয়েছেন। আসলে মানুষ মনে করেছে, ছাত্ররাই এই সরকারের নৈতিক ভিত্তি। ছাত্ররা মানুষের ভয়েসকে কনভে ও সাসটেইন করতে পারবে। তাদের সেই আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছি।
আমাদের সময় : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিয়ে শুরু। এরপর জাতীয় নাগরিক কমিটি হয়ে ছাত্ররা গঠন করল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। জুলাইয়ের যোদ্ধাদের একটি অংশকে সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াকে কীভাবে দেখছেন?
মাহফুজ আলম : এটা খুবই পজিটিভ ব্যাপার। এনসিপি ছাড়াও আরও নতুন রাজনৈতিক দল আসতে পারে বাংলাদেশে। তারা যদি পরিবর্তনের রাজনীতি করতে পারে, জনকল্যাণের রাজনীতি করতে পারে, যদি জনপ্রত্যাশাকে কাজে লাগিয়ে জাতির জন্য কাজ করতে পারে, তাহলে তো সেটি খুবই অসাধারণ একটি বিষয় হবে। তরুণরা কী করতে পারে, তা তো আমরা গত বছর জুলাইয়ে দেখেছি। সুতরাং, তাদের মাধ্যমে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে- এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের সময় : আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?
মাহফুজ আলম : আগামীর বাংলাদেশ হোক স্বনির্ভর। তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর। ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার যেন কোনোভাবেই ফিরে আসতে না পারে, তার নিশ্চয়তা দেবে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। মানুষকে বিপদে ফেলার, শোষণ করার রাজনীতি করবে না। রাজনীতি হবে দেশপ্রেমিক সৎ মানুষের প্ল্যাটফর্ম।
আমাদের সময় : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মাহফুজ আলম : আপনাকেও ধন্যবাদ।