Image description

কাজী মারুফুল ইসলাম

কাজী মারুফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ও নীতিবিষয়ক কেন্দ্রের সিনিয়র ফেলো। এর আগে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করার পর তিনি ইউনিভার্সিটি অব বার্গেন, নরওয়ে থেকে এমফিল, ডিএএডি স্কলারশিপসহ জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জার্নালের পর্যালোচনাকারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।

সমকাল: বিসিএস আন্তঃক্যাডার বিশেষত প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে বাকি ২৫ ক্যাডারের চলমান দ্বন্দ্বকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: এ দ্বন্দ্ব দুঃখজনক হলেও অস্বাভাবিক নয়। প্রথম কথা হলো, আমাদের জনপ্রশাসন এসেছে ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্র ধরে। অর্থাৎ এটা স্থানীয়ভাবে বিকশিত কোনো শাসন কাঠামো নয়; পুরো আরোপিত। দ্বিতীয়ত, এরা রাষ্ট্রের কোঅরসিভ বা কর্তৃত্বমূলক যে মেকানিজম আছে সেটা বাস্তবায়ন করে। জনগণের সঙ্গে বরাবরই এদের এক প্রকার বিচ্ছিন্নতা থাকে। এ দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে এরা যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র চালায় তার এক প্রকার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এ কারণে এরা বরাবরই নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, যে সুযোগ-সুবিধার প্রায় পুরোটাই যায় আজকে আমরা যাদের অ্যাডমিন বা প্রশাসন ক্যাডার বলছি, তাদের পকেটে। এখানে মনে রাখতে হবে, আজকে যে ২৫ ক্যাডারের কথা আমরা জানি, এর অধিকাংশই সিভিল সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতার অনেক পরে। ফলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রয়োগ এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার থেকে অন্যরা বরাবরই পিছিয়ে ছিল। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রশাসন ও ২৫ ক্যাডারের মধ্যে দ্বন্দ্ব সব সময় ছিল। মাঝে মাঝে অনুকূল পরিস্থিতি পেলে তা প্রকাশিত হয়। ঠিকমতো সুরাহা না হলে এ দ্বন্দ্ব কিন্তু সামনে আবারও আসবে।

সমকাল: এখন এ দ্বন্দ্ব এত প্রকট হলো কেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: এখন দেশে এক প্রকার রাজনৈতিক শূন্যতা আছে, যা আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তার বৈধতার সংকট কাটাতে যে ভুয়া নির্বাচনগুলো করেছেম সেগুলোর ব্যবস্থাপনায় ছিল পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা। এ জন্য ওই সরকার তাদের বহু ধরনের অন্যায় সুবিধা দিয়েছে। যেমন একজন উপসচিব হলে গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা পান; তার মেইনটেন্যান্স বাবদ মাসে পান ৫০ হাজার টাকা। এই সুবিধা কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অধিকাংশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা পান না। শুধু তাই নয়; বাড়ি কেনা, পদোন্নতি, এমনকি বিদেশে প্রশিক্ষণের বেলায়ও অন্যদের বঞ্চিত করে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডার বিপুল সুবিধা পায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিকে প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে এগুলো হারানোর শঙ্কা কাজ করছে, অন্যদিকে এসব অন্যায় সুবিধার বিরুদ্ধে অন্যরা ক্ষোভ উগরে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাই আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব এখন এতটা প্রকটরূপে প্রকাশিত হলো।

সমকাল: এ দ্বন্দ্বের ফল তো জনগণকে ভোগ করতে হবে।

কাজী মারুফুল ইসলাম: অবশ্যই। ধরা যাক, রেলওয়ে, কৃষি, স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষা– এসব সেবা দেওয়া হয় মাঠ পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা দিয়ে থাকেন। এখন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যদি এসব দ্বন্দ্ব থেকে যায়, তাহলে তার প্রভাব পড়বে মাঠ পর্যায়ে। অতএব চূড়ান্ত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ। ওই যে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, প্রাণ যায় উলুখাগড়ার; তেমনি সেবাবঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ।

সমকাল: আপনি আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বকে বিগত সরকারের কিছু হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু অতীতের নির্বাচিত সরকারের সময়ও তো আমরা প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য দেখেছি।

কাজী মারুফুল ইসলাম: এটা সত্য। এ ক্ষেত্রে আমি আন্তনিও গ্রামসির কাছ থেকে ধার করে কিছু কথা বলতে চাই। সেটা হলো, চলতে চলতে রাষ্ট্র এক পর্যায়ে কিছুটা রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আর একজন আমলা জানেন তাঁর মেয়াদ নির্দিষ্ট। দীর্ঘদিন এ কাজ করতে গিয়ে তারা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক মেমোরি বা স্মৃতি অর্জন করেন। যার ফলে তিনি জানেন কোন কাজটা কত সময় নেয়, কীভাবে তা করতে হয় ইত্যাদি। একই সঙ্গে কিছু কারিগরি জ্ঞানও তিনি অর্জন করেন। যেমন একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও তা অনুমোদন প্রক্রিয়া তিনি ভালো জানেন। অন্যদিকে রাজনীতিবিদরা কিন্তু এগুলো জানেন না। উপরন্তু তাদের দূরদৃষ্টির যেমন অভাব থাকে, তেমনি জনগণের প্রতি দায়-দরদও কম। ফলে একজন মন্ত্রীকে তাঁর অধীন আমলার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এখান থেকেই সংশ্লিষ্ট আমলা আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। এটা চলতেই থাকে। এমনকি দেখা গেছে, ভিন্ন আদর্শের দল ক্ষমতায় এলেও কোনো কোনো আমলার পদ একই থাকে। সব মিলিয়ে আমলাতন্ত্রের প্রভাব শুধু গভীর হয় না, অনুভূমিকভাবে বাড়তে থাকে।

সমকাল: জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যে দুটো সুপারিশ নিয়ে এ পরিস্থিতির উদ্ভব, সেগুলো নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? সুপারিশ দুটো নিশ্চয় আপনি জানেন– উপসচিব পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা বর্তমানের ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ করা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের অবসান।

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমাদের জনপ্রশাসনের দুটো ভাগ আছে। একটি হলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়, আরেকটি মাঠ পর্যায়। মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয় বিভিন্ন খাতওয়ারি অধিদপ্তর। এ পর্যায়ে কাজ করেন সংশ্লিষ্ট খাতের বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। আবার নীতিনির্ধারণ হয় মন্ত্রণালয়ে, যেখানে সহকারী সচিব ও তাঁর ওপরের কর্মকর্তারা কাজ করেন। এ স্তরের কর্মকর্তাদের কাজ কিন্তু মূলত ওই নীতিনির্ধারণ কাজে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া। আমরা দেখছি মন্ত্রণালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি সংযোগ আছে বটে, তবে তাদের কাজ ভিন্ন। সহকারী সচিব ও তাঁর ঊর্ধ্বতনদের কাজ হলো মাঠ পর্যায়ের ওই বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপযুক্ত নীতি প্রণয়নে সহায়তা করা। তারা কিন্তু বিশেষজ্ঞ নন। ফলে নীতি প্রণয়নে তাদের পক্ষে বিশেষ ইনপুট বা উপাদান দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে এই সাচিবিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেন। যার ফলস্বরূপ গোটা প্রশাসনে তাদের এক প্রকার আধিপত্য কায়েম হয়। অথচ নীতিনির্ধারণে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করতে পারেন যে কর্মকর্তারা, তাদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই বা সংকুচিত। এ জন্যই উপসচিব ও তার ওপরের পদগুলোয় প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের কর্মকর্তাদের বসতে দেওয়ার দাবিটা বৈজ্ঞানিক। এ স্তরের পদগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেই বরং আরও বাস্তবসম্মত ও কার্যকর নীতি নির্ধারণ সম্ভব হতো।

সমকাল: যেমন–

কাজী মারুফুল ইসলাম: ধরুন একজন প্রকৌশলী, যিনি মাঠ পর্যায়ে কাজ করে বহু ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি কিন্তু তাঁর মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ সাচিবিক পদে থেকে নীতি নির্ধারণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। একজন চিকিৎসকও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ সাচিবিক পদে থেকে অনুরূপ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তরের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের এই সেতুবন্ধ খুব দরকার। খেয়াল করুন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক সাধারণত অত্যন্ত অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসক। বর্তমানে তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে যেতে হলে সরকারি অনুমতি পেতে ধরনা দিতে হয় মন্ত্রণালয়ের তার চেয়ে অনেক জুনিয়র একজন সহকারী সচিবের কাছে, যাঁর এ বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। এ ব্যবস্থা তাই ওই চিকিৎসকের জন্য অপমানকরও বটে; অনেক ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তও আসে না। ফলে দিন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র ও জনগণ।

সমকাল: আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন। সেটা কেমন হতে পারে?

কাজী মারুফুল ইসলাম: এক সময় অ্যাডমিন ক্যাডার সৃষ্টির আগে সহকারী সচিব ও তাঁর ওপরের কর্মকর্তারা মূলত সচিবালয়েই কাজ করতেন। বাইরে তাদের তেমন কাজ ছিল না। হ্যাঁ, ডেপুটি কমিশনার জেলায় কাজ করতেন, কিন্তু তিনি মূলত রেভিনিউ কালেক্টর অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহকারী। একসময় যেহেতু ভূমিই ছিল সরকারের আয়ের প্রধান খাত, তাই ডিসিদের জেলা পর্যায়ে পাঠানো হতো। যখন নির্বাহী ও বিচার বিভাগ একসঙ্গে ছিল তখন তারা কিছু ফৌজদারি বিচারকাজ করতেন। এটা সীমিত পরিসরে এখনও আছে, যেমন নির্বাহী হাকিম মোবাইল কোর্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কিছু বিচারকাজ করেন। আরেকটি কাজ ডিসিরা করেন বলে দাবি করেন, সেটা হলো জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়। বাস্তবে এর প্রয়োজন হয় না। কারণ মাঠ পর্যায়ের প্রতিটি দপ্তর নিজ নিজ লাইন মিনিস্ট্রির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রিপোর্ট করেন জেলা সিভিল সার্জনকে; সিভিল সার্জন রিপোর্ট করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ইত্যাদি। ডিসির আরেকটা কাজ আছে। তা হলো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রটোকল দান। কিন্তু এখন তো ভূমি রাজস্ব খুবই নগণ্য; সমন্বয়ও তেমন করতে হয় না। ডিসির কাজটা তাহলে কী? শুধু প্রটোকল দান। কাজ তিনি এখন করেন, সেটা হলো অন্যদের ওপর খবরদারি। এ কারণেই ডিসিদের ভূমিকা নিয়ে মাঠ পর্যায়ের অন্যান্য সরকারি দপ্তরে ব্যাপক অসন্তোষ চলছে।

সমকাল: আমাদের এখানে এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক। ব্রিটেনে ব্যবস্থাটি কেমন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: ওদের সঙ্গে আমাদের মিলবে না। ওখানে প্রত্যেকের এখতিয়ার (জুরিডিকশন) আলাদা করা আছে। যেমন সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিষয় দেখে স্থানীয় সরকার। পুলিশ আংশিক দেখে; স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারও দেখে। ফলে ওদের সচিবালয়ের আয়তন যেমন ছোট, তেমনি সেখানকার কর্মকর্তাদেরও কাজ হলো মন্ত্রীদের সাচিবিক সহায়তা দান। নীতি ও বিধিবিধান তৈরি তারাই করে। তবে এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ বা বিশেষায়িত কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে।

সমকাল: বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোর কর্মকর্তারা কৃত্যপেশাভিত্তিক জনপ্রশাসনের দাবি করেন। এটাই তো তাহলে প্রয়োজনীয়?

কাজী মারুফুল ইসলাম: হ্যাঁ। এর মানে হলো, বিশেষজ্ঞরা মাঠ পর্যায়ে যে সেবা দিচ্ছেন, এর নীতি তারাই প্রণয়ন করবেন। তবে জনপ্রশাসনকে পুরোপুরি এভাবে সাজানো সম্ভব নয়; হয়তো বাস্তবসম্মতও নয়। কারণ একজন বিশেষজ্ঞ বা বিশেষায়িত শিক্ষাধারী কর্মকর্তা তো শুধু তাঁর বিষয়টা জানেন। অথচ একটি নীতি প্রণয়ন করতে হলে সেখানে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানও লাগতে পারে। তাই টিমওয়ার্কই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন একটি হাসপাতাল বানাতে গেলে শুধু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞই কাজটি করতে পারবেন না। সেখানে পরিবেশের বিষয়ও আছে। অতএব, পরিবেশ বিষয়ে জানেন এমন কর্মকর্তাও লাগবে। এ রকম আরও বিষয়ের কর্মকর্তা থাকতে হবে।

সমকাল: আপনি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের কথা বলছেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: এগ্জাক্টলি। এটা হতে পারে সিনিয়র সার্ভিস পুল ধরনের কিছু। একসময় আমাদের এখানে এটা ছিল সিনিয়র সার্ভিস পুল নামে। এ ব্যবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে সবাই উপসচিব ও তার ওপরের পদে সুযোগ পেতেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় এটা চালু হয়। সম্ভবত এরশাদের শেষ দিকে বাতিল হয়। তখন থেকে এ পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত। বলে রাখা দরকার, প্রতিযোগিতায় ভালো করতেন বলে সিনিয়র সার্ভিস পুলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই বেশি সুযোগ পেতেন; তবে সব সার্ভিসের কর্মকর্তাই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেতেন। আমি মনে করি, এটা এখনও চালু করা যায়। কারণ এ পর্যায়ে কোটা পদ্ধতি একেবারেই ভালো নয়। হয়তো অনেকেই আগ্রহী হবেন না, তবুও ডাক্তার, কৃষিবিদ, শিক্ষকদের মতো বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি পুল হতে পারে। তবে পরীক্ষাটা হতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।

সমকাল: এখন যে জনপ্রশাসনের দুই পক্ষ মুখোমুখি, তাদের আলোচনায় কি আপনি এমন কোনো সমাধান দেখতে পান?

কাজী মারুফুল ইসলাম: দুর্ভাগ্যবশত উভয় পক্ষই নিয়ম-নীতি ভেঙে সমাবেশ-বিক্ষোভ করছে, যা চাকরিবিধিমতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো পক্ষই গঠনমূলক সমাধানের প্রস্তাব করছে না। উভয়েই নিজস্ব সংকীর্ণ স্বার্থকে কেন্দ্র করে কথা বলছে। কে কার চেয়ে কত বেশি মেধাবী– এমন আলোচনা চলছে। অথচ যিনি প্রশাসন ক্যাডারে আছেন, তাঁরই সহপাঠী হয়তো স্বাস্থ্য, শিক্ষা ক্যাডারে। প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে দক্ষ ও মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। আমলাতন্ত্র আমাদের লাগবেই। আবার নীতিনির্ধারণে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অনুপস্থিতিরও কোনো অবকাশ নেই। আলোচনাটা হওয়া উচিত– কীভাবে জনপ্রশাসনকে সাজালে তা রাষ্ট্রের জন্য উত্তম হতে পারে; জনগণ সেরা সেবাটা পেতে পারে। সেটা হচ্ছে না বললেই চলে।

সমকাল: সংস্কার কমিশনের সুপারিশই বা কীভাবে কার্যকর হবে এ অবস্থায়?

কাজী মারুফুল ইসলাম: দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পরপর অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিশনসহ আজ পর্যন্ত প্রশাসনিক সংস্কার-সংক্রান্ত কোনো কমিটি বা কমিশনেরই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো, বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বা নীতি যারা প্রণয়ন করবেন তারা হলেন প্রশাসনের কর্মকর্তা। ফলে যে কোনো সংস্কার সুপারিশ প্রথমেই আমলাতন্ত্রের বিরোধিতার মুখে পড়ে। বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক সরকার ছাড়া এ অচলায়তন ভাঙা সম্ভব বলে মনে হয় না। আর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনই বা কেন তারা কী সুপারিশ করতে যাচ্ছে তা চূড়ান্ত করার আগেই প্রকাশ করল? তাদের দায়িত্ব ছিল অংশীজন হিসেবে সব ক্যাডারের বক্তব্য শোনা; কোনো মন্তব্য করা নয়। কৌশলগতভাবে এটা তাদের ভুল বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে এটাও বলতে চাই, সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার আগে তা প্রকাশ করার পেছনে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। তবে আমি বিশ্বাস করি, কমিশন এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে– তারা প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডারকে আস্থায় নিয়েই কাজটি শেষ করবে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আসা দীর্ঘমেয়াদি বাধা মোকাবিলা করে তা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিতে হবে।

সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ।

কাজী মারুফুল ইসলাম: সমকালকেও ধন্যবাদ।