
দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট ও অর্থ পাচারে জড়িত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা কম অপরাধী, তাদের সঙ্গে সমঝোতার চিন্তা করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে পাচারকারীদের সঙ্গে সমঝোতার মূল উদ্দেশ্য হলো টাকা উদ্ধার করা, শাস্তি নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। একই সঙ্গে পাঁচ ইসলামী ব্যাংক মিলে নতুন নামে আলাদা ব্যাংক, লুটপাট হওয়া ১৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তির পরিকল্পনা এবং আর্থিক খাতের সংকট নিরসনে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কালবেলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শেখ হারুন ও নিজস্ব প্রতিবেদক এ জেড ভূঁইয়া আনাস
ব্যাংক খাতের লুটপাট থামাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জরুরি বলে অনেকেই দাবি করছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ আছে কি না?
আহসান এইচ মনসুর: ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতকে আরও ভালোভাবে রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের উদ্যোগ আমরা নিচ্ছি। এ বিষয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি এবং প্রধান উপদেষ্টা আমাদের প্রস্তাব আনতে বলেছেন। তিনি নিজেই চান, তার মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে যেতে। আমরা মনে করি—এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশ ব্যাংককে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে আইনগতভাবে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নেতৃত্ব নির্বাচন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে যিনি আসবেন, তাকে যেন স্বচ্ছ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাই করা হয়। শুধু ব্যক্তিগত পছন্দ বা রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। একটি ভালো প্রতিষ্ঠানেও যদি ভুল ব্যক্তি নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান এগোতে পারে না। তাই এমন নেতৃত্ব দরকার যিনি বিতর্কমুক্ত, দক্ষ এবং আন্তরিকভাবে দেশের আর্থিক খাতকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারবেন। যিনি প্রকৃত অর্থে ব্যাংকিং খাতের ‘গার্ডিয়ান’ হিসেবে কাজ করবেন। এমন ব্যক্তিরা অনেক সময় নিজেরা আসতে চান না। তাই এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে যোগ্য ও বিশ্বস্ত মানুষকে খুঁজে, ডেকে এনে এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসানো যায়। আমাদের মধ্যে সেই মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে—এটাই আমাদের লক্ষ্য।
কালবেলা: সার্বিকভাবে আপনার দায়িত্ব পালনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন? কোনো চাপ আছে কি না?
আহসান এইচ মনসুর: বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার ওপর কোনো চাপ নেই। আমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আমার স্বায়ত্তশাসন থাকুক বা না থাকুক, আমি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মতোই কাজ করছি। সরকার আমাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিচ্ছে। এ পরিবেশটাই বজায় রাখা খুবই জরুরি। আমরা চাই ভবিষ্যতেও এই স্বাধীন পরিবেশ যেন অব্যাহত থাকে। রেগুলেটরকে তার কাজমতো দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া উচিত। আমাদের দেখতে হবে, সে ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। যদি কাজ ঠিকমতো না করে, তাহলে তাকে দায়বদ্ধ করতে হবে। আর যদি রেগুলেটর ভালোভাবে কাজ করে, তখন সরকারকে তাকে সহযোগিতা করতে হবে।
কালবেলা: পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে যৌথ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। এর কার্যক্রম কতদূর এগিয়েছে এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনাতে আপনার পদক্ষেপগুলো কী?
আহসান এইচ মনসুর: আমরা এখন অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। এজন্য একটি জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম (জেআইটি) গঠন করা হয়েছে, যারা বড় বড় দুর্নীতির মামলার তদন্ত করছে। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তো কিছু করা সম্ভব নয়, আদালতে উপস্থাপনযোগ্য প্রমাণ লাগবে। তাই তারা ব্যাংকসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে, সম্পদের অবস্থানও শনাক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে থাকা অনেক অবৈধ সম্পদ এরই মধ্যে জব্দ (অ্যাটাচড) করা হয়েছে। বিদেশেও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে— দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে, যথাযথ প্রমাণসহ আদালতে মামলা করা, যাতে এসব সম্পদ আইনগতভাবে জব্দ করা যায়। যদি প্রমাণিত হয় যে, অর্থটা ব্যাংকের, তাহলে তা ব্যাংকে ফেরত যাবে। আর যদি তা সরকারি অর্থ হয়, তাহলে যাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। সবকিছু আইনি ও প্রক্রিয়াগত নিয়মেই হবে। বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আমরা এবার ভিন্নভাবে কাজ করছি। অতীতে বিদেশি সম্পদ ফেরত আনার উদাহরণ ছিল না। তবে এবার বিদেশি সংস্থাগুলো আমাদের সহায়তা করছে, টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে। তাদের লোকজন বাংলাদেশে এসেছে এবং ছয় মাস ধরে আমাদের তদন্ত কাজ পর্যবেক্ষণ করবে, যেন আন্তর্জাতিক মান বজায় থাকে। এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, তাই এর ধারাবাহিকতা জরুরি। বর্তমান সরকার যতদূর সম্ভব এগিয়ে নেবে। ভবিষ্যৎ সরকারকে তা ধরে রাখতে হবে, না হলে সফলতা আসবে না। বিদেশি সম্পদ ফেরত আনতে আমাদের আইনি লড়াই করতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক ল ফার্ম নিয়োগের প্রয়োজন। কিছু ল ফার্ম আছে যারা নিজেরাই অর্থ দিয়ে মামলা চালায়, জিতলে লাভ ভাগ করে, না জিতলে কেউই কিছু পায় না। আমরা এরকম অনেক ল ফার্মের সাড়া পেয়েছি। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে এখন আমরা আছি।
কালবেলা: পাচারকারীদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আপনি একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন। এটা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
আহসান এইচ মনসুর: আমরা যখন মামলার কথা বলি, তখন মূলত দুটি ধরনের মামলা দেখা যায়—একটা সিভিল, আরেকটা ক্রিমিনাল। অপরাধমূলক বা ক্রিমিনাল মামলায় সাধারণত সমঝোতার সুযোগ থাকে না। এসব মামলায় অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য। সেখানে টাকা আদায় হলো কি না, সেটা প্রাধান্য পায় না। কিন্তু কেউ যদি ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে, সেটা অনেক সময় সিভিল মামলার আওতায় পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো টাকা উদ্ধার করা, শাস্তি নয়। এখন যদি আমরা শুধু তাকে শাস্তি দিতে চাই, তাহলে সে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে পারে, আর তাতে টাকাও ফিরে আসবে না। তাই বাস্তবতার নিরিখে আমাদের ভাবতে হবে, যেভাবেই হোক যদি টাকাটা ফেরত আনা যায়, সেটাই হবে বড় অর্জন। এই কারণে বিশ্বব্যাপী আইন ব্যবস্থায় সমঝোতার সুযোগ রাখা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্রে তো প্রায় ৯৮ শতাংশ মামলা কোর্টে না গিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। এমনকি আদালতেও অনেক সময় বিচারক দুই পক্ষকে বলেন, তারা নিজেরা বসে সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করুক। আইনজীবীদের মাধ্যমে এমন সমঝোতা হলে আদালতও সেই নিষ্পত্তিকে গ্রহণ করে। আমাদের লক্ষ্যও ঠিক সেটাই—টাকা উদ্ধার করা। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে সঙ্গে নিয়ে সমঝোতার আলোচনায় যাওয়া হয়নি। সেটা করতে হলে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কার সঙ্গে আলোচনা হবে, কীভাবে হবে—এসব কিছু নির্ধারিত হবে, মামলার আইনি অবস্থান বিবেচনায়। মামলাটি কতটা শক্তিশালী, সেটাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল ভিত্তি হবে। এসব বিষয় নির্ধারণ করা আমার দায়িত্ব নয়, এটা আইনি প্রক্রিয়ার অংশ।
কালবেলা: পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক এক করার ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ব্যাংকগুলো একীভূত হলে কী সুবিধা হবে?
আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আমাদের পরিকল্পনা সুস্পষ্ট। প্রথম ধাপে সরকার এসব ব্যাংক অধিগ্রহণ করবে, এরপর একটি নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সেই ব্যাংকে একীভূত করা হবে। নতুন ব্যাংকটির একটি আলাদা পরিচিতি থাকবে। শুরুতে সব শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করা হবে, তাই নতুন ব্যাংকটিও শরিয়াহভিত্তিকই হবে। পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতা ছিল এই জায়গাতেই—তারা শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক এবং প্রচলিত ব্যাংক একত্র করার চেষ্টা করেছিল। আপেলের সঙ্গে কমলা মেশানো যায় না, তেমনি প্রচলিত ব্যাংকের সঙ্গে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করলে কার্যকর ফলাফল আসবে না। তাই আমরা এই ভুল করছি না। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের সঙ্গে শুধু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকই একীভূত করছি, কারণ তাদের সম্পদ, সেবা ও পরিচালনা কাঠামোয় মিল আছে।
আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে—একীভূত প্রক্রিয়ায় কোনো গ্রাহক যেন সমস্যায় না পড়েন। এক দিনের জন্যও যেন লেনদেন বন্ধ না থাকে। ব্যাংকগুলো যেহেতু সরকার অধিগ্রহণ করছে, তাই গ্রাহকের টাকার নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত থাকবে। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া হবে। এক দিনে সবকিছু মার্জ করা হবে না। প্রতিটি ব্যাংকের সফটওয়্যার সিস্টেম ধীরে ধীরে একীভূত করা হবে। একইভাবে কর্মীদেরও একীভূত করা হবে—কাউকে ছাঁটাই নয়, বরং কর্মক্ষম ও যোগ্য কর্মীদের ধরে রাখাই হবে মূল লক্ষ্য। যেসব স্থানে পাঁচটি ব্যাংকের একাধিক শাখা এক জায়গায় রয়েছে, সেখানে অতিরিক্ত শাখা বন্ধ করা হবে। আর যেখানে কোনো শাখা নেই, সেখানে নতুন শাখা খোলা হবে এবং দক্ষ কর্মীদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে।
আমাদের আরেকটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে—ব্যাংকে অযোগ্য নিয়োগ বন্ধ করা। যাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা ডিপ্লোমা নেই, তাদের রাখা হবে না। এজন্য আমরা একটি মান যাচাই প্রক্রিয়া চালু করেছি। যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন না, তারা চাকরিতে থাকবেন না। পাঁচ বছর ব্যাংকে কাজ করার পরও যদি কেউ পরীক্ষায় পাস না করেন, তাহলে তার থাকার যৌক্তিকতা নেই। আমরা চাই ইসলামী ব্যাংকের মতো একটি শক্তিশালী ব্যাংকের মাধ্যমে একীভূত হয়ে আরও একটি বড় এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যাংক গড়ে উঠুক। এটিই আমাদের লক্ষ্য। নতুন ব্যাংকটি হবে আরও সুশৃঙ্খল, টেকসই এবং জনগণের আস্থার প্রতীক।
কালবেলা: ইতোপূর্বে একাধিকবার ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন বাধা এসেছে। এবার আপনার কতটা সফল হবে বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংক একীভূতকরণে আমাদের সামনে একটি সফল উদাহরণ রয়েছে—ইবিএল (Eastern Bank Limited)। এটি আমাদের জন্য একটি সাফল্যের গল্প। তবে আগের সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে যেভাবে জোর করে কিছু ব্যাংক একীভূত করার চেষ্টা হয়েছিল, তা ছিল আইনবহির্ভূত এবং ব্যাংক খাতের বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তখন এ বিষয়ে যথাযথ আইনই ছিল না। বর্তমানে আমরা প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করে নিয়েছি। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে একীভূতকরণে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ছিল না। এখন আমরা সেই ক্ষমতা নিশ্চিত করেছি। পাশাপাশি ‘ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট’, ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আইন’ প্রণয়ন করছি—যার মাধ্যমে খারাপ সম্পদগুলো আলাদা করে ব্যবস্থাপনা করা যাবে। আমরা এ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছি। আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ চলছে। লন্ডন থেকে ডেলয়েট আমাদের ইন-হাউস সাপোর্ট দেবে। কারণ, এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল—এটা সাধারণ কোনো প্রক্রিয়া নয়।
কালবেলা: গত বছরের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৯ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি না?
আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশ ব্যাংকের দুটি প্রধান দায়িত্ব হলো—এক, মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ; দুই, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, যাতে কোনো আর্থিক সংকট না ঘটে। এই লক্ষ্যে আমরা এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল করেছি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এতে জনগণের আস্থা ফিরে এসেছে। এখন লক্ষ্য হচ্ছে, এ আস্থা ধরে রাখা এবং রিজার্ভ আরও বাড়ানো। মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশের নিচে নামানো গেলে সাধারণ মানুষের আস্থা আরও দৃঢ় হবে। বর্তমানে সুদের হার কিছুটা বেশি, তবে মূল্যস্ফীতি কমে এলে আমরা ধাপে ধাপে নীতিগত সুদের হারও কমিয়ে আনব। এজন্য আরও ২-৩ মাস সময় প্রয়োজন। এখানে ধৈর্য জরুরি—যেটি ধ্বংস হতে ১৫ বছর লেগেছে, সেটি পুনর্গঠনে অন্তত ১৫ মাস সময় দিতে হবে। আমরা মনে করি, যদি এই পথে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় আশ্বাস। লন্ডনে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকের পর দেশে একটি স্বস্তির আবহ তৈরি হয়েছে, যা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়তে সহায়ক। বিনিয়োগকারীরা ঝামেলাহীন ও পূর্বানুমানযোগ্য পরিবেশ চান। উন্নত দেশগুলোতে সরকার বদলালেও অর্থনীতির গতিপথে বড় কোনো বিঘ্ন ঘটে না। আমাদের এখানেও এমন একটি সম্মানজনক ও সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। সরকারে এলেই সবকিছু নিজের করে নেওয়ার মানসিকতা বদলাতে হবে। বিরোধীদের সম্মান দিয়ে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আমরা সম্মিলিতভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে পারব।
কালবেলা: গত সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংক কর্মকর্তা এবং পরিচালকরা মিলেমিশে ব্যাংক লুট করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার চিন্তা আছে কি না?
আহসান এইচ মনসুর: আমি সামনে তাকাতে এসেছি, অতীত ঘেঁটে বসে থাকার জন্য নয়। দুর্নীতির তদন্ত ও শাস্তির জন্য দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি ও অন্যান্য সংস্থা রয়েছে—তাদেরই এসব তদন্তের দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো তদন্তকারী সংস্থা নয়, সুতরাং আমাদের কাছে তদন্তের প্রত্যাশা করাটা বাস্তবসম্মত নয়। তবে দুদক বা অন্যান্য সংস্থা যদি কোনো দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য বা সহযোগিতা চায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্যই সহযোগিতা করবে। অতীতে যখন দুর্নীতির কোনো প্রমাণ সামনে এসেছে, তখন আমরা কেবল কর্মকর্তাকেই নয়, সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেও জরিমানা করেছি। কারণ, ব্যাংকও দায় এড়াতে পারে না—জনগণ তো ব্যাংকের ওপর ভরসা করে টাকা জমা দেয়, কোনো ব্যক্তি-কর্মকর্তার ওপর নয়। এখানেই একটি বড় সমস্যা আছে—বর্তমান আইনে জরিমানার সর্বোচ্চ সীমা মাত্র ৫ লাখ টাকা। এটা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধের তুলনায় অপ্রতুল। তাই আমরা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী জরিমানার পরিমাণ কোটি টাকা পর্যন্ত করা যায়। আমাদের উদ্দেশ্য কারও পেছনে লেগে থাকা নয়, বরং ভবিষ্যতে এমন দুর্নীতি যাতে আর না ঘটে, সেটি নিশ্চিত করা। ব্যাংক খাতে জবাবদিহি ও শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা এ ধরনের আইনি সংস্কারকে গুরুত্ব দিচ্ছি।
কালবেলা: আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। বেশিরভাগই এখন মৃত প্রায়। এ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কী ভাবছেন?
আহসান এইচ মনসুর: আমরা এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাই-বাছাই করেছি। দেখেছি ১৫ থেকে ১৬টি প্রতিষ্ঠান একেবারে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছে। এদের ৯৯ শতাংশ ঋণ খেলাপি। আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, তোমাদের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না। আশা করি এ সপ্তাহের মধ্যে তাদের কাছ থেকে জবাব পাব। এরপর আমরা তাদের সঙ্গে বসে একটা পরিকল্পনা করব, কীভাবে এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে সামলানো যায়—হয় তাদের লিকুইডেশন করতে হবে, নয়তো অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি আমরা ভাবছি কীভাবে ডিপোজিটরদের ক্ষতি কমানো যায়। আমরা ডিপোজিটরদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যদিও এখানে সরকার আইনি দায়বদ্ধ নয়, কারণ তারা নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছে এবং সরকারের কোনো গ্যারান্টি নেই। তবুও আমরা মনে করি সরকারের একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। লিকুইডেশন অবশ্যই একটি বিকল্প। অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হতে পারে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান মার্জ করে বড় সুবিধা পাওয়া যাবে না। আসলে আমাদের দেশে এত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনও ছিল না। ৩৫টি থাকার দরকার ছিল না, ১৫টি না থাকলেও কোনো ব্যাপার হতো না। বাকি ২৪ কিংবা ২০টি প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চললেই কাজ হবে। আমাদের কাছে এত প্রতিষ্ঠান ম্যানেজ করার যথাযথ দক্ষতা নেই। ভালো ম্যানেজমেন্ট, এমডি, ডিএমডি বা পরিচালক হিসেবে ভালো লোক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আজকে আমাকে বলা হয়েছে যে, ৮ থেকে ১০টি জায়গায় কোথায় ভালো ডাইরেক্টর দেব, সেটা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাকে বুঝদার হয়ে কাজ করতে হবে। যদি ভালো টপ ম্যানেজমেন্ট দিতে না পারি, তাহলে একটা ব্যাংক চালানো সম্ভব নয়।
কালবেলা: নগদের মালিকানা নিয়ে অনেক ঝামেলা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে কী অবস্থা। নগদ নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
আহসান এইচ মনসুর: নগদ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং আমার চিন্তাভাবনা একই রকম। নগদকে কিছু অসাধু ব্যক্তির হাত থেকে বের করে আনার প্রয়োজন। তারা এখানে একটা বড় চক্র তৈরি করেছে, যারা প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আমরা এরই মধ্যে অডিট করেছি। আমাদের ইন্টার্নাল অডিটে দেখা গেছে, প্রায় ৬৩০ কোটি টাকা তারা অবৈধভাবে তৈরি করেছে। সরকারের যে অনুদান আছে, যা দরিদ্রদের জন্য দেওয়া হয়, সেই টাকা থেকে তারা প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখন আমরা সাময়িকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে নগদ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। আমাদের এটা চালানোর কোনো আগ্রহ বা দরকার নেই, এটা মূলত আমাদের লক্ষ্যও নয়। পোস্ট অফিস যাদের হাতে রাখা হয়েছে, তাদেরও এই ব্যবসা চালানোর ক্ষমতা নেই। আমাদের উদ্দেশ্য খুব দ্রুত একটি শক্তিশালী কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিয়ে এসে নগদ তাদের হাতে তুলে দেওয়া, যারা প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ এমন একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, যার পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকবে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাও থাকবে, যাতে তারা নগদকে বিকাশের সমতুল্য এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যেতে পারে। এখন আমরা শুধু নগদের চলমান অবস্থা ধরে রাখছি, যাতে এটি ভেঙে না পড়ে। যদি এটি ভেঙে পড়ে, তাহলে গ্রাহক সেবায় সমস্যা হবে এবং বিকাশের একাধিপত্য সৃষ্টি হবে। বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি নগদের লেনদেন দিন দিন বাড়ছে।
কালবেলা: আপনার মেয়ের বিদেশে ফ্ল্যাট ক্রয় ও বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
আহসান এইচ মনসুর: আমার তো চিন্তার কিছু নেই। আমি আমার পথেই আছি। যদি কেউ প্রমাণ করতে পারে যে, আমি ৫০ কোটি বা ৫০ টাকা আমার মেয়েকে দিয়েছি, সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তাদের। আমার কথা হলো, যারা অভিযোগ নিয়ে আসবে, তাদেরই প্রমাণ দেখানোর দায়িত্ব আছে। এসব অভিযোগ আসলে দুরভিসন্ধিমূলক। আপনি দেখবেন, যখনই আমি লন্ডনে যাই, ঠিক তখনই কোনো না কোনো অভিযোগ সামনে আসে। এ সময়টাও খুবই সন্দেহজনক। আর আমার মেয়ে যাতে ভালো থাকে—সেটাই আমার প্রধান চিন্তা। সে যেন নিজের মতো ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারে, সেটাই আমি চাই। সে একজন স্বাধীন নারী, প্রায় ৪০ বছর বয়সী আমেরিকান নাগরিক। তাকে আমি কী বলব? বলারও কিছু নেই, করারও নেই। সে নিজের মতো স্বাধীনভাবে চলবে। তার একটি পালক মেয়ে এবং দুটি নিজের মেয়ে আছে। আমি চাই তারা আরও ভালোভাবে জীবনযাপন করুক, নিজের শ্রমে রোজগার করুক। সে ৫০ কোটি টাকার বাড়িতে থাকুক বা ৫০০ কোটি টাকার বাড়িতে থাকুক, সেটা তার ব্যাপার—আমার কিছু বলার নেই। আমার সম্পদ কোথায়? আমার যুক্তরাষ্ট্রে কেন সম্পদ থাকতে পারবে না? সেখানে তো আমার সম্পদ ছিল। এখন নেই। আমার সব সম্পদ আমার গ্রামের বাড়িতেই আছে। এটাই সত্য।
কালবেলা: জুনের ২৩ তারিখে আইএমএফের বৈঠক, সেখানে দুই কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
আহসান এইচ মনসুর: আইএমএফের টাকা আমি চাইলে ছয় মাস আগেই পেতাম; কিন্তু আমি স্পষ্ট জানিয়েছি, আইএমএফের টাকা পাওয়ার জন্য আমি কোনো চাপে থাকব না, যা বলা হচ্ছে সবই আমি মানি না। বিশেষ করে এক্সচেঞ্জ রেট ছয় মাস আগে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে ছেড়ে দিতে আমি একমত ছিলাম না। আমি বলেছি, আমার তোমাদের টাকার দরকার নেই, আমার নিজস্ব টাকায় আমি চলতে পারব, যদিও সময় লাগবে। আমি চাই এক্সচেঞ্জ রেট মার্কেটভিত্তিক হোক, আইএমএফও এটা চায়। পার্থক্য হলো, আমি এটা সময়মতো করব, আর তারা চায় এখনই করব। আমি বলেছি, যখন আমি প্রস্তুত হব, তখন করব। আমি এরই মধ্যে সেটা করে ফেলেছি। এখন তারা বোর্ডে যাবে, আমরা আশা করি টাকা পাব। টাকা পাই বা না পাই, আমার কিছু আসে যায় না, আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীল, কোনো সংকট নেই। আমি আইএমএফকে বলেছি, তাদের টাকা না পেলে চলবে, আমাদের বাজেটের জন্য হয়তো দরকার আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা রিজার্ভের জন্য আইএমএফের টাকার দরকার নেই। কিন্তু আমরা রিফর্ম চালিয়ে যাব। আমি আইএমএফের কাছ থেকে পলিসি সাপোর্ট ও কারিগরি সাহায্য চাই। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, এতে আমাদের আস্থা বাড়বে। আমাদের সম্পর্ক ও সহযোগিতা থাকবে। টাকা আসবে বা না আসবে, তার ওপর নির্ভর করব না। আগের সরকার তিন কিস্তি পেয়েছিল, কিন্তু টাকা কোথাও যায়নি, রিজার্ভ থেকে টাকা বের হয়ে গিয়েছিল। তাই আইএমএফ থাকুক বা না থাকুক, আমাদের নিজস্ব নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। আমি যদি আইএমএফের সময়মতো ছয় মাস আগে এক্সচেঞ্জ রেট পরিবর্তন করতাম, তাহলে রেট ১৫০ থেকে ১৭০ টাকার মতো হয়ে যেত। তখন আমাকে কে রক্ষা করত? আমি পাকিস্তানের পথ অনুসরণ করিনি কারণ আমার কাছে রিজার্ভে কিছু সুরক্ষা ছিল, আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম সেটা বাড়াতে পারব। পার্থক্য এখানেই।
কালবেলা: দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা কী?
আহসান এইচ মনসুর: আমাদের ভাবতে হবে—কী হতে পারত, আর এখন আমরা কোথায় আছি। আমরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো সংকটে পড়তে পারতাম। পাকিস্তানে একসময় এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ১৪০, সংকটের সময় তা বেড়ে ৩৮০ পর্যন্ত গিয়েছিল, এখন ২৮০-তে আছে। শ্রীলঙ্কার অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল—জাতীয় আয় অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল, রিজার্ভ বলতে কিছু ছিল না, টাকার মানও ভেঙে পড়েছিল। আমরাও সেই দিকেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু সময়মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে। আমি ১৪ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক আর এক ডলারও বিক্রি করেনি, অথচ এর আগে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছিল। প্রতি মাসে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বেরিয়ে যাচ্ছিল, যা অর্থনীতির জন্য ছিল মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা ডলার বিক্রি বন্ধ করেছি, পাচারও বন্ধ হয়েছে। যারা আগে পাচার করত, তারা এখন আর সক্রিয় নেই। ফলে রেমিট্যান্স বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। শুধু রেমিট্যান্সই নয়, রপ্তানিও বেড়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। মোট ১২ বিলিয়ন ডলার বেশি আয় হয়েছে, যার বড় অংশ দিয়ে সরকার দেনা পরিশোধ করেছে। এত কিছু করেও রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার, এখন প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আশা করছি আইএমএফের অর্থ পেলে জুনের শেষ নাগাদ রিজার্ভ ২৮-২৯ বিলিয়ন ডলারে উঠে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়—নীতিগত দৃঢ়তা, দুর্নীতি রোধ ও সরকারি পরিবর্তনের প্রভাবেই আজ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এসেছে। সামনে সময় লাগবে ঠিকই, তবে আমরা সঠিক পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি।
কালবেলা: আমাদের প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু চলমান মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত মূল্যস্ফীতির ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে?
আহসান এইচ মনসুর: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে তেলের দামে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে যদি আমদানিকৃত পণ্যের ঝুড়ি (ইম্পোর্ট বাস্কেট) বিবেচনায় নেই, তাহলে এর প্রভাব খুব একটা পড়বে না বলেই মনে করছি। কারণ, এ ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলে সাধারণত বিশ্বব্যাপী এক ধরনের মন্দা দেখা দেয়, যার ফলে সামগ্রিক চাহিদা কমে যায়। তখন পণ্যের দামও হ্রাস পায়। আমরা আশাবাদী ছিলাম এবং এখনো আশাবাদী যে চাল, গম, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বিশ্ববাজারে তুলনামূলকভাবে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে, আর বাংলাদেশেও এই দাম এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। গত রোজার আগ থেকে পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি—বরং কিছু ক্ষেত্রে কমেছে। এই প্রবণতা ধরে রাখতে পারলে মূল্যস্ফীতিও অনেক কমে আসবে। যদিও আমরা বলছি না যে, মূল্যস্ফীতি একেবারে শূন্যে নেমে যাবে, তবে আমাদের লক্ষ্য হলো আগামী এক বছরের মধ্যে এটিকে ৫-৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। আগে আমাদের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ, যা এখন নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে। অখাদ্য পণ্যে (যেমন জামাকাপড়, বাসা ভাড়া ইত্যাদি) মূল্যস্ফীতি আগে ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, এখন সেটা ৯ দশমিক ৫ শতাংশে এসেছে। আশা করছি আগস্টের পর থেকে এটি আরও কমবে। আমি আগস্টের কথা বলছি কারণ ওই সময় থেকেই প্রকৃত তথ্য প্রকাশ শুরু হয়েছে। তার আগে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫ থেকে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ; কিন্তু আগস্টে সেটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৫ শতাংশে। কারণ, তখন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত ডেটা প্রকাশ করা হবে। সেই ডাটা অনুযায়ী দেখা গেছে, দাম কিছুটা বেড়েছে এবং সেটারই প্রতিফলন ছিল ওই সময়কার মূল্যস্ফীতিতে। তবে এই দামের প্রভাব, যা প্রায় ২ শতাংশ, আগামী আগস্টের পর থেকে ধীরে ধীরে কেটে যাবে। আমি আশাবাদী, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাদের মূল্যস্ফীতি আরও কমে আসবে এবং অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।