
প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী ফজলুল বারী
স্বৈরাচার এরশাদের দীর্ঘ নয় বছরের শাসন ছাত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে। নব্বইয়ের এ রাজনৈতিক সংকটের মোড় ঘুরিয়ে স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে সহযোগিতা করে মিলিটারি লিডারশিপ। কিন্তু ‘এক-এগারোর’ মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটে আবারো ভূমিকা নেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। আলোচিত এ ঘটনার কারণ এবং প্রভাব নিয়ে এখনো রয়েছে নানামুখী আলোচনা। তবে এর পরের দীর্ঘ দেড় দশক বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের একতরফা শাসনকে গ্রহণ করে নেয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখেন বর্তমান সেনাপ্রধান। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে ফিরে দেখা, বিগত ১৫ বছরে সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা চৌধুরী ফজলুল বারী। যিনি এক-এগারোর শুরুর দিনগুলোয় ডিজিএফআইয়ের ভারপ্রাপ্ত ডিজির দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় তিন বাহিনীর প্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশের সংকট বিবেচনায় ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান দরবার (মিলিটারি টার্ম কনফারেন্স) ডেকেছিলেন। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নুরুদ্দিন খান দরবার ডেকেছিলেন। কিন্তু ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ কেন দরবার ডাকেননি?
জেনারেল মইন কেন সব অফিসার, জেসিও ও সৈনিকদের সঙ্গে তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেননি সেটি তার এখতিয়ার, তিনিই তা বলতে পারবেন। বোধ করি তখনকার পরিস্থিতি অন্য সব সময়ের চেয়ে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। নির্বাচিত সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের পর অবনতিশীল পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হতে থাকে। বিরাজমান ওই পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই তিনি তার অধীন সব জ্যেষ্ঠ অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছেন। এছাড়া সব স্তরের সদস্যদের মতামত জানার জন্য তার বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। নিশ্চয়ই তিনি সবার মতামত জেনেই তার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
এক-এগারোর পর বিগত ১৬ বছর সেনাপ্রধানদের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাই।
সেনাপ্রধানদের নিয়োগ দেয় সরকার। নিশ্চয়ই সরকারের দৃষ্টিতে চৌকসতম অফিসারকেই তারা নিযুক্ত করেছিলেন। পরিতাপের বিষয় হলো জেনারেল মইনকে নিযুক্তির পর হাসিনা সরকার অনেক বিষোদগার করেছেন তার নিয়োগ নিয়ে। তিনিই আবার মইন ইউর সঙ্গে আঁতাত করেন। মইন ইউর পরে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান জেনারেল মুবীন খান। হাসিনা জেনারেল মুবীনের পর একই কোর্সের জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়াকে নিয়োগ দেন।
দেশের সিরিজ বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর একটি হচ্ছে ২০১৪ সালের নির্বাচন। যা তৎকালীন সেনাপ্রধানের নির্বাক সহযোগিতায় ঘটেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে বলা হয় ফ্যাসিজমের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি। এরপর জেনারেল আজিজ ও জেনারেল শফির ভূমিকা সবার জানা। জেনারেল আজিজের নিযুক্তি হয়েছিল নয়টি কোর্সের অনেক চৌকস অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে। যদিও হাসিনা বিএনপি সরকার কর্তৃক কয়েকজনকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল মইনের নিয়োগের কট্টর সমালোচনা করেন।
তা সত্ত্বেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার কেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়াকেই সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছিল?
২০১৪ সালের নির্বাচনে ইকবাল করিম ভূঁইয়া পজিটিভ কিছু করেননি। কার কাছে মুচলেকা দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন? সে সম্পর্কে তিনিই জানাবেন। তখন তো বিরোধী দলগুলো এভাবে নির্বাচন চায়নি। তারা চেয়েছিল কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট। সারা দেশের মানুষ চেয়েছিল কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট হোক। তখন কেন উনি (ইকবাল করিম ভূঁইয়া) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেননি?
সর্বপ্রথম ইকবাল করিম ভূঁইয়াই সেনাবাহিনীকে নতজানু করেছেন। উনি শেখ হাসিনার নির্বাচনকেন্দ্রিক সব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়া সত্ত্বেও এতে ইকবাল করিম ভূঁইয়া সহযোগিতা করায় শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের বাস্তবায়ন ঘটে। যার ফলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে শেখ হাসিনা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
তৎপরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। যার ফলে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরবর্তী এক দশক শাসন করেছে। যেখানে গুম-খুনের ঘটনা ঘটে। এখন তো শুনি উনি (ইকবাল করিম ভূঁইয়া) বলেন আরেকটা ওয়ান-ইলেভেন যেন না হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সময় উনি কোথায় ছিলেন?
ওয়ান-ইলেভেনের সময় সাবেক এ সেনাপ্রধানের ভূমিকা কী ছিল?
সেনাপ্রধানের সব অপারেশনাল আদেশই সিজিএসের (চিফ অব জেনারেল স্টাফ) মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। ২০০৭ সালে যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয় তখন তিনি সিজিএস ছিলেন। উনার কাছে গোয়েন্দা সংস্থা এবং মিলিটারি অপারেশনসও ছিল। সবই তো তার কাছে। সেনাপ্রধান তো চিফ অব আর্মি স্টাফ। আর উনি ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। কোনো অপারেশন করতে হলে তিনি প্ল্যান করে দেবেন।
তো সে সময়ের প্ল্যানগুলো কে করে দিয়েছেন? উনি যে এখন বলেন আরেকটা এক-এগারো হতে দেবেন না, এখনো তো সেনাবাহিনী সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। সেনাবাহিনী সমর্থন না দিলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমন থাকত? পুলিশের কী অবস্থা হয়েছিল? সব কাজেই তো সেনাবাহিনী সমর্থন দিচ্ছে। এটা দেয়াটাই তাদের কর্তব্য।
এক-এগারোর সময় তো আপনি ডিজিএফআইয়ের ভারপ্রাপ্ত ডিজি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ইমার্জেন্সি ঘোষণার সিদ্ধান্তে কীভাবে পৌঁছেছিলেন?
২০০৬ সালের শেষ দিক থেকেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। তখনো বিএনপির নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন। তখন থেকেই বিষয়টি সব সংস্থার পর্যবেক্ষণাধীন থাকে। হাসিনা ঘোষিত লগি-বৈঠার আহ্বানের পর থেকেই মূলত রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে সামাল দেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছিল। আর রাজনৈতিকভাবে সমাধান সম্ভব না হলে আরো দুটি অপশন দেয়া হয়। বলা হয়েছিল সামরিক আইন জারির কথা। তবে সামরিক আইন যেহেতু বর্তমান পৃথিবীতে অগ্রহণযোগ্য একটি বিষয় এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান সামরিক শাসনের ঘোর বিরোধী ছিলেন তাই সংবিধানসম্মতভাবে জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দেয়া হয়। নির্বাচিত সরকারের পদত্যাগের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও একই প্রস্তাব দেয়া হয়। যা মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিবেচনা করে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
সেদিনটি ছিল ১১ জানুয়ারি। ২০০৭ সালের সেদিনটিতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে নির্বাচন উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা হচ্ছিল। সেখানে পিএসও এএফডি জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (যিনি এখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন) এবং ভারপ্রাপ্ত ডিজি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। তিন বাহিনীর প্রধানরা তো ছিলেনই।
‘মাইনাস টু’-এর পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই।
এটি একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা রাজনীতিবিদরাই বলতে পারবেন।
এক-এগারোর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) ক্ষমতায় এল। এর আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের ‘লগি-বৈঠার’ আন্দোলনকে অনেকে বলেন, এক-এগারোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যই সমাবেশকে কেন্দ্র করে এ সংঘাত। এ ধরনের কোনো সংযোগ আছে কি?
লগি-বৈঠা নিতান্তই ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেশের মানুষ হত্যার নিষ্ঠুর এক ঘোষণা। যার ফলে রাস্তায় পিটিয়ে মানুষ খুন করা হয়। চাপাতি দিয়ে মানুষ কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়।
মূলত আইন-শৃঙ্খলার উন্নতির জন্য রাষ্ট্রপতির জারীকৃত জরুরি অবস্থা ব্যতীত আর কোনো উপায় ছিল না। এটি সত্য নয় যে জরুরি অবস্থা জারির পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যই আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো হয়েছিল। তখনকার গণমাধ্যম কি তাই বলেছে কখনো?
দেখুন, হাসিনা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ২০০৬ সালে বিভিন্ন বাহানায় ৬৮ জনকে খুন করিয়েছে। আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গুম-খুন, আয়নাঘর নির্যাতন ইত্যাদি করেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাজারো মানুষ খুন করেছে, হাজার হাজার মানুষকে জীবন্মৃত করেছে; মানুষের অঙ্গহানি করেছে। আবারো সে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারত থেকে তার দলের দুষ্কৃতকারীদের উৎসাহিত করছে। আমি শুনেছি দুজন জেনারেলকে তিনি ক্যু করার বা করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা এ দুই জেনারেল জরুরি অবস্থা জারির পর আমাকে বলেছিলেন।
আপনি বলছেন পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের আঁতাত হয়েছিল? কীভাবে হয়েছিল?
জি। সেদিন শনিবার ছিল। ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও কাজ বেশি থাকায় কিছু ফাইলপত্র নিয়ে ডিজির সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তার বাসার অফিসে যাই। এমন সময় আমার একজন অফিসার ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি ড. গওহর রিজভীকে চেনেন?’ আমি জবাব দিলাম, ‘আমি উনাকে চিনি না। কেন, কী হয়েছে?’ তখন তিনি বললেন, ‘উনি তো সাব-জেলে যান।’ আমি তখন জানতে চাইলাম সাব-জেলে কীভাবে যাচ্ছে? কার সঙ্গে যাচ্ছে? তিনি বলেন, ‘ব্রিগেডিয়ার আমিন [মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন] বিগত সাত-আটদিন যাবৎ উনাকে নিয়ে যাচ্ছেন।’ তখন ডিজি ছিলেন জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ। তিনিও বিষয়টি জানতেন না। আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি ডিজিকে জানাই। তিনি সেনাপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ড. গওহর রিজভীর শেখ হাসিনার সাব-জেলে যাওয়ার বিষয়টি সেনাপ্রধান অবগত আছেন বলে জানান।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ড. গওহর রিজভীকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার যে কোথাও কারো সঙ্গে আলোচনা না করে শুধু তৎকালীন সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপনে আঁতাত করার দুরভিসন্ধি করেন। বিষয়টি সুকৌশলে ডিজিএফআই-প্রধান লে. জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের আড়ালে রাখা হয়েছিল।
বেগম খালেদা জিয়াকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছিল?
যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয় তখন বিস্তারিতভাবে আলোচনায় আসে যে শুধু হাসিনাকে গ্রেফতার করলে তিনি এবং তার দল ক্ষিপ্ত হয়ে আবার দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবেন। সেজন্য সিদ্ধান্ত হলো মামলা থাকা সাপেক্ষে সব বড় দলের নেতাদের গ্রেফতার করতে হবে। সেই ধারণা থেকেই তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।
আপনি জেলে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে যেতেন বলেছেন। সে সময় আপনাদের মধ্যে কী ধরনের আলাপ হতো?
জেনারেল মইন ও ব্রিগেডিয়ার আমিন যখন গওহর রিজভীর মাধ্যমে শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপনে আঁতাত শুরু করলেন তখন আমি সুস্পষ্টভাবে আমার মনোভাব প্রকাশ করে বলি, বিষয়টি মোটেও ঠিক হয়নি। যদি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয় তবে সবার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। এক রকম বাধ্য হয়েই ডিজির কথায় সেনাপ্রধান তখন আমাকে বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেন। প্রথমে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমাকে কোনো বিষয়বস্তু দেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে ডিজিকে বললে সংস্কারের বিষয়ে আমাকে কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। সেই অনুযায়ী আমি ম্যাডামকে বিষয়গুলো উপস্থাপন করলে প্রায় প্রতিটিতে তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন। আমি যখন বিষয়টি ডিজিকে বিস্তারিত জানাই এবং বলি এ পর্যায়ে ম্যাডামের কাছে সিনিয়র কাউকে পাঠাতে সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনকে পাঠাতে বলেন। প্রথমদিন আমিও তার সঙ্গে যাই। এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার আমিনের একটি বিব্রতকর প্রশ্নে ম্যাডাম ক্ষুব্ধ হন। পরে আমি তাকে নিবৃত্ত করি। এর পরদিন থেকে আমার আর যাওয়া হয়নি ম্যাডামের কাছে। পরে আমাকে সেনা সদরে বদলি করা হয়।
তারেক রহমান কেন এক-এগারো সরকারের ভিক্টিম হলেন?
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম অপপ্রচার চালিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তার উত্থান থমকে দেয়ার জন্য বহু প্রচেষ্টা হয়েছে। এটি এখনো অব্যাহত আছে। বহুমাত্রিক গুজব ছড়িয়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের চেষ্টা করেছে প্রতিপক্ষ। অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো প্রমাণিত অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও শুধু তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। উল্লেখ্য, সব গ্রেফতারই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমাফিক হয়েছে।
এক-এগারোর সময় সেনাপ্রধান মউন ইউ আহমেদ প্রথমেই ছয় দিনের ভারত সফরে গিয়েছিলেন। ওই সফরে ভারত থেকে ছয়টি ঘোড়াও উপহার পেয়েছিলেন। এ সফর প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি তার লেখা ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইতে উল্লেখ করেছেন। তার এ সফর এবং এক-এগারো বাংলাদেশের রাজনীতিতে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন?
যখন সেনাপ্রধান ভারত সফরে গিয়েছিলেন তখন আমি ডিজিএফআইতে ছিলাম। সেনাপ্রধানরা তো সফর করেই থাকেন। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় তাদের সফর হয়। আগের সেনাপ্রধানরাও গিয়েছেন। পরেও অনেকে গেছেন। এটা একটা রুটিন ম্যাটার। এটা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না।
এগুলো তো জেনারেল মইন আর প্রণব মুখার্জির মধ্যে কথা। তিনি তো এসব আমাকে বলবেন না। পরেও সেনাপ্রধান বলেছেন প্রণব মুখার্জি নাকি ঠিক কথা বলেননি। ঠিক কথা লেখেননি। ফলে উনাকে তো রিজয়েন্ডার দেয়া উচিত ছিল। এরপর আমি তো মে মাসের পর থেকে দৃশ্যেই নেই।
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে গুম ও আয়নাঘরের সঙ্গে ডিজিএফআইয়ের ঘটনাগুলো কি এক-এগারোর ডিজিএফআইয়েরই লিগ্যাসি?
আমি মনে করি না। জরুরি অবস্থার সময় জিজ্ঞাসাবাদ আর নিরপরাধ মানুষকে খুন করা কোনোভাবেই সমান দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। শেখ হাসিনার সময় এটা একদম এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
তবে এক-এগারোর সময় যাদের নেয়া হয়েছে সেটা একটা পদ্ধতির মাধ্যমে হয়েছে। বন্দিদের নিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমি ওই বিভাগের দায়িত্বে ছিলাম না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের যথাযথভাবে হ্যান্ডওভার করেছে পুলিশের কাছে। সে সময় কোনো গুমের ঘটনা ঘটেনি।
আপনি বলছেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। তাহলে সে সময় অন্যান্য সংস্কার করার কারণ কী?
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই কিন্তু জরুরি অবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছিল। যখন জরুরি অবস্থা হলো তখন এটা কেন অন্যদিকে মোড় নিল? জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রস্তাব করলেন সেনাপ্রধানকে, স্যার, জরুরি অবস্থা জারি তো হলো এখন আমি মনে করি দুর্নীতি দমনে অপরেশন প্রয়োজন।
সেনাপ্রধানের দায়িত্ব হলো প্রধান উপদেষ্টাকে বলা। প্রধান উপদেষ্টাকে তিনি নিশ্চয়ই বলেছেন। তারপর এটা শুরু হলো। অনেককে আটক করা হলো, অনেক লম্বা তালিকা হলো। সেটা পরে ছোট করা হলো, কারণ এর বিচার প্রক্রিয়া দুই বছরের মধ্যে শেষ করা যাবে না। মানে কী? আমরা দুই বছর পরে নির্বাচন করে দিয়ে চলে যাব। প্রথমে তো সরকার সংস্কারের কথা বলেনি। এ সংস্কারের প্রথম প্রস্তাব শুরু হয়েছিল ড. কামাল হোসেনের পক্ষ থেকে। জরুরি অবস্থারও অনেক আগে। এরপর শুরু হলো যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন। এটাও কিন্তু সে সময়ে সেনাবাহিনীর বাইরে থেকে হয়েছিল।
আপনি কি মনে করেন সে সময়ে নির্বাচনে গুরুত্ব দেয়ার দরকার ছিল, সংস্কারে না?
যদি সংস্কারে গুরুত্ব দিত তাহলে তো ১৬ বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সুযোগই পেত না। দুইবার যদি প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার সিদ্ধান্ত হতো তাহলে তো হতোই। সে ২০০৮-এ ছিল, এরপর আবার হলো। এর আগে আরো একবার ছিল। এরপর তো এতবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকত না তার। ওই সময়ে যদি ওই সংস্কারগুলো হতো তাহলে বড় একটা বিপদ থেকে মানুষ বাঁচতে পারত।
সংস্কারগুলো কেন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি?
সবার সহযোগিতা পেলে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কার করলে ভালো হতো। অন্তত একটা রক্ষাকবচ থাকত। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে (কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) নিয়ে এত বড় ফ্যাসিস্ট হতে পারত না এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের দেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কতিলক পড়ত না।
সংস্কার না হওয়ার একটি কারণ হলো সরকারের ওপর প্রেশারটা এভাবে ছিল যে তাড়াতাড়ি নির্বাচন, তাড়াতাড়ি নির্বাচন ইত্যাদি। একপর্যায়ে সেনাপ্রধান বলতে বাধ্য হলেন, ‘কাদম্বিনীকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইল আমি মরি নাই।’ সেনাপ্রধানকে বারবার একটাই প্রশ্ন, কবে নির্বাচন, কবে নির্বাচন...। ক্ষমতা কবে ছাড়বেন বলে পাগল করে দিয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘বারী আমিই তো মার্শাল লর লাস্ট ম্যান।’ আমরা কাউকেই তো বিশ্বাস করি না।
তাহলে নির্বাচন নিয়ে আলোচনাটা চাউর হওয়ায় সংস্কারে ব্যাঘাত ঘটেছে বলে আপনি মনে করেন?
অবশ্যই। কারণ সংস্কার তো একটা প্রক্রিয়া। দুই বছরের মধ্যে তার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বসা উচিত ছিল। বসে তাদেরই দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল যে আপনারা এটা করেন।
এবারো নির্বাচন ও সংস্কারের প্রসঙ্গে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারার সম্ভাবনা কেমন দেখেন?
এটা জরুরি অবস্থাকালীন সরকারও করতে পারেনি। এ সরকারও করতে পারবে না। যদি জুনের মধ্যে নির্বাচন হয়ে যায় তারা করতে পারবেন না। রাজনীতিবিদরা চান না তাই। চাইলে তো কো-অপারেট করে এটা তিন মাসের মধ্যে করে ফেলা যায়। কিছু করতে চান, কিছু করতে চান না। যেটা রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধায় আসে সেটা তারা করতে চান, যেটা আসে না সেটি চান না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার ৯ মাস হয়ে গেল। অনেকেই বলছেন সেনাপ্রধানসহ নানা জায়গায় বর্তমান সরকারের সংকট দেখা দিয়েছে। আপনি কি এক-এগারো ঘটার আবার সম্ভাবনা দেখছেন?
এক-এগারোতে কী ছিল? একটা নিরপেক্ষ সরকার ছিল। সেটাকে সমর্থন দিত সেনাবাহিনী। আপনারা যেটাকে বলেন সেনা সমর্থিত সরকার। এখনকার সেনাবাহিনী সাপোর্ট দিচ্ছে না? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সাপোর্ট দিচ্ছে না? বিরোধটা কোথায়? করিডোরসহ কিছু বিষয়ে। সরকার তো বলছে করিডোর নিয়ে কিছু হয়ইনি।
তাহলে কি আপনার মতে এক-এগারো সরকারের সঙ্গে এ সরকারের সাদৃশ্যটা অনেক বেশি?
সেনাবাহিনী তো সমর্থন তখনো করেছে, এখনো করছে।