Image description

‘অর্থনীতির হাঁটুভাঙা অবস্থা আরকি। একটু দাঁড়ানোর আগেই আরেকটা বাড়ি খাচ্ছেন। ভাঙা হাঁটু নিয়ে কতদূর যাবেন বা কত দ্রুত, সেটা তো সম্ভব না। বিনিয়োগে যে স্থবিরতা, এটা তো কাটবে না যদি আপনার পূর্বশর্ত (রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা) পূরণ না হয়।’

চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা, নীতিনির্ধারণ ও সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় এ মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন

জাগো নিউজ: সম্প্রতি রাজনীতিতে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে, বিনিয়োগে মন্দা, আবার প্রবৃদ্ধি কমবে বলে দাতা সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমলে এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। অর্থনীতির এ চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?

জাহিদ হোসেন: এগুলো মোকাবিলা করার পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সেটার কোনো আশা-ভরসার জায়গাটা এখন আমরা দেখছি না। এগুলো মোকাবিলা করা খুব কঠিন। অর্থনৈতিক দিকটা যাতে আরও খারাপ না হয়, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। অনিশ্চয়তা সব দেশেই থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন—সেটা আজ যা আছে কাল কী থাকবে, এটা বলা খুব কঠিন।

 

এখান থেকে সবাই লুটেপুটে খাচ্ছে। বন্দরে মাল খালাস হয় না। ২০-২৫ দিন পড়ে থেকে জট লাগে। সেটা একটা আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এতেই দেখেন আপনার কী রকম একটা অবস্থা

জাগো নিউজ: অর্থনীতির বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

জাহিদ হোসেন: অর্থনীতির হাঁটুভাঙা অবস্থা আরকি। একটু দাঁড়ানোর আগেই আরেকটা বাড়ি খাচ্ছেন। ভাঙা হাঁটু নিয়ে কতদূর যাবেন বা কত দ্রুত, সেটা তো সম্ভব নয়। বিনিয়োগে যে স্থবিরতা, এটা তো কাটবে না যদি আপনার পূর্বশর্ত (রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা) পূরণ না হয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেই যে বিনিয়োগ শুরু হবে, সেটাও তো বলা যায় না। কারণ আপনার সংস্কারও তো অবশ্যই লাগবে। কিন্তু সংস্কার অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে এগোতে পারছে না।

আপনি এনবিআরের বিষয়টাই দেখেন না, পৃথকীকরণের বিষয় নিয়ে তো কোনো ধরনের বিতর্ক ছিল না বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। কিন্তু করতে গিয়ে নানান ধরনের অজুহাত বের করে এটাকে বাতিল করার জন্য আন্দোলন তুলছে। এখানে গলদটা কোথায়—সেটা তো আর সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলছে না। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আমাদের সঙ্গে আলাপ করা হয়নি। কী আলাপ করলে, এটাতে কী বদলাতো, এটা বললে তো একটু বুঝতে পারতো সবাই যে এখানে কোন জায়গায় ত্রুটি আছে। যেটা ভুল।

 

জাগো নিউজ: আন্দোলনকারীরা অধ্যাদেশ বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন।

জাহিদ হোসেন: তাই বোঝা যাচ্ছে যে বাতিলটাই আসল উদ্দেশ্য। যে কোনো অজুহাতেই হোক এটা বাতিল করতে হবে। মানে, আলাদা করলে যারা এই একভাবে থেকে সুবিধাটা পান, তাদের সুবিধাটাতে একটু আঘাত আসবে। সে জন্য ওটা হতে দেবে না।

জাগো নিউজ: অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে কি?

জাহিদ হোসেন: আমরা নিজেদের কীভাবে শাসন করবো, সরকার কীভাবে চলবে, নির্বাচন কীভাবে হবে—এগুলো মৌলিক বিষয় একটা জাতির জন্য। সেখানে তো আমরা একমত হতে পারছি না, আপনি সমন্বিত অর্থনৈতিক সংস্কার পাবেন কেমন করে? ধরেন, বন্দরের একটা টার্মিনাল মাত্র, যেটা সিন্ডিকেটের মধ্যে আছে। এখান থেকে সবাই লুটেপুটে খাচ্ছে। বন্দরে মাল খালাস হয় না। ২০-২৫ দিন পড়ে থেকে জট লাগে। সেটা একটা আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এতেই দেখেন আপনার কী রকম একটা অবস্থা।

বলা হচ্ছে—দেশ বিক্রি হয়ে গেলো, বন্দর বিক্রি হয়ে গেলো। এটা তো বন্দর নয়, একটা টার্মিনালের ম্যানেজমেন্ট। সিন্ডিকেটের লোকজনই তো এগুলো উসকে দিচ্ছে। এরকম একটা ন্যারেটিভ তৈরি করছে যে এটা বিদেশিদের হাতে চলে গেলো। দস্যুদের হাতে আছে, আরেক দস্যু নিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অবস্থা। আপনি একটা বন্দর যদি আধুনিকায়ন করতে না পারেন, আপনার বিনিয়োগকারীরা কী ভরসায় আসবে বলেন? শুধু দেশেই উৎপাদন করে দেশের ভিতরে বিক্রি করবেন? বাইরের বিনিয়োগকারীদের দরকার নেই?

এখন তো দেখছি আমাদের ভিতরের সংঘাত এত রকমের আকার ধারণ করছে, আগামী ৬-৮ মাসে কী ঘটবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বললাম না—ঘন কালো মেঘ, ওর পেছনে কী আছে এটা দেখা খুব মুশকিল

জাগো নিউজ: তাহলে কি সামনে আমরা শুধু অন্ধকার দেখছি?

জাহিদ হোসেন: ঘন কালো মেঘ। শুধু অন্ধকার না, ঝড়। অন্ধকার হয়ে আছে, তারপরে যে কী হবে, এখন বলা যাচ্ছে না।

জাগো নিউজ: দাতা সংস্থাগুলো প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের ঘরে নেমে আসার যে পূর্বাভাস দিচ্ছে, সেটাই কি সত্যি হবে?

জাহিদ হোসেন: সেটা তো হবেই। সেটা এই বছর। এই বছরের তো আর বেশি সময় নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে রাজনৈতিক দুর্যোগ একটা বড় ধরনের পরিবর্তন। প্রশাসনকে সক্রিয় করতে প্রায় ছয় মাস লেগে গেছে। তাও পুরোপুরি সক্রিয় নয়। কিন্তু সবারই একটা পূর্বাভাস এখন আছে যে ২০২৬ সালটা বেটার হবে। আমি কখনো দেখিনি আইএমএফের চেয়ে সরকারের প্রবৃদ্ধির প্রজেকশন কম করে। কিন্তু আগামী বছরের জন্য আইএমএফ বলছে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ হবে, সেখানে সরকার বলছে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। আপনি দেখেন—বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ সবাই বলছে এবছর থেকে আগামী বছরটা একটা পুনরুদ্ধারের বছর হবে।

জাগো নিউজ: বর্তমান পরিস্থিতি দেখে কি মনে হচ্ছে আগামী বছর পুনরুদ্ধারের বছর হবে?

জাহিদ হোসেন: আমি তো ভাবছিলাম যে এরা (বিভিন্ন দাতা সংস্থা) যেটা বলছে, অন্য লক্ষণ যেটা মোটামুটি মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল, ব্যাংকখাতে কিছু কাজ এগিয়েছে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির ব্যবস্থাপনা—এই পর্যন্ত এত গরম পড়া সত্ত্বেও মোটামুটি ম্যানেজ করতে পেরেছে, গ্যাসের সংকট থাকা সত্ত্বেও। এই অবস্থায় যদি এরকম মোটামুটি চালানো যায়, তাহলে আগামী বছর তো আরও বেটার হওয়াই উচিত। কিন্তু এখন তো দেখছি আমাদের ভিতরের সংঘাত এত রকমের আকার ধারণ করছে, আগামী ৬-৮ মাসে কী ঘটবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বললাম না—ঘন কালো মেঘ, ওর পেছনে কী আছে এটা দেখা খুব মুশকিল।

জাগো নিউজ: কেউ কেউ বলছেন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে বা রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে বেকারত্ব কমবে এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

জাহিদ হোসেন: এটা তো একটা পলিটিক্যাল বক্তব্য। মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটা নতুন সরকার আসে, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়—যে প্রক্রিয়ায় এসেছে, সেটা সবাই মেনে নিয়েছে। আর তার পরে তারা যদি সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে তো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। তারা যদি এসে আবার একই পুরোনো মডেলে ফিরে যায়, যে মডেল থেকে আমরা জুলাই-আগস্টের মাধ্যমে এত কষ্ট করে বেরিয়েছি, তাহলে কি নির্বাচন হলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? সেটা তো নির্ভর করছে তার পরে কী ঘটছে।

একটু শান্তিতে ছয়টা মাস একটা সরকারকে কাজ করতে দিন, কিছু কিছু সংস্কার করে যাক, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করে যাক। ওইটুকু যদি করতে দিতে পারতাম। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ম্যাক্রো পরিস্থিতির যে উন্নতিটা ঘটেছে, সেটাই তো বোঝায়—যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকত, তাহলে আপনি কী করতে পারতেন

জাগো নিউজ: সহজ কথায় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো আমরা কীভাবে মোকাবিলা করবো?

জাহিদ হোসেন: যান্ত্রিকভাবে বলা যায় যে—আমাদের ব্যাংকখাত ঠিক করতে হবে, গ্যাসের সংকট মেটাতে হবে, বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্নে যাতে চলে সেটা নিশ্চিত করতে হবে, বন্দর আধুনিকায়ন করতে হবে, শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে—আমরা তো এ ধরনের একটা লম্বা লিস্ট বলতে পারি। আমরা কী চাই, কী হওয়া উচিত। কিন্তু ওইটা ঘটবে কি না, কীভাবে ঘটবে, সেটা বলা এখন খুব দুষ্কর হয়ে গেছে।

জাগো নিউজ: বর্তমান পরিস্থিতি দেখে কি মনে হচ্ছে সমন্বিত নীতি গ্রহণের প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে?

জাহিদ হোসেন: আপাতদৃষ্টিতে তো তাই মনে হচ্ছে এখন। নতুনভাবে আবার আলোচনা শুরু হলো, সবার মধ্যে। এটা থেকে শান্তিতে ছয় মাস একটা সরকারকে কাজ করতে দিন। আপনি চিন্তা করেন ৫ আগস্টের পর রমজানের সময় একটু শান্তি ছিল। সে সময় বাজার পরিস্থিতি কেমন একটা শান্ত অবস্থায় ছিল। সবাই বলছে এই সরকারকে পাঁচ বছর থাকতে দিন।

একটু শান্তিতে ছয়টা মাস একটা সরকারকে কাজ করতে দিন, কিছু কিছু সংস্কার করে যাক, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করে যাক। ওইটুকু যদি করতে দিতে পারতাম। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ম্যাক্রো পরিস্থিতির যে উন্নতি ঘটেছে, সেটাই তো বোঝায়—যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকত, তাহলে আপনি কী করতে পারতেন।