
খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তরপর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…
আজকের তারকা: সানজিদা আক্তার
সানজিদা আক্তার—কলসিন্দুরের ছোট্ট মাঠ থেকে ছুটে আসা সাহসী এক কিশোরী, যিনি আজ ভুটানের ক্লাবে পেশাদার ফুটবলার। শুধু মাঠেই নয়, নিজের গল্প বলার ভাষায়ও তিনি অনন্য। অভিনয়, ট্রল, টিকটক কিংবা স্বপ্ন—সবকিছুর ভেতরেই তিনি খুঁজে নেন হাসি, ব্যথা আর আগামীর আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম
প্রথম আলো: ভুটানে আছেন এক মাসের বেশি, কিন্তু ম্যাচ খেলেছেন মাত্র একটি। সময় কেটে যায় কীভাবে?
সানজিদা আক্তার: সকাল জিমে কাটে, বিকেলে মাঠে। প্র্যাকটিসটা কিন্তু নিয়মিত। এর বাইরে পাহাড় আর ঝরনার সঙ্গে যেন একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। প্র্যাকটিস শেষে ঝরনায় যাই, সেখান থেকে ফিরে আইস বাথ নিই। শরীর-মন দুটোই চাঙা থাকে। থিম্পু সিটিতেই আমাদের থিম্পু সিটি এফসি ক্লাব এবং আমরা ফরেন প্লেয়াররা হোটেলে থাকি।
প্রথম আলো: পাহাড়-ঝরনা আর সুইমিংয়ের ফাঁকে ব্যক্তিগত সময় কেমন কাটে?
সানজিদা: দুপুরে লাঞ্চ, সন্ধ্যায় প্র্যাকটিস শেষে ঘুমাতে যাই। পরিবারের সঙ্গে কথা বলি, একটু গান শুনি বা ঘুরেফিরে ভাবি—এই যাত্রাটা কত লম্বা ছিল!
প্রথম আলো: গ্রাম থেকে উঠে আসা—একটা দীর্ঘ পথ তো বটেই...
সানজিদা: হ্যাঁ, স্বপ্নের মতোই লাগে। কলসিন্দুরের মাঠ থেকে ইস্টবেঙ্গল হয়ে এখন ভুটানের ক্লাবে! কিন্তু এর পেছনে কত কষ্ট, সংগ্রাম, কান্না! কত কথা শুনতে হয়েছে, ‘মেয়ে হয়ে হাফ প্যান্ট পরে মাঠে নামছে...’, তবে আমি হাল ছাড়িনি। সব সময় বাবার সাপোর্ট ছিল, তিনিই আমাকে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছেন।
কলসিন্দুরের মাঠ থেকে ইস্টবেঙ্গল হয়ে এখন ভুটানের ক্লাবে সানজিদা: সানজিদার ফেসবুক
প্রথম আলো: মা কেমন ছিলেন এই যাত্রায়?
সানজিদা: শুরুতে মা চাইতেন না আমি খেলি। সমাজের কথা শুনে ভয় পেতেন। বলতেন, ‘মেয়ে হয়ে খেলাধুলা!’ তবে বাবা ছিলেন একদম বিপরীত। বলতেন, ‘তুই পড়াশোনা ঠিক রাখ, বাকিটা আমি দেখব।’
প্রথম আলো: পরিবারে আর কে কে আছেন?
সানজিদা: আমরা চার বোন, দুই ভাই। আমি তৃতীয়। বড় দুই বোন হাসিনা আর খালেদা বিয়ে করে সংসার করছে। ছোট বোন সাজেদা এখন আর্মিতে, সে–ও ফুটবল খেলেছে। তবে আমি চাইতাম না ও ফুটবল খেলুক—সংগ্রামের পথটা কষ্টের, জানি। কিন্তু সে নিজের মতো করেই এগিয়েছে।
প্রথম আলো: ফুটবল না খেললে নিজেকে কোন পেশায় কল্পনা করতেন?
সানজিদা: সম্ভবত একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছোটদের শেখাতে ভালো লাগত। আমার কাছে শিক্ষকতাই সবচেয়ে সম্মানজনক পেশা। একজন শিক্ষককে সবাই সালাম দেয়—এই সম্মানটাই বড়।
ফুটবল না খেললে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেন সানজিদা: সানজিদার ফেসবুক
প্রথম আলো: আপনি সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়, আপনার সৌন্দর্য নিয়ে মানুষ কথা বলে। কেমন লাগে?
সানজিদা: আমি মনে করি, সৌন্দর্য মানে শুধু চেহারা নয়, মনটাও সুন্দর হতে হয়। মানুষ আমাকে ভালোবাসে, কারণ আমি সহজ-সরল, পরিবর্তন হইনি। ইনবক্সে অনেক মেসেজ আসে, যেগুলো বলা যাবে না (হাসি)। আমি সাধারণত উত্তর দিই না, কারণ বুঝি না কী বলব। তবে মানুষের ভালোবাসা সব সময় কৃতজ্ঞ করে তোলে।
প্রথম আলো: খেলার বাইরের সৌন্দর্য নিয়ে যখন বেশি আলোচনা হয়, তখন কি খেলার অর্জন আড়ালে পড়ে যায়?
সানজিদা: কেউ যদি শুধু সৌন্দর্য দিয়ে পরিচিত হয়, খেলায় কিছু না করে, তখন মানুষ ট্রল করে। তাই খেলাধুলা, ব্যবহার, বডি ফিটনেস—সবকিছুই দরকার। সৌন্দর্য একা কিছু না, পারফরম্যান্সই মুখ্য।
প্রথম আলো: আপনি তো বেশ ফ্যাশনসচেতনও...
সানজিদা: হ্যাঁ, নিজেকে মানায় এমন পোশাক পরি। ঢাকায় হাল ফ্যাশনের জিনিস পরতে ভালো লাগে, তবে গ্রামে নয়। পাকিস্তানি অভিনেত্রী ও গায়িকা হানিয়া আমিরের স্টাইল বেশি পছন্দ আমার। আমাদের টিমেও সবাই স্টাইলিশ—মারিয়া, সাবিনা আপু, মাসুরা—সবাই!
ফ্যাশনসচেতন সানজিদার পছন্দ পাকিস্তানি অভিনেত্রী ও গায়িকা হানিয়া আমিরের স্টাইল: সানজিদার ফেসবুক
প্রথম আলো: আপনার জীবনের গল্প নিয়ে সিনেমা হলে আপনার চরিত্রে কাকে দেখতে চাইবেন?
সানজিদা: আমি নিজেই অভিনয় করতে চাই। তবে সানজিদার ছোটবেলার চরিত্রে অবশ্যই শিশুশিল্পী লাগবে। বড় সানজিদার ভূমিকায় আমিই থাকব।
প্রথম আলো: সানজিদা এমনিতে অভিনয় কেমন পারে?
সানজিদা: অভিনয় মোটামুটি পারি, ক্যামেরার সামনে কনফিডেন্ট থাকি। বিজ্ঞাপন করেছি কয়েকটি। ফটোশুট করেছি। পরিচালক যা চান ঠিক ঠিক করতে পারি। ঠিক এক্সপ্রেশনটা ভেতর থেকেই চলে আসে। ক্যামেরাম্যানরা বলে, আমাকে দিয়ে নাকি অনেক কিছু হবে (হাসি)। ক্যামেরার সামনে আমি কনফিডেন্স নিয়ে কাজ করতে পারি।
প্রথম আলো: এখন পর্যন্ত কতগুলো বিজ্ঞাপন বা প্রমো করা হয়েছে?
সানজিদা: প্রমো করা হয়েছে কয়েকটি। বিজ্ঞাপন তিনটি। বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে একটা ছিল ফোনের, একটা বাবা দিবসে বাবার সঙ্গে। এ ছাড়া বিভিন্ন ফটোশুট করেছি।
প্রথম আলো: টিকটক করতে সানজিদার ভালো লাগে। টিকটকে সে ব্যাপক জনপ্রিয়...
সানজিদা: টিকটকে আমার অনেক ফলোয়ার আছে। কিন্তু আমি টিকটকে এখন অ্যাকটিভ না।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনার বা নারী দলের অন্য অনেকের টিকটক নিয়ে অনেক কথা হয়...
সানজিদা: আমরা সকাল-সন্ধা কাজের মধ্যেই থাকি, ধরতে গেলে এটা বন্দী অবস্থার মতো। এর বাইরে আমাদেরও একটা জীবন আছে, ওখানে যদি আমরা একটু হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি, হাসিখুশি থেকে কষ্টটা একটু ভুলে থাকি, তাহলে সমস্যা বা খারাপ কিছু দেখছি না।
প্রথম আলো: আপনার নামে শুনলাম খাবারও নাকি আছে?
সানজিদা: তা আর বলতে! বাচ্চাদের দইয়ের মতো একটা আইসক্রিম, ‘সানজিদা’ নামে। প্যাকেটের গায়ে লাল অক্ষরে লেখা। অনেকে সেই আইসক্রিমের ছবি তুলে আমাকে পাঠায়। ওটা আমার উদ্দেশে বানানো কি না জানি না, তবে নামটা নিয়ে অনেক মজা করে সবাই। আবার ট্রলও হয়।
প্রথম আলো: কী রকম?
সানজিদা: এক জায়গায় দেখলাম, ‘জীবনে সুখী হতে হলে অবশ্যই ‘‘সানজিদা’’ নামের মেয়ে বিয়ে করা উচিত।’ গবেষণায় নাকি দেখা গেছে, অন্য মেয়েদের তুলনায় ‘‘সানজিদা’’ নামের মেয়েরা অনেক ভালো!” আরেকটা মিম দেখলাম, যেখানে লেখা, ‘সানজিদা, তুমি কি হবে আমার সেই রূপকথার মায়াবতী!’ (হাসি)
প্রথম আলো: ছোটবেলার সানজিদা যদি আজকের সানজিদাকে দেখত, কী বলত?
সানজিদা: ‘অবাক হয়ে বলত, ইশ্! আমি যদি ওই জায়গায় যেতাম!’ আর আমি বড় সানজিদা ছোট সানজিদাকে বলতাম, ‘ইশ্, যদি আবার ছোটবেলা ফিরে পেতাম!’ দুই দিকেই আফসোস, দুই দিকেই স্বপ্ন (হাসি)।
প্রথম আলো: কখনো কি মনে হয়েছে ফুটবল না খেললে নায়িকা হতে পারতেন?
সানজিদা: এটা কখনো মনে হয়নি। একটা নাটকের অফার পেয়েছিলাম। নাম ‘ইচ্ছে ডানা’। কিন্তু আমি সায় দিইনি, আমার বিশ্বাস ফুটবলেই ভালো করব।
প্রথম আলো: সানজিদা ফুটবল না খেললে এত দিনে তাঁর বিয়ে হয়ে যেত?
সানজিদা: অবশ্যই হয়ে যেত। আমার বোনের বিয়ে হয়েছে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে। আমরা গ্রামের মেয়ে, ফলে আমাকেও এত দিন অবিবাহিত রাখত না। গ্রামে বাবা–মায়ের কথাই বেশির ভাগ মেয়ে মেনে নেয়। আমার দুই বোন যেমন কোনো কথা বলেনি, বাবা–মা যেখানে বিয়ে দিয়েছে, সেখানেই হয়েছে।
প্রথম আলো: কলসিন্দুর মানেই প্রথমে কী মনে পড়ে—পুকুর, ধানের মাঠ, না মায়ের রান্না?
সানজিদা: মায়ের রান্না আগে। বিশেষ করে হাঁসের মাংস, যা অনেক সুস্বাদু হয়। আমি বাড়ি গেলেই মা এটা রান্না করেন।
প্রথম আলো: স্কুল পালিয়ে খেলতে যাওয়ার স্মৃতি আছে? ধরা খেয়েছেন কখনো?
সানজিদা: হ্যাঁ, আছে! প্রাইমারিতে পড়ার সময়ের কথা। স্যার বলেছিলেন, স্কুল শেষে ফুটবল খেলব, তারপর বাড়ি যাব। কিন্তু আমি ক্লাস শেষ হতেই চুপি চুপি চলে গিয়েছিলাম। পরদিন স্যার ক্লাসের মধ্যে সবাইকে সামনে বসিয়ে আমাকে কান ধরিয়েছিলেন, ‘কেন চলে গেছিস?’ আসলে ওদিন ফুটবল খেলতে আসতে একটু লজ্জা লাগছিল। তখন আমি ফোরে পড়ি। তবে স্কুলে কোনো খেলা হলেই আমি অংশ নিতাম আর পুরস্কার পেতাম। এ জন্য স্যার ধরে নিয়েছিলেন আমি ফুটবলও ভালোই খেলব।
প্রথম আলো: ২০২২ সাফের ফাইনালের আগে আপনার একটা স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন হলে ছাদখোলা বাস চেয়েছিলেন ঢাকার বিমানবন্দর থেকে। সেটা মনে করলে কেমন লাগে
সানজিদা: সেটা ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা। আবেগ থেকে স্ট্যাটাসটা দিয়েছিলাম। তবে সেটার প্রতিক্রিয়া এমন হবে ভাবিনি। সত্যি সেটা ছিল অসাধারণ সময়।
প্রথম আলো: অবসরের সময় কীভাবে কাটে?
সানজিদা: আগে অনেক গান শুনতাম, গাইতামও। এখন আজহারির বক্তৃতা বা মোটিভেশনাল লেকচার শুনি। ছোট বোন নামাজ পড়ে, টিভিতে হজ দেখায়। বাড়ি গেলে ওর সঙ্গে সময় কাটিয়ে ভালো লাগে। নিজেও নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যে কোরিয়ান বা তুর্কি ড্রামাও দেখি।
প্রথম আলো: সিনেমা?
সানজিদা: হলে গিয়ে ‘পরাণ’, ‘প্রিয়তম’ দেখেছি। টিমের মেয়েরা মিলে সিনেমা দেখতে যাই।
প্রথম আলো: বই?
সানজিদা: গল্প-উপন্যাস পড়ি। সম্প্রতি দুটি বই পড়েছি।
প্রথম আলো: রান্না?
সানজিদা: (হাসি) আমি ভালো পারি না। তবে ইউটিউব দেখে ডিম ভাজি আর নুডলস করি। শুঁটকি খুব পছন্দ—একদিন বাফুফের ক্যাম্পে শুঁটকি কষাতে গিয়ে এত মসলা দিয়েছিলাম যে শুধু আমিই খেয়েছিলাম, কেউ খেতে পারেনি!
প্রিয় বন্ধু মারিয়া মান্দার সঙ্গে সানজিদা
প্রিয় বন্ধু মারিয়া মান্দার সঙ্গে সানজিদাসানজিদার ফেসবুক
প্রথম আলো: সবচেয়ে কাছের বন্ধু?
সানজিদা: মারিয়া, শিউলি—ধোবাউড়ার স্কুলজীবন থেকে ওরা বন্ধু। আসলে সবার সঙ্গেই আমার ভালো বন্ধুত্ব। বাফুফে ভবনে আমার রুমমেট মনিকা, কৃষ্ণাদি, মারিয়া। ফলে ওদের সঙ্গে একটু বেশি সময় থাকা হয়।
প্রথম আলো: সানজিদা কি কোনো ক্রীড়াবিদকে বিয়ে করবে ?
সানজিদা: নাহ্, ক্রীড়াবিদকে বিয়ে করার ইচ্ছা নেই। একই জগতের জুটি আমার ভালো লাগে না। অন্য জগতের কেউ হতে পারে।