
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ নামে নতুন ছাত্রসংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বাকের মজুমদার। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। নতুন ছাত্রসংগঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার
নতুন সংগঠনে শিক্ষার্থীদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন? সংগঠন গোছাতে কী কী কৌশল নিচ্ছেন?
আবু বাকের মজুমদার: গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঘোষণা দেওয়ার আগে গত ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে আমরা মাসব্যাপী ফিল্ডওয়ার্ক (মাঠপর্যায়ে আলোচনা) করেছি। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সাত সরকারি কলেজসহ অংশীজনদের সঙ্গে আমরা বসি। অভ্যুত্থানে যে শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের ৯৫ শতাংশ এখনো লেখাপড়ার মধ্যেই আছেন। তাঁদের সরাসরি জাতীয় রাজনীতি করার সুযোগ নেই। আমাদের মনে হয়েছে, নতুন ধরনের ছাত্ররাজনীতির চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই চাহিদাটাকে কীভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়, সেই চিন্তার ফলাফল হিসেবে আমাদের ছাত্রসংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে।
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে জড়ো হয়েছেন। আগে ছাত্রলীগ করেছেন, ছাত্রদল করেছেন কিংবা আগে বামপন্থী ছাত্রসংগঠন করেছেন—এমন শিক্ষার্থীরা আমাদের সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন। এখানে ইসলামপন্থী শিক্ষার্থীরা আছেন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও আছেন। আমরা এখানে বিভিন্ন মতের একটা মিশ্রণ ঘটাতে পেরেছি, জুলাইয়ে (গণ–অভ্যুত্থানের সময়) যেমন সব স্রোত একসঙ্গে মিলিত হয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু আমরা যখন একটা আলাদা ধারণা নিয়ে ছাত্রসংগঠনের কথা ভাবছিলাম, তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেককে আমাদের নতুন সংগঠনে আসার আহ্বান জানাই। সেখান থেকে একটা বড় অংশ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
আমাদের ছাত্রসংগঠনে সব পর্যায়ে নেতৃত্ব বাছাই হবে ‘বটম টু টপ’ (নিচ থকে ওপরে) পদ্ধতিতে। তবে আপাতত অংশীজনদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা প্রথমে আহ্বায়ক কমিটিগুলো করার চেষ্টা করছি। কেন্দ্রীয় কমিটি করার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চারটি ইউনিটে ভাগ করেছিলাম। সেখানে চারটি সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি করা হয়েছিল। পাশাপাশি অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সাত সরকারি কলেজসহ আরও কিছু কমিটি করা হয়। এসব কমিটি যাঁদের সিলেক্ট করেছে, তারা যে অগ্রাধিকার তালিকা করেছে, তার ভিত্তিতেই আমরা কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি করেছি। সব প্রতিষ্ঠান ও জেলায় আমরা একই প্রক্রিয়ায় এগোব।
আগে আপনারা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সেটা গণ-অভ্যুত্থানের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফাতেও ছিল। নতুন ছাত্রসংগঠন যে ভবিষ্যতে লেজুড়বৃত্তিক হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
আবু বাকের মজুমদার: ছাত্রলীগ যে ধরনের সন্ত্রাস, আধিপত্য ও পেশিশক্তির রাজনীতি করেছে, সেটার একটা বড় কারণ ছিল লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি। আমাদের ছাত্রসংগঠনটি একটি জাতীয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে কাজ করবে। জুলাই ও একাত্তরের স্পিরিটকে (চেতনা) ধারণ করে ভবিষ্যতে যারা জাতীয় রাজনীতি করবে, তাদের প্রতি আমাদের আদর্শিক সমর্থন থাকবে। জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) যেহেতু জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি থেকে গঠিত জাতীয় রাজনৈতিক দল, তাদের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক মিল আছে। তবে এনসিপির সঙ্গে আদর্শিক মিল থাকলেও আমরা লেজুড়বৃত্তি করব না।
অনেকের ধারণা, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ কার্যত এনসিপির ছাত্রসংগঠন...
আবু বাকের মজুমদার: এনসিপির আত্মপ্রকাশ হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। আর গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঘোষণা হয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ ছাত্রসংগঠনের ঘোষণাটা আগে দেওয়া হয়েছে। এনসিপির সঙ্গে আমাদের আদর্শিক মিল যদি থেকেও থাকে, তবু আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো বা অবস্থান একেবারেই স্বতন্ত্র হবে। এনসিপির সঙ্গে আমাদের কথা, বোঝাপড়া ও আলোচনা হয়। একসঙ্গে যেমন জুলাই অভ্যুত্থান করেছি, তেমনি বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একসঙ্গে আমরা অনেক কাজ করছি। আমরা এনসিপির ছাত্রসংগঠন না, আবার এমনও নয় যে তাদের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক মিল নেই।
আপনাদের ছাত্রসংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে মারামারি-হাতাহাতির ঘটনা ঘটল। আত্মপ্রকাশের দিনে যা ঘটল, তাতে প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে আপনাদের কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
আবু বাকের মজুমদার: পুরো প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সেদিন ঝামেলাটা লাগানো হয়েছিল। এখানে তৃতীয় পক্ষের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আর যারা সেদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে কথা বলেছে, তারা পরে ভুল বুঝতে পেরে আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। তাদের মূলত বিভ্রান্ত করা হয়েছিল।
অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের অনেকে সমালোচনা করছেন, আপনারা মূলত ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীদের নিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আপনাদের ছাত্রসংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ নেতৃত্বেও ছাত্রলীগের সাবেক একজন নেতা রয়েছেন।
আবু বাকের মজুমদার: ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে যারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তারা কিন্তু নিজের রাস্তা খুঁজে নিয়েছে বলে আমরা মনে করি। সব ধরনের অংশীজনের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আমরা নতুন ছাত্রসংগঠন করেছি।
যারা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তাদের আমরা গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে রেখেছি। জুলাইয়ের স্পিরিটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কিংবা ফ্যাসিবাদের পক্ষে থাকা কেউ আমাদের সংগঠনে নেই। তথ্যপ্রমাণসহ কেউ এমন কাউকে দেখাতে পারলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
আপনাদের ছাত্রসংগঠনের অর্থায়ন কীভাবে হবে?
আবু বাকের মজুমদার: আমাদের আর্থিক বিষয়টা তিনটি প্রক্রিয়ায় চলবে। প্রথমত, সাংগঠনিক ফি বা চাঁদা। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘উইন-উইন সিচুয়েশনে’ থেকে স্পনসর (পৃষ্ঠপোষকতা) যদি আনা যায়, সেটা থেকে সংগঠনের আয় হতে পারে। আর তৃতীয়ত আমাদের আদর্শিক স্পনসর নেওয়ার সুযোগ আছে। যেমন কারও যদি মনে হয় শিক্ষার্থীরা একটা ভালো কাজ করছে এবং তাদের সঙ্গে আদর্শগত মিল অনুভব করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি আমাদের সাপোর্ট (সহযোগিতা) দিতে পারেন। আমরা সংগঠনের জন্য এই তিন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করছি। এর বাইরে আমরা নিজস্ব কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরির চিন্তাও করছি। সেই প্রতিষ্ঠানের লাভের একটা অংশ সংগঠনের তহবিলে যুক্ত হতে পারে।
এর আগে যখন আমরা ছাত্রশক্তি করেছি, তখন আমরা সাংগঠনিক ফি বা চাঁদা ও আদর্শিক স্পনসর—এই দুইটা জিনিস চর্চা করেছি। তবে তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি করায় আমরা কোনো করপোরেট স্পনসর পাইনি।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃত্ব নির্বাচন কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে?
আবু বাকের মজুমদার: আহ্বায়ক কমিটি তো আসলে গণতান্ত্রিক উপায়ে হয় না, সমঝোতার মাধ্যমে হয়। সেই জায়গা থেকে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অংশীজনদের সঙ্গে বসেছি, তাঁদের কথা শুনেছি। আহ্বায়ক কমিটিতে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব রাখার চেষ্টা আমরা করেছি। আমাদের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ এক বছর। সব জায়গায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর সংগঠনের কাউন্সিল হবে।
কেউ কেউ বলতে চাইছেন, মূলত ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখেই আপনারা নতুন ছাত্রসংগঠন করেছেন। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?
আবু বাকের মজুমদার: এখনকার বাস্তবতা অনুযায়ী, ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে আসার চেয়ে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ পরিচয়ে ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যারা এ ধরনের কথা (ডাকসু সামনে রেখে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ) বলছেন, তাঁদের উচিত আমাদের সাংগঠনিক দৃষ্টিভঙ্গিটা অনুধাবন করা। আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে জাতীয় ছাত্ররাজনীতির কথা বলছি।
আমাদের ছাত্রসংগঠনের অগ্রাধিকারের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করার বিষয়টি রয়েছে। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে বৈধ ও নির্বাচিত নেতৃত্ব পাবে শিক্ষার্থীরা। সেই নেতৃত্বই সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে।
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ কোন জায়গা থেকে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর চেয়ে আলাদা?
আবু বাকের মজুমদার: গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি করবে না। নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। ছাত্ররাজনীতির বয়স নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন আছে। আমাদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদে থাকার সর্বোচ্চ বয়স হবে ২৮ বছর। আর ভর্তির পর থেকে সাত বছর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে থাকা যাবে। এখানেও আমরা আলাদা।
আমরা নারীদের জন্য একটি ‘কমফোর্ট জোন পলিটিকস’ তৈরি করতে চাই, যেটা আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে করতে পেরেছিলাম। আমাদের সংগঠনে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, নেতৃত্বেও নারীদের প্রতিনিধিত্ব রাখা হচ্ছে। অন্য সংগঠনগুলোর চেয়ে আমরা নারীদের অনেক বেশি জায়গা দিতে পেরেছি।
আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক মধ্যম পন্থার রাজনীতির কথা বলছি। আমাদের মধ্যম পন্থার রাজনীতিতে মধ্য বাম ও মধ্য ডানপন্থী অনেকে যুক্ত হয়েছেন। এ দুই অংশই একটা ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। এই জায়গায়ও অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর চেয়ে আলাদা।
ডানপন্থী ও সেক্যুলার—এ রকম বিভাজন তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ। আমরা যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা বলছি, সেখানে এ দুইটার মাঝখানে একটা দেয়াল হওয়ার চেষ্টা করছি। বিভাজনের রাজনীতি আর চলতে দেওয়ার সুযোগ নেই। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় না করে যতটুকু ‘মাল্টিকালচারাল পলিটিক্যাল প্র্যাকটিস’ (বহুসংস্কৃতির রাজনৈতিক অনুশীলন) করা যায়, ততটুকু করব আমরা।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু বাকের মজুমদার: আপনাদেরও ধন্যবাদ।