Image description

বরাবরই ছিলেন রাজপথে। লড়াই সংগ্রামই যার জীবন। ধার ধারেন না পদ-পদবির। আগ্রহ নেই রাষ্ট্রীয় পদকেরও। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বেসরকারি শিক্ষক নেটওয়ার্কে যুক্ত থেকে সরব ভূমিকা পালন করেছেন। স্পষ্ট কথা বলতে ছাড়েন নি শত প্রতিকূলতায়ও। নাগরিক অধিকার আদায়ে ফের রাজপথেই নেমেছেন। সরকারের সাত মাসের কার্যক্রমের ভুলগুলো নিয়ে তীব্র সমালোচনা করছেন। কথা বলছেন প্রগতিশীলতার পক্ষে। একাত্তর প্রশ্নে নিজের অবস্থান যেমন স্পষ্ট করেছেন তেমনি চব্বিশের অর্জন যেন বেহাত না হয়, বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার বদলে বৈষম্যপূর্ণ সমাজ যেন না হয় তা নিয়ে সাবধান করছেন নাগরিকদের। সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নাগরিকরা তাদের অধিকার প্রশ্নে সক্রিয় না থাকলে দেশের বিপদ আছে। বলছিলাম একজন আনু মুহাম্মদের কথা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। মানুষটি শেষ পর্যন্ত নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকবেন বলেই কোনো দায়িত্ব নেননি। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব, বর্তমানে সর্বজন কথার সম্পাদক আনু মুহাম্মদ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন জনতার চোখ-এর সঙ্গে। পাঠকের জন্য বিস্তারিত-
 

প্রশ্ন: এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। ইতিমধ্যেই সাত মাস অতিক্রান্ত। নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। আপনার মূল্যায়ন কি? 
গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ করে হয় নাই। গণ অভ্যুত্থানে মানুষ অংশ নিয়েছে কারণ মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, ক্রোধ, বঞ্চনার ব্যাপার ছিলো, তাদের মধ্যে হতাশা ছিলো এবং সাংঘাতিক এক অনিশ্চয়তা ছিলো। নির্বাচন ছাড়া একটি সরকার বছরের পর বছর চলেছে। তাদের লোকজন যা খুশি তাই করেছে, মানুষের উপর অত্যাচার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অত্যাচারের একটা কারখানা হয়ে উঠেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছিলো। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তখনই যখন সরকার নির্বিচারে গুলি করে, মানুষ হত্যা করা শুরু করে। জনরোষের বিস্ফোরণে গণঅভুত্থান আসে,  সরকার পালাতে বাধ্য হয়। 
এরপর গত ৭ মাসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে। সবক্ষেত্রে একমত না হলেও কমিশনগুলোর রিপোর্ট তৈরি, পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা তেমন কোনও পরিবর্তন দেখিনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই রকমের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। প্রত্যাশায় অনেক ভাঙ্গন আসছে। সেজন্য এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা দায়িত্ব মনে করি। 
 

প্রশ্ন: দীর্ঘদিন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করছেন। বর্তমানে যে ধরনের সরকার চলছে, তাতে কোনও প্রশ্নের উদ্রেক করে কিনা? আমরা কোনদিকে যাচ্ছি? 
অন্যায়, জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের সবারই দায়িত্ব, হাসিনা আমলে ঝুঁকি নিয়েই সরকারের জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য অব্যাহত ছিল। গণঅভ্যুত্থানে আমরা জনগণের সঙ্গেই ছিলাম। সকলের সম্মিলিত অংশীদারিত্ব রয়েছে গণঅভ্যুত্থানে কিছু সুবিধাভোগী ছাড়া। এখন যে সরকার সেটা অস্থায়ী একটা সরকার। সরকারে যারা উপদেষ্টা তাদের আমরা চিনি, জানি। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনা, তাদের ভূমিকা এসব সম্পর্কে আমাদের কমবেশি জানা আছে। 
এরকম একটা গণঅভ্যুত্থানের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসে তার উপর বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়ে। মানুষের অনেকরকম চাওয়ার প্রকাশও দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকরা বকেয়া মজুরির জন্য আন্দোলন করছে। কিংবা শিক্ষকরা তাদের বকেয়া বেতনের জন্য আন্দোলন করছে। বিভিন্ন সময় এ রকম দাবি দাওয়া নিয়ে আসছে যা খুবই ন্যায্য দাবি। এটা তাদের বহুদিনের বঞ্চনার ফলাফল। বহুদিন তারা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত এখন তারা আশা করছে এ সরকার এটা তাদের দেবে। দেখা যাচ্ছে, শ্রমিকদের উপর গুলি হলো, শিক্ষকদের উপর হামলা হলো। এই ধরনের জনগোষ্ঠীর উপর সরকারের এক ধরনের অসহিঞ্চুতা দেখছি। অন্যদিকে, আরেক গোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করছে, হামলা করছে, মব ভায়োলেন্স করছে। নারীর উপর আক্রমণ হচ্ছে, সংখ্যালঘু যারা নানাভাবে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। শুধু সংখ্যালঘু না সবধরনের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাই বাড়ছে। যারা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে তাদের ব্যাপারে সরকারের নমনীয় আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। 
কিন্তু উল্টোটা হওয়ার কথা ছিলো। জনগণের অংশ থেকে যারা বিভিন্ন ন্যায্য দাবি দাওয়া নিয়ে আসছে তাদের কথা শোনা দরকার ছিল। তাদের প্রতি নমনীয় হওয়া দরকার ছিল। তাদের বঞ্চনা দূর করতে সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত ছিল। যারা জনগণের উপর নিপীড়ন করছে, জুলুম করছে, জোর জবরদস্তি করছে তাদের ধরা দরকার ছিল। 
যেমন কিছু কিছু হত্যার বিচার বহু দিন ধরে পড়ে আছে। যেমন, ত্বকী হত্যার বিচার ১২ বছর, সাগর-রুনী হত্যার ১৩ বছর হয়ে গেছে, তনু ধর্ষণ ও হত্যার ৭/৮ বছর, মুনীয়া ধর্ষণ ও হত্যার বিচার কোনোটাই অগ্রসর হয় নাই। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমদিকে বলা হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি এসব ঘটনার সমাধান করবে। অথচ এই সাত মাসে এসব বিচারের কোনো অগ্রগতি হয়নি। 
 

প্রশ্ন: সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাথে আপনার কখনো এসব বিষয়ে কথা হয়েছে কিনা? 
আমার সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তবু নানাভাবে বলেছি এগুলোর বিষয়ে। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় দিকগুলো নিয়ে কথা  বলছি। প্রথমদিকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরেও লিখিতভাবে পাঠিয়েছি। আমি মনে করি, বর্তমানে সরকারে যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন তারা অনেকেই বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাজেই জনগণের পক্ষ থেকে যেসব বিষয় আসবে সেগুলো নিয়ে ধরাধরি বা তদবিরের কিছু নেই, তারা দায়িত্ব নিয়েই এগুলোর সমাধান করবেন। সংবেদনশীলতা এবং জনমতের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া যেটা হবে সেটা বিবেচনায় নিয়েই তা করবেন এটা আমরা আশা করি। কিন্তু সেভাবে হচ্ছে না। 
যেমন পান্থকুজ্ঞ এবং হাতিরঝিল এই দুটো এলাকা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে হাসিনা সরকারের এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে। এই সরকার তার বাস্তবায়ন করছে যখন তখন এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে কিছু তরুণ প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদের ৯০ দিন পার হয়ে গেছে। সরকার বলতে পারে, অবস্থান করলেই তাদের দাবি মানতে হবে এমন না। তবে সেটা যদি জনগণের জন্য কোনো চাওয়া হয় তবে অবশ্যই মানতে হবে। এই সরকার যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আসছে তাদের তো এই সংবেদনশীলতা থাকা দরকার। অথচ ৯০ দিন পার হয়ে গেলেও সরকারের এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। আমরা পান্থকুঞ্জের সমাবেশে তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছি। সরকারের অনেককেই চিনি যারা এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারতেন। এটা খুবই বিস্ময়কর যে কি কারণে তারা পারছেন না বা করছেন না, জনস্বার্থে এটা বলা দরকার ছিল। এগুলো আমাদের উদ্বেগের কারণ। মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে অসংগতির বিষয়। 
 

প্রশ্ন: প্রত্যাশার সাথে অসঙ্গতি দেখছেন, কেন এমনটা হচ্ছে? আপনার কি মনে হয়? 
এটা শুধু এই অস্থায়ী সরকার না। আসলে সব সরকারই অস্থায়ী। বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিছু স্থায়ী প্রতিষ্ঠান আছে যারা স্থায়ীভাবে সরকার পরিচালনা করে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র। তারা স্থায়ী একটি প্রতিষ্ঠান। অনেক নীতি নির্ধারণে তাদের ভূমিকা থাকে। তারা পেছনে থাকে, অদৃশ্য শক্তি হিসেবে। আরেকটা শক্তি হলো বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দেশি ও বিদেশি। তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে। আরেকটা হলো বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। যারা মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালনা করে। স্থায়ী সরকারের এই তিনটি হলো উপাদান। এই তিনটি উপাদান একই আছে আগের মতই। 
এই সরকারের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গেলে স্থায়ী সরকারের তিনটি উপাদান যদি আগের মতই অব্যহত থাকে তাহলে কোনো ধরনের পরিবর্তন হবে না। আগের সরকারের সম্পদের কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য, লুণ্ঠন, সম্পদ পাচার যা কিছু হয়েছে যে ধরনের নীতিমালা দিয়ে তার পেছনে বিশ্বব্যাংক, আমলাতন্ত্র ও বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ছিল। সেটাই যদি অব্যহত থাকে তাহলে আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হবে। এই সরকারের কাছে ওই ভূমিকা প্রত্যাশিত তাদের ভাষা, নীতিমালা ও কর্মসূচির মধ্যে কিছু উপাদান থাকবে যে লক্ষণগুলো দেখে বোঝা যাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কিছু পরিবর্তন করতে চায়। এই পরিবর্তন চাওয়ার ভিত্তিটা যদি তারা স্থাপন করতে পারে তাহলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার আসবে তারাও কিছু পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। 
 

প্রশ্ন: আপনার কথার মধ্যে মব ভায়োলেন্সের কথা আছে। এ নিয়ে দেশজুড়েই বিতর্ক চলছে। সরকারের ভেতরে বাইরেও এ নিয়ে কথা হচ্ছে। 
মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সরকারের একটি সক্রিয় ভূমিকা থাকা দরকার ছিল। গলায় জোর থাকা দরকার ছিল। এই যে বিভিন্ন জায়াগায় মব ভায়োলেন্সগুলো হয়েছে। কিছু আছে ভাঙচুর, হামলা, লুটপাট এগুলো হয়েছে। আবার কিছু কিছু আছে প্রতিষ্ঠাগুলো শেষ করে দেয়া হয়েছে। জোর জবরদস্তি করে প্রতিষ্ঠাগুলোতে এমনকিছু লোক বসানো হয়েছে প্রতিষ্ঠান শেষ হয়েছে। এইসব ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সক্রিয় ভূমিকা দেখি না। গত কিছুদিন ধরে নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ নিয়ে বিভিন্ন রকম প্রতিবাদ হচ্ছে। এইসব কারণে সরকারের কিছু প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাদের দায়িত্ব ছিল আরো আগে সক্রিয় ভূমিকা নেয়ার। 
এই ধরনের গোষ্ঠী যারা জনগণের উপর নিপীড়ন করে, সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতিগত বিদ্বেষকে ব্যবহার করে, ধর্মীয় ও লিঙ্গীয় বিদ্বেষকে ব্যবহার করে একটি অত্যাচারী গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয় তারা ছাড় পেয়ে গেলে এদের বাড় বাড়ন্ত হয়। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে এরা বার্তা পায় যে এরা এগুলো করলে বিপদে পড়বে না। সেটার কারণেই আজকে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন সরকার বলছে তারা ব্যবস্থা নিবে। আমি আশা করি,  সরকারের এই কথা আক্ষরিক অর্থে কার্যকরী হবে। 
 

প্রশ্ন: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে চারপাশে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে মানুষ রাজপথে নেমেছে, কিভাবে দেখছেন? 
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শুধু জাতিগত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাই নয়, অন্যদের মধ্যেও এই নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। যেমন: পথে ঘাটে ছিনতাই, ডাকাতি বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য অনেকেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছেন। আমি মনে করি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে তার একটা দায়িত্ব রয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন না। সামগ্রিকভাবে সরকারের সবাই সিদ্ধান্ত নেন। সুতরাং দায়দায়িত্ব পুরোপুরি সরকারের উপর বর্তায়। 
 

প্রশ্ন: সরকার শপথ নেয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আপনারা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি করলেন। অভূতপূর্ব পরিবর্তনের পরে এত দ্রুত কেন অধিকার আদায়ে কমিটি করতে হলো?  
তৃতীয় গণঅভ্যুত্থান দেখলাম, অস্থায়ী সরকার গঠিত হতে দেখলাম। ৬৯ এর অভিজ্ঞতা, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান সেগুলোর মধ্যে একধরনের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল।  সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দল ও সংগঠিত শক্তি ছিল। এগুলোর পরেও দেখা গেছে মানুষ যেভাবে আশা করেছিল সেভাবে আশা পূরণ হয়নি। কিন্তু তখন সুনির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠী ইত্যাদি ছিল। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের একটা বড় পার্থক্য হলো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তি ছিলোই না যে তারা প্রকাশ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা একধরনের বিকেন্দ্রীকৃত গণঅভ্যুত্থান আমরা বলতে পারি। যার কোনো সুনির্দিষ্ট কেন্দ্র ছিল না। তার ফলে দায়দায়িত্ব নেয়ার মত কেউ ছিল না। কে দায়িত্ব  নিবে, কাকে মানুষ জবাবদিহি করবে। সমাজের মধ্যে অনেক ধরনের শক্তি রয়েছে, আবার অনেক ধরনের অগণতান্ত্রিক শক্তিও রয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি, নারী বিদ্বেষী শক্তিও রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে। সুতরাং আমাদের কাছে মনে হয়েছে নাগরিকদের পক্ষ থেকে একটা সতর্ক অবস্থান থাকা দরকার। যাতে এই গণঅভ্যুত্থানের উল্টো যাত্রা না হয়। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা আসছে এটার উল্টো যাত্রা হলে সর্বনাশ হবে। উল্টো যাত্রা যাতে না হয় সেজন্য নাগরিক হিসেবে আমরা মনে করি আমাদের একটা দায়িত্ব সতর্ক থাকা, সরকারকে সতর্ক করা এবং জনগণের মধ্যেও গণতান্ত্রিক শক্তিকে সক্রিয় করা। 
 

প্রশ্ন: অভূতপূর্ব পট পরিবর্তনের পর একাত্তর আলোচনায় এসেছে নানাভাবে। কখনও কখনও একাত্তরকে বাইপাসের চেষ্টাও হয়েছে এমন জনশ্রুতি আছে, কিভাবে দেখেন? 
আমি মনে করি, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে বাংলাদেশ কখনো ঠিকমত অগ্রসর হতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে মানুষের যে ঐক্য, সাহস, প্রতিরোধের যে শক্তি এবং যে স্বপ্ন এবং জনগণের যে ভবিষ্যৎ দর্শন এগুলোর উপরই দাঁড়াতে হবে। এগুলোর স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি, বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। তার থেকে বের হয়ে সামনের দিকে যেতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপরই দাঁড়াতে হবে। ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান থেকেও আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশাকেও আমাদের ধারণ করে অগ্রসর হতে হবে। তার মানে জনগণের যে ভাষা, তার যে সাহস, শক্তি, ঐক্য ও প্রত্যাশা এগুলোর উপরই আমাদের দাঁড়াতে হবে। আর দাঁড়াতে গেলে অবশ্যই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যাবে না। আমরা দেখলাম কারও কারও বক্তব্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করার একধরনের প্রবণতা বা অপচেষ্টা রয়েছে। এই কারণেই এ ধরনের অপচেষ্টার প্রতিবাদে প্রতিক্রিয়াও হয়েছে, আশা করি এই ধরনের তৎপরতা আর এগুতে পারবে না।  
 

প্রশ্ন: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আন্দোলনের সময়। শিক্ষকরা নানাভাবে এখনও আন্দোলনে। শিক্ষায় কোটা নিয়ে আন্দোলন হলো এখন পরিস্থিতি কতটুকু বদলেছে? 
পরিস্থিতি বদলাতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশেই ছিলেন। শিক্ষার্থী, শিক্ষকের ঐক্য গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল তখন। সেই জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের দায়িত্বটা অনেক বেশি, যেহেতু তারা গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিল। গণঅভ্যুত্থানের পরে যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না হয়। মানুষের মধ্যে যদি আবার বিপন্নতা তৈরি হয়, প্রত্যাশা ভঙ্গ থেকে যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমন কিছু গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিচ্ছে যারা মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক অধিকার ও এই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বিরোধী। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অবশ্যই দায়িত্ব থাকে সেটাকে মোকাবেলা করার। পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গণঅভ্যুত্থানের সময়ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। এখনও শিক্ষকরা সজাগ আছেন সার্বিক পরিস্থিতিতে এটাকে আমি খুবই ইতিবাচক বলে মনে করি। 
 

প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নাম পরিবর্তনসহ বেশকিছু ইস্যুতে বিতর্ক হচ্ছে। দখলদারিত্ব নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। 
আমি খুবই বিস্মিত যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকা, ইতিহাসবোধ থাকার কথা, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকার কথা। কিন্তু কি ধরনের লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনে রয়েছে তাদেরকে নিয়ে আমি বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনে কারা রয়েছে যাদের কারণে জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বসু, লালন শাহ্‌, জীবনানন্দ দাশ এই ধরনের নামগুলো বিভিন্ন ভবনের নাম থেকে বাদ যেতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার জায়গা অথচ সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানের মানুষদের জায়গা থাকবে না? এই গুণী ব্যক্তিদের নামে আসলে বড় বড় প্রতিষ্টানের নামকরণ হওয়া উচিৎ। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট সদস্য কারা তাও সবার জানা দরকার। এরা আরেক ডিগ্রি বেশি অপরাধী। আগে যেভাবে পাইকারি হারে শেখ মুজিবের নাম দেয়া হয়েছে এগুলো এখন বাদ যাবেই। তার আত্মীয় স্বজন, পরিবারের সদস্যদের নামও থাকবে না। কারণ তারা যেভাবে পাইকারি হারে তাদের পরিবারের নামে করেছে সেটার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এগুলো বাদ যাবে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে তাই বলে শেখ মুজিবের নাম বাদ দিয়ে শাহ আজিজের মতো বিতর্কিত একজন ব্যক্তির নামে কিভাবে করতে পারে একটি প্রতিষ্টানের সিন্ডিকেট সদস্যরা? শেখ মুজিবের নাম বাদ দিয়ে আরও জ্ঞান বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির নাম যুক্ত করা যেতে পারে। শাহ আজিজ, যার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার অভিযোগ রয়েছে, যার জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই তার নাম কি করে আসতে পারে? আমি মনে করি, এটা গুরুতর অপরাধ। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিকভাবে এ বিষয়গুলো দেখা দরকার, এটা কি করে হতে পারে? বেশকিছু ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যারা ওই দায়িত্ব পাওয়ার উপযুক্ত নয়। তাদের পদায়ন কিভাবে হলো তার দায়দায়িত্ব সরকারের উপর পড়ে। 
 

প্রশ্ন: এটা কি সরকারের অনুগতদের বসানো হয়েছে নাকি যোগ্য লোক খোঁজা হয়নি বলে সমস্যা হচ্ছে? 
সরকার পতনের পর ভিসি, প্রোভিসিদের অনেকেই পালিয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এমন অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেবারই কথা। এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল যারা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু দলীয় পরিচয়ে, কাদের লবিং বেশি সেভাবেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এমন লোকও নিয়োগ দেয়া হলো যার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট নকল করার অভিযোগে ব্যবস্থা নিয়েছে। এমন ব্যক্তিকে যদি উপাচার্য বানানো হয় তাহলে যা হবার তাই হয়েছে। আমি মনে করি, সরকারের এই ক্ষেত্রে যেসব ভুল হয়েছে সেগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। ভবিষ্যত নিয়োগের ক্ষেত্রে আরো সচেতন হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সামনে কিছু লোক মব সন্ত্রাস করে অমুককে নিয়োগ দিতে হবে, অমুক বাদ দিতে হবে বলবে আর ভয় পেয়ে সরকার মেনে নেবে এটাতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া হতে পারে না। শেখ হাসিনার অপরাধগুলোর অন্যতম হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ করে ফেলা। উপর থেকে আদেশক্রমে প্রতিষ্ঠান চলতো তখন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার যে নিজস্ব শক্তি রয়েছে সেটাকে নষ্ট করে ফেলেছিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাড় করানো অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ছিলো। বর্তমানে যদি মব দিয়ে বা দলীয় লবিং দিয়ে প্রতিষ্ঠানের পদ পূরণ হয় তাহলে তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। প্রতিষ্ঠান তো দাঁড়াতে পারছে না। প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে না পারলে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারবো না। এই বিষয়ে সরকারের পুর্নবিবেচনা, পুনর্মূল্যায়ণ ও ভুল সংশোধন করে যথাযথ ভূমিকা নেয়া উচিত। 
 

প্রশ্ন: যে ছাত্ররা আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন তারা সরকারেও আছে, রাজনৈতিক দলও গঠন করেছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা কি সাত মাসে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। 
না, শিক্ষাব্যবস্থা সাতমাসে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। শিক্ষা ব্যবস্থা শেখ হাসিনার সময়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি। গত সাতমাসেও এর পুনরুদ্ধার হয়নি। আমরা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপারে দেখলাম অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্ত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সমস্যা রয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তও হয়নি। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছিল। গত সাত মাসেও এই বিষয় নিয়ে কোনো তদন্ত দেখা যাচ্ছে না। সত্য মিথ্যা সবার কাছে পরিস্কার করতে হবে। পরিস্কার করে একটা যথাযথ ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে। 
 

প্রশ্ন: সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধান সংস্কার। আপনি কিভাবে দেখছেন? 
সংবিধানের মধ্যে গুরুতর সমস্যা রয়ে গেছে। এই সংবিধান প্রণীত হয় মুক্তিযুদ্ধের উপর ভর করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল তার প্রভাবে সংবিধানে বেশ গুরুত্বপূর্র্ণ জায়গা আছে যেগুলো আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। আবার শাসক শ্রেণি যারা ক্ষমতায় আসছে বিশেষ করে ৭২ সাল থেকেই প্রথমে একদলীয় শাসন হয়েছে, তারপর সামরিক শাসন হয়েছে ১৫ বছর। তারপরে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারাও নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। ক্ষমতাকে স্থায়ী করার জন্য সংবিধানকে বারবার সংশোধন করেছে ক্ষমতাসীনরা। সংবিধান সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দলিলে পরিণত হয়েছে। সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক ও অধিকতর স্বৈরতান্ত্রিক করা হয়েছে। সংবিধানের যেসব পরিবর্তনের ফলে স্বৈরাচার জম্ম নিয়েছে সে সকল জায়গা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। কিছু অংশ ধারাবাহিকতা রাখতে হবে আর বড় একটা অংশ সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে এমনভাবে সংশোধন করতে হবে যাতে গণতান্ত্রিক, অসামপ্রদায়িক, বৈষম্যহীন একটা দেশের যাত্রার ভিত্তি নিশ্চিত করে, নিশ্চিত করতে হবে আর যেন স্বৈরাচার সরকারের জন্ম না হয়। 
 

প্রশ্ন: গণপরিষদ নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির মাঠে বিতর্ক চলছে, আপনি কিভাবে দেখছেন? 
বিগত নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করে সুষ্ঠু নির্বাচন করা বর্তমান সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হতে হবে। সরকারের যে অবস্থা তাতে দুটো নির্বাচন করা সম্ভব হবে বলে মনে করি না। রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই এ বিতর্কের নিরসন সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হয় যে নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হবেন তারাই প্রথমে গণপরিষদের দায়িত্ব পালন করবে এবং পরে তারাই সংসদ সদস্য হিসাবে কাজ করবে।  উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা বলা যায়, সেখানে একই সাথে গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। তার মানে নির্বাচন একটাই হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রথমে সংবিধান সংশোধনের ভূমিকা পালন করবে পরবর্তীতে তারাই নিয়মিত সংসদের ভূমিকা পালন করবে। এ ব্যাপারে আমার মনে হয় না রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত থাকবে। কারণ সকলেই সংবিধানের সংশোধনের কথা বলেছে। ঐকমত্য থাকলে যারাই নির্বাচিত হোক সংবিধানের সংশোধনে সমস্যা হবে না। 
 

প্রশ্ন: নির্বাচন নিয়েও তো বিতর্ক রয়েছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের কথা বললেও সদ্য গঠিত এনসিপি বলছে এখনও নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি নেই? 
বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি এবং সরকারের যে অবস্থা তাতে আমি মনে করি নির্বাচন তাড়াতাড়ি হওয়া উচিৎ। তার মানে এই নয় যে বেশি তাড়াহুড়ো করতে হবে। তাড়াতাড়ি আর তাড়াহুড়ো এক কথা নয়। যথাযথ নির্বাচন করার জন্য যে যে সংস্কারগুলো করা দরকার সেগুলো সংস্কার করেই নির্বাচন দেয়া উচিৎ। 
 

প্রশ্ন: এনসিপির ছাত্র নেতারা এমনও বলছেন, শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কথা না বলতে?
এই দাবি কার্যকর করা সম্ভব নয় কারণ বিচার তো এত সহজ নয়, তড়িঘড়ি করা ঠিক নয়। বিচারের আন্তর্জাতিক মানদন্ড ও গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা এ সরকারের দায়িত্ব, কিন্তু বিচার শেষ করতে একটা অনির্দিষ্টকাল সময় লেগে যাবে। এরকম অনির্দিষ্টকাল অস্থায়ী সরকার থাকা বাংলাদেশের জন্য ঝুকিপূর্ণ হবে। আমি মনে করি, নির্বাচনকে এরকম কোনো শর্তের মধ্যে নিয়ে আসা ঠিক হবে না। অস্থায়ী সরকারের কাজ হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়া যথাযথভাবে এগিয়ে নেয়া, পাশাপাশি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংস্কার করে নির্বাচন দেয়া। 
 

প্রশ্ন: সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু কথা বলেছেন, আপনি কিভাবে দেখছেন? 
সেনাপ্রধান তার কিছু বক্তব্যে কিছু প্রত্যাশার কথা বলেছেন। এ সরকারকে সেনাবাহিনী সমর্থিত বলা হচ্ছে না ঠিকই, তারপরেও সেনবাহিনী অবশ্যই ক্ষমতার অংশীদার। সেনাবাহিনী সবসমই ক্ষমতার অংশীদার বিশেষ করে স্থায়ী সরকারের অংশ হিসাবে। সুতরাং তার ক্ষমতার ভিত্তিতো অবশ্যই আছে। ইনক্লুসিভ নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য ঠিকই আছে কিন্তু বাহিনীগুলোকে আন্ডারমাইন করা বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা আমি জানি না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তো যারা দায়িত্বে আছেন তাদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ থাকবেই। তাই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করা যাবে না এটা বললে তো হবে না। সেনবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া আছে। সেনাবাহিনী যৌথবাহিনী হিসেবে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করছে। এ অপারেশনে যদি দেখা যায় অপারেশন ডেভিল হান্ট কাজ করছে না, আটক বাণিজ্য হচ্ছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড হচ্ছে তাহলে তো মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করবেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম তো দীর্ঘদিনের সামরিকীকরণের সমস্যা। পাইকারিভাবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছড়ানোর বিরোধী আমি, যদি কেউ অযৌক্তিভাবে করে থাকেন আমি এর নিন্দা জানাই। তবে সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে উদ্যেগ নেয়া উচিত, মানুষের মধ্যে যদি ক্ষোভ থাকে তা কেন? সেনাবাহিনী যে দায়িত্ব নিয়েছে সেই দায়িত্ব পালন, জনগণের প্রত্যাশা কি ছিল আর তাদের মধ্যে হতাশা কি কারণে তৈরি হচ্ছে এটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা। সে অনুযায়ী তাদের যে দায়িত্ব তা যদি পুর্নবিন্যাস ও পুর্নমূল্যায়ণ করতে হয়, সেটা করা। 
 

প্রশ্ন: ইনক্লুসিভ বা অন্তর্র্ভূক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে নানা কথা আলোচনায় আছে। অনেকেই বলছেন, এর মাধ্যমে কি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে? 
যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে হত্যা, গুম, খুন, সম্পদ লুণ্ঠন, সম্পদ পাচার করেছে তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। এর বাইরে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নাই তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে আমি কোন বাধা দেখি না। ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দটা যেভাবে ব্যবহার হয় তা প্রকৃতই যদি কার্যকর করতে হয় তাহলে আমাদের সমাজের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ রয়েছে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হবে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন। এটা নিশ্চিত করা যে পরিচয়ের কারণে, রাজনৈতিক মতের কারণে কেউ যেন নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। 
 

প্রশ্ন: আপনার কথার মধ্যেই আছে সকলের অংশগ্রহণ। কিন্তু শেষ সাত মাসে মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে, বাউল মেলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এটা কিসের আলামত? সরকারি হিসাবেই বেশকিছু স্থানে সংখ্যলঘু সম্প্রদায় হামলার শিকার হয়েছে। 
আমাদের সমাজের মধ্যে বৈষম্যহীন রাজনীতি বা মতাদর্শ সেটার একটা প্রত্যাশা আমরা দেয়াল চিত্র বা গ্রাফিতিতে দেখি। কিন্তু বৈষম্যহীন রাজনীতির মতাদর্শ এগিয়ে নেয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে এখনও খুবই দুর্বল। বরং বৈষম্যবাদী রাজনীতি মতাদর্শের অনেকরকম তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। একই ধর্মের মধ্যে, মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্ন ঘরানা রয়েছে। কেউ মাজারে বিশ্বাস করে, কেউ করে না, কেউ মাহজাবি, কেউ না। মাহজাব রয়েছে ৪ ধরনের, পীর আছেন বহুধারার। ইজতেমা নিয়ে আমরা দেখলাম দুই গ্রুপ। তাদের মধ্যে মারামারি হয়ে খুনও হলো। সুতরাং এক ধর্মের মধ্যে বহু রকম ধারা থাকতে পারে। কোনো একটা ধারা যদি মনে করে যে সে ক্ষমতাশালী এবং সে অন্যদের উপর চড়াও হয় এটাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদী ধরন এবং সেটাই বৈষম্যবাদী রাজনীতির মতাদর্শ। সেটারই প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি, কখনও নারীর উপর, কখনও ভিন্নমতের মানুষের উপর- গান বাজনা করা যাবে না, খেলা যাবে না, চলাফেরা করা যাবে না,  বলে জোর জবরদস্তি করা হচ্ছে। এটা করা যাবে, ওটা করা যাবে না। আগে আওয়ামী লীগের মধ্যে যেমন ট্যাগিং করা, জোরজবরদস্তি, স্বৈরতান্ত্রিক প্রকাশ আমরা দেখেছি, এখনও কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলোরই প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। 
বৈষম্যবাদী রাজনীতি মতাদর্শ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে গেলে অবশ্যই ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি, ভাষা ও শ্রেণি সম্পর্কে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। যদি কোনো নির্দিষ্ট পক্ষে রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করে বা পক্ষপাত দুষ্ট হয় তাহলে সেটা ইনক্লুসিভ হতে পারবে না। ইনক্লুসিভ আইডিয়াটা কি? ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা সেনাপ্রধান বলছেন, সরকার বিভিন্ন সময়ে বলছে, সরকার সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছে। কিন্তু ইনক্লুসিভনেসের বিরোধী যে তৎপরতা তাদের দাপট দেখা যাচ্ছে, এদের থামাতে হবে যাতে ইনক্লুসিভনেসটা সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। 
 

প্রশ্ন: তার মানে কি ঘটে যাওয়া নানা কার্যক্রমে ফ্যাসিবাদের আলামত শেষ সাত মাসেও ছিল? 
হ্যাঁ আছে। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার নানা উপাদান যথেষ্ট শক্তিশালীভাবেই আছে। এছাড়া স্থায়ী সরকারের যে তিনটি উপাদান বললাম তারাও তো বহাল তবিয়তেই রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন তৎপরতা রয়েছে। ভারতের যে ভূমিকা আমরা গত সাত মাসে দেখলাম এটা মোটেও কূটনৈতিক ভূমিকা না। এটা আনডিপ্লোমেটিক হয়েছে। প্রতিবেশি দেশের সরকারের পতন ঘটছে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, এটা নিয়ে তার এতো রাগ অভিমান কেন থাকবে? কেন তা দেখাতে স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ করে দেবে? ভারতের উচিত সম্পর্ক যাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে, জনগণ কি চায়, এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া। যুক্তরাষ্ট্রও কেমন ভূমিকা পালন করে এটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি বড় পক্ষ বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে। সেগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে সরকার জনগণের স্বার্থ নিয়ে যদি না দাড়ায় তাহলে দেশের ভেতরে এবং বাইরে বৈষম্যবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী নানারকম তৎপরতা করতে থাকবে। সেজন্য তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে হবে, সক্রিয় ও সরব থাকতে হবে। এটাই আমরা বারবার বলছি। 
 

প্রশ্ন: সরকারের নানান দায়িত্বে আপনার নাম আলোচনায় ছিল, ছিল পদক দেয়ার তালিকায়ও। কিন্তু কোনটাই গ্রহণ করেন নি, কেন? 
এই সমস্ত পদক নেয়া বা পদে যাওয়ার কী দরকার? তাছাড়া প্রত্যেকেরই দায় দায়িত্ব, পরিচয় ও অঙ্গীকারের ব্যাপার আছে। অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে বর্তমান যেসব বিষয়ে কথা বলা দরকার বা ভূমিকা নেয়া দরকার সেসব বিষয়ে কথা বলা, ভূমিকা নেয়া, সরব থাকাটা  দায়িত্ব। মানুষ হিসেবে বা নাগরিক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত। সেটা সরকারের পক্ষে যাবে যদি তারা জনগণের পক্ষে কাজ করে, সরকার যদি জনস্বার্থ বিরোধী তৎপরতা করে তাহলে বিরোধী হবে। 
 

প্রশ্ন: সাত মাসও তো দেখলেন, কিভাবে রাষ্ট্র চললে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠিত হবে আগামী দিনে? 
নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা নেয়াটাই একমাত্র রক্ষাকবচ। আমি যখন দেখি মেয়েরা নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে জমায়েত হচ্ছে, কথা বলছে, শিক্ষকরা সরব হচ্ছে, শ্রমিকরা সরব হচ্ছে, মানুষ প্রশ্ন তুলছে সেটাই ভরসা। নাগরিকদের বিভিন্ন অংশের সক্রিয় অবস্থান না থাকলে বাংলাদেশ বিপদ থেকে বের হতে পারবে না। কারণ উগ্রবাদী সন্ত্রাসী বৈষম্যবাদী আধিপত্যবাদী কিংবা জনস্বার্থবিরোধী দেশি বিদেশি গোষ্ঠী যথেষ্ট তৎপর, নানাভাবে তারা নিজেদের অবস্থান গোছানোর চেষ্টা করছে বা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। সুতরাং একমাত্র রক্ষাকবচ হচ্ছে নাগরিকদের অধিক সক্রিয় থাকা। নারীদের সোচ্চার অবস্থান, শ্রমিকসহ নাগরিকদের সক্রিয়তা আশা ভরসা দেয়। এটা আরো বাড়াতে হবে তাহলে আমরা সবাই নিরাপদ থাকব। বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক আকাঙ্খায় দেশের নাগরিকদের সক্রিয়তার উপর নির্ভর করে দেশ নিরাপদ থাকা, অগ্রসর হওয়া। 


অনুলিখন: আরিফুল ইসলাম