Image description

ঢাকায় বসেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের সঙ্গে এই দীর্ঘ কথাবার্তায় অংশ নিয়েছেন অর্ক দেব। কথায় কথায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের অকথিত অধ্যায়, জনতার মনস্তত্ত্ব, স্বাভিমান, স্পর্ধা। বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে? কেন দেখা যাচ্ছে আইসিস-এর পতাকা? প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন মাহফুজ আলম।

অর্ক: প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে বলেছিলেন এই বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড। এখন, এই পরিস্থিতিতে কী মনে হচ্ছে, এই ট্যাগ আপনার জন্য স্বস্তির না অস্বস্তির?

মাহফুজ: যখন তিনি প্রথমদিকে এলেন, ভেবেছিলেন আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা সত্ত্বেও নেপথ্যে কিছু কিছু ট্রিগার কাজ করেছে। কেউ লিড দিয়েছে, কেউ বুদ্ধি দিয়েছে। এই জায়গা থেকেই তিনি হয়তো এমন কথা বলেছেন। কিন্তু যেভাবে ফ্রেমিংটা হয়েছে দেশে-বিদেশে, তা আমার জন্য অবশ্যই অস্বস্তিকর। আবার সম্প্রতি তিনি দাবোসে ব্যাখ্যা করছেন, এটা অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল। আমার জায়গা থেকে যেটা ব্যাখ্যা, আমি অবশ্যই কিছু স্ট্র‍্যাটেজিক্যাল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সাপোর্ট এই আন্দোলনে দিয়েছি, নিজেও অংশগ্রহণও করেছি প্রতিদিনের সক্রিয়তায়। কারফিউয়ের সময় হয়তো সব দিন যেতে পারিনি, আবার ৩ অগাস্ট আমি নিজে এসে শহিদ মিনারে বক্তৃতা দিয়েছি, নাহিদের বক্তৃতার পরে। আমি আমার মতো কন্ট্রিবিউট করছি। কন্ট্রিবিউশনটা হয়তো তিনি স্নেহবশত বড় করে দেখছেন। কেউ এটাকে এত বড় করছেন তা আমার জন্য আসলে অস্বস্তির হয়েছে, আবার এটা আমাকে অপমান করার ক্ষেত্রেও অনেকের কাজে লাগছে। আমি মনে করি, আমার এত উচ্চতায় যাওয়া উচিত না যে উচ্চতা থেকে ধপাস্‌ করে পড়ে যাব। আমি যেটা করেছি, এরকম আরও দশজন নানা ভূমিকা পালন করেছে, সবাইকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কারণ এটা গণ অভ্যুত্থান, এটা আমার একার কাজ নয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ নিজ নিজ ভূমিকা পালন করেছে। হয়তো আমরা তাঁদের চিনিও না। তাঁরা হয়তো কেউ লিখেছেন, কেউ ইন্টারভিউ দিয়েছেন, কেউ যখন কারফিউ চলছিল, বিবৃতি পাঠিয়েছেন বিদেশে। আমরা আট-দশজন লোক ছিলাম যারা আলোচনা করতাম, সিদ্ধান্ত নিতাম। ওইখানে আমার ভূমিকা একটু মুখ্য ছিল। এছাড়া অনেকের ভূমিকা মিলিয়েই অভ্যুত্থান।

অর্ক: শেখ হাসিনা অন্য দেশে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নৈরাজ্যের আয়োজন করেছেন বলে অনেকের অভিযোগ। ৩২ ধানমন্ডিতে ব্যাপক ভাঙচুর নাকি তাঁর বক্তব্যেরই প্রত্যুত্তর। কিন্তু সরকার তো হাসিনার না, সরকার তো আপনার। ফলে যা হচ্ছে যা হবে দায় আপনারই। এই ঘটনা কেন এড়ানো গেল না?

মাহফুজ:  হ্যাঁ ঠিকই, এটা এড়ানো গেলে না। আসলে ৩২ এর বাড়ি-দালান-ভাস্কর্যের উপরে মানুষের ক্ষোভ ছিল ফ্যাসিবাদের স্মারক হিসেবে। শেখ হাসিনাকে তো আর মানুষ সামনে পাচ্ছে না। তাঁর যে ভাই-বেরাদার, কাউকেই তো সামনে পাচ্ছে না। পাচ্ছে একটা দালান, একটা ভাস্কর্য। তখন এর উপরেই তার ক্ষোভ মেটাচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়া আরও এগোনো গেলে এই ঘটনা হয়তো ঘটত না, মানুষ এ ভাবে সঙ্ঘবদ্ধ হতো না। এই শৃঙ্খলাভঙ্গ আসলে মানুষের চাপা ক্ষোভের প্রকাশ। আর শেখ হাসিনার উস্কানিতে, ইন্ধনে এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ এমন চেহারা নিয়েছিল। আর একটা কথা, শেখ হাসিনা তাঁর বাবাকে দেবত্ব আরোপ করেছেন, তা নিয়েও মানুষের ক্ষোভ ছিল, '৭২-'৭৫ সম্পর্কে মানুষ অবহিত, কাজেই এই দেবত্ব আরোপ তারা ভালোভাবে নেয়নি। আমাদের কাজ এই ক্ষোভকে চ্যানেলাইজ করা। বিচারই সেই ক্ষোভ প্রশমনের একমাত্র পথ, বিচার এগিয়ে আনতে পারলে এমনটা হতো না।  আমরা চাইনি নতুন করে, ৫ অগাস্টের পরে এভাবে ঘটনাটা ঘটুক কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যদি আমরা মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করতাম, ওখানে যে কোনেও ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মরাল এখনও অনেক লো। জনতা-সেনাবাহিনী মুখোমুখি দাঁড় করলে আমরা আরও সংকটে পড়তাম। কারণ সেনাবাহিনী কিছুটা আস্থা নিয়ে মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। এটা আমাদের জন্য ইন-বিটুইন সিচুয়েশন ছিল। আমরা হাত দিতে গেলে হাত পুড়ে যাবে জানতাম। আবার বসেও থাকতে পারছি না। পরে যখন এটা ছড়িয়ে পড়ছিল, বিভিন্ন জায়গায় হামলা হচ্ছিল বা বিভিন্ন জায়গায় মানুষ ক্ষোভ দেখাচ্ছিল, বিভিন্ন জায়গায় জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি শুরু হয়ে গেল, তখন আমরা মনে করলাম এইবার যে কোনেও মূল্যে এটাকে আটকাতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার, রাজনৈতিক নেতা সবাইকে এনগেজ করে আমরা বৃহস্পতিবার রাত্রি থেকে বার্তা দিতে শুরু করলাম, কোনওভাবেই যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। আমাদের একটা শঙ্কাও ছিল, শুধুমাত্র হয়তো দালানকোঠাতে বা ভাস্কর্যে মানে শেখ হাসিনার চৌহদ্দিতেই এটা সীমিত থাকবে না। এটা হয়তো মাজার ভাঙা বা সংখ্যালঘু পরিবারের উপরেও আঘাত হিসেবে নেমে আসতে পারে। আমরা অনেক সতর্ক অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলাম। এটা (৩২ ধানমন্ডির বিক্ষোভ) কন্ট্রোল করতে পারিনি, কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি আর কোথাও যেন হামলা না হয়। বৃহস্পতিবার রাতের পরে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়।

অর্ক: বাংলাদেশের সরকার চালাচ্ছেন মাহফুজদের মতো তরুণরা। তাদের মাথায় রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু আপাতভাবে দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের সরকার চালাচ্ছে ইউটিউবাররা। দু'জন ইউটিউবার, ইলিয়াস হোসেন, পিনাকী ভট্টাচার্যের নাম বিশেষ করে উঠে আসছে। নাৎসি জমানার গল্পে পড়েছি, বাহিনী সব জায়গায় হামলা করত না। তারা মানুষকে খেপিয়ে দিতে। মানুষই পাশের বাড়িতে হামলা করত। এটাকে রোবটিক মব বলা চলে আর কী, এই প্রশ্ন এ যাবৎ আমি বহুজনকে করেছি। বাংলাদেশের মানুষকে বাইরে বসে কিছু বাংলাভাষী রোবটিক মবে পরিণত করবে, আর আপনারা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। এটা তো ব্যর্থতাই...

মাহফুজ: আমরা মনে করি আসলে আমাদের যদি কিছু ব্যর্থতা থাকে, এই ব্যর্থতার জায়গা থেকে যদি কেউ ওই ক্ষোভটাকে চ্যানেলাইজ করে তাহলে এটা আমাদেরই দায়। এটা ইউটিউবারদের সাফল্য নয়।

অর্ক: কিন্তু পুনরাবৃত্তি আটকাবেন কী করে?

মাহফুজ: সরকারকে আরও প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে বিচারের ক্ষেত্রে, গ্রেফতারের ক্ষেত্রে, যাতে ক্ষোভ না থাকে সমাজে। সমাজের ভিতরে যখন ক্ষোভ থাকে তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে পুতুলনাচ করানো যায়। আমাদের মূল কাজ ক্ষোভের জায়গাগুলি শনাক্ত করে ফেলা। অনেকগুলো ক্ষোভের জায়গা রয়েছে শহিদ পরিবারগুলির। সবাই কিন্তু জানে না যে তাদের খুনিদের আসলেই সরকার গ্রেফতার করছে কিনা বা বিচার চলছে কিনা। বিচার কার্যক্রমটা আসলে আবার আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা। আইসিটি ট্রাইবুনাল চলছে, মানে আমরা যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করতে চাইছি, চাইলে ছ'মাসে আমরা একটা রায় বের করে ফেলতে পারি না। হাসিনা হয়তো করেছেন কিন্তু আমরা করতে পারি না। আমাদের জাতিসংঘ দেখছে, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দেখছে। আমরা চাই যে তারা দেখুক। আমরা অবজার্ভেশনের জন্য ব্যবস্থা রেখেছি, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আসতে পারবেন, আন্তর্জাতিক আইনজীবীরা আসতে পারবেন আইসিটি ট্রাইবুনালের ভিতরে। এই বিচারের প্রক্রিয়া একটু দীর্ঘমেয়াদি কিন্তু মানুষের তো ওই স্থিরতাটুকু নেই। একটা অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি এটা, যেখানে আমরা জানি যে, হাজার-হাজার মানুষ শহিদ হয়েছেন, ১৫-২০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন, সেখানে ক্ষোভ থাকবে। মানে এটা পুরো বাংলাদেশের অবস্থা এখন, বিশেষ করে শহরাঞ্চলগুলোতে যেহেতু প্রচুর মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, মানুষের ভিতরে একটা চাপা ক্ষোভ এখনও রয়েছে। ওই ক্ষোভের বিপরীতে আছে বিচার।

অর্ক: তার মানে বিচারে যত সময় লাগবে ততই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হবে?

মাহফুজ: ক্ষোভ কমে যাবে। কেউ পুতুলনাচ করাতে পারবে না। ধরুন, আমার ধারণা— সীমান্ত হত্যা হচ্ছে, এখন সীমান্ত হত্যা তো আমি ভারতকে বলে অ্যাড্রেস করতে পারছি না। অনেকে বলছে, চলো সীমান্তে যাই। মানুষ বলছে হ্যাঁ, সরকার পারছে না, চলো আমরা যাই। সরকার কী পারছে-কী পারছে না, সেই বুঝে মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের সরকার ৬ মাস আছে। আমি মন্ত্রী হয়েছি নভেম্বরে, আমি যতটুকু বুঝেছি জনগণ (যাকে এখন অনেকে মানে নেগেটিভ অর্থে মব বলছে, আমি তর্কে যেতে চাই না) যখনই দেখে যে আমরা উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছি, তখন মানুষ নিশ্চিন্ত হয়। আমরা ডেভিল হান্ট শুরু করেছি। অপারেশন ডেভিল হান্ট করব আমরা। উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, তারা প্রয়োজনে গ্রেফতার করবে। আপনি দেখবেন, জায়গায় জায়গায় আর হামলা হচ্ছে না। কেন হামলা হচ্ছে না? যখনই মানুষ দেখে যে সরকার সক্রিয়, তখনই মানুষ নিরস্ত্র হয়ে যায়, অসক্রিয় হয়ে যায়। এখন আরও ১০জন ইউটিউবার বললেও আর মানুষ নামবে না।

অর্ক: অপারেশন ডেভিল হান্ট তো শুরু হলো গাজীপুরের ঘটনায়। এতে তো বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন হবে?

মাহফুজ: না, না। এটা আমরা বারবার আলোচনা করেছি যে যাতে কোনওভাবে এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং (বিচার-বহির্ভূত হত্যা) না ঘটে। একটা-দুটো হলেও, আমরা চেষ্টা করব অভিযুক্তকে শনাক্ত করতে, কিন্তু আমরা চাই না একটাও হোক। মানে কোনও এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং হবে না। এক্ষেত্রে যারা শৃঙ্খলা ভাঙছে, আইন হাতে তুলে নিচ্ছে তাদের গ্রেফতার করা হবে। মামলা হবে তাদের বিরুদ্ধে। যে যে ঘটনায় তারা জড়িত, সেই অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। যারা সাবোটেজ করেছে, বিভিন্ন জায়গায়, অনেকগুলো হামলাতে যারা জড়িত ছিল, সরাসরি গুলি করেছে, এই ধরনের অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে ফেলা পুরো দেশে, এটা হচ্ছে আমাদের মূল কাজ। স্পষ্ট বলছি, আমাদের মূল কাজ কোনওভাবে খুন করা না। যেটা হাসিনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। আমাদের মূল কাজ হচ্ছে ওদের প্রতিহত করে জেলে ঢোকানো, বিচার প্রক্রিয়ায় ঢোকানো।

অর্ক: অভ্যুত্থানের সময় একটা অ্যানার্কির মধ্যে যারা জেল ভেঙে বেরিয়ে গেছিলে তাদের মধ্যে তো অনেক সন্ত্রাসী ছিল। তাদের শনাক্ত করে লিস্ট তৈরি করে তাদেরকে জেলে ফেরানো সম্ভব হয়েছে?

মাহফুজ: একটা অংশ নিজেরাই আত্মসমর্পণ করেছে, আমি পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে আমি জানি না যে পুরো অংশটা এখন জেলে আছে কিনা। একটা অংশ আত্মসমর্পণ করছে এবং যারা অস্ত্র নিয়ে বেরিয়েছিল অস্ত্রগুলো জমা দিয়েছে। একটা বড় অংশের অস্ত্র আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি, কিন্তু কিছু অস্ত্র এখনও মানুষের কাছে আছে। আমরা বলতে পারি না কার কাছে আছে। যেমন, আমার উপজেলা যেখানে, ওখানে আমি শুনেছি যে, থানা থেকে যেসব অস্ত্র বাইরে গেছিল তার সবগুলো অস্ত্রই উদ্ধার করা গেছে। অনেক বন্দি বেরিয়ে গিয়েছে, বন্দিরা নিজেরাই জানে যে, দুই দিন পর আমাকেই আগে গ্রেফতার করবে। ফলে, আত্মসমর্পণ করছে। নরসিংদীতে আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটছে। আমি এটা ভেরিফাই করে হয়তো আপনাকে আবার পরে বলতে পারব। দলিল আমার কাছে নেই। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভালো জানে।

অর্ক: অগাস্ট থেকে ডিসেম্বর, চার মাসে গণপিটুনিতে বাংলাদেশে মৃত্যু ঘটেছে ৯৬ জনের। এটা উঠে এসেছে বিবিসি-র প্রতিবেদনে। ৯৬ জন! বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কী বলবেন?

মাহফুজ: আইন শৃঙ্খলায় আমাদের আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। কারণ, পুলিশ সক্রিয় নয়। আর্মি লেথাল ওয়েপন ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করতে পারে না। সেনা দাঙ্গা দমন করতে পারে না। সেনা একটা এলাকার সবগুলো তথ্য জানে না। কারণ, সে ক্যান্টনমেন্টে ছিল। এটা পুলিশ জানে। পুলিশের নিজের সোর্স আছে। পুলিশের আরও অনেকগুলো হ্যান্ডস আছে। ওই স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তার কাজের একটা আলাদা ধরন আছে। ফলে এটা পুলিশের ব্যর্থতা। আমরা মনে করি, পুলিশ অর্গানটাকে আমরা পুনরায় সক্রিয় করতে পারছি না। আরও অনেকগুলো বাস্তবতা আছে। পুলিশের একটা বড় অংশই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল।

অর্ক: এখনও আছে?

মাহফুজ: আছে। ওঁদের তো আমরা ধরে ধরে বাদ দিইনি। তেমনটা করলে আবার একটা ঝামেলা হতো। সরাসরি জনতার বিরোধী, অপরাধে শামিল একটা অংশকে সরানো গেছে। বাকি অংশকে হয়তো আমরা ক্রমে চিহ্নিত করে করার চেষ্টা করব।

অর্ক: কতদিন সময় লাগবে পুলিশকে রিঅ্যাক্টিভেট করতে?

মাহফুজ: এটা একটা প্রক্রিয়া। যেমন, আমি যদি আপনাকে বলি, গণপিটুনিগুলো খুবই দুঃখজনক কিন্তু, গণপিটুনির ঘটনা বাংলাদেশে শুধু অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঘটনা নয়, আগেও ঘটেছে। মানে, এটা বাংলাদেশে কিছু কিছু এলাকায় ঘটে। এলাকায় ডাকাত পড়ছে এটা বলে কাউকে মেরে ফেলল। কিন্তু, এটার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক অথবা যে রাজনীতির সংযোগ থাকবেই এটা সবসময় সত্য নয়। এটা সবসময় পলিটিকাল না। সবসময় সাম্প্রদায়িক না। সাম্প্রদায়িক হওয়ার সম্ভাবনা আমি একবারে দেখি না যে, তাও বলছি না। একটা-দুটো শুনেছি আমি। কিন্তু এর বাইরে, রাজনৈতিক গণপিটুনি হয়তো ৫-৬-৮ অগাস্ট পর্যন্ত হয়েছে। ওরা হয়তো ছাত্রলীগের লোকজন বা ছাত্রলীগের অফিসে হামলা করছে। কিন্তু তারপরেও বলব, গণপিটুনির মতো নিন্দনীয় সংস্কৃতি আছে। মব কালচার আছে। এটা জায়গা পাচ্ছে। ডাকাত বলে একজনকে মারধর করছে। মারার পরে হয়তো সে হাসপাতালে গিয়ে মরে গেল, এরকম অনেক ঘটনা ঘটে। এটা শুধুমাত্র এই সময়ে হচ্ছে এমন নয়। এই জিনিসগুলো প্রতিনিয়ত হচ্ছে, কেন হচ্ছে? আমি স্থানীয় প্রশাসনের পুলিশকে সক্রিয় করতে পারছি না। সেনাবাহিনী থাকার কারণে মানুষ এক ধরনের সমীহও করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা জিনিসটা তো সেনাবাহিনীর কাজ না। সেনাবাহিনী তো ওটা কন্ট্রোল করতে পারে না।

অর্ক: সেনাবাহিনী তো একার্থে বহিরাগত।

মাহফুজ: হ্যাঁ, একটা গ্রামের ভেতরে সেনাবাহিনী জানে না কীভাবে যাবে। এখন থানাতে ওদের ক্যাম্প। সেই থানা থেকে যদি ১৫ কিমি দূরে একটা ঘটনা ঘটে, ওরা গ্রাম চেনেও না। রাত্রে ধরুন একটা হামলা হয়েছে। কীভাবে যাবে ওখানে? লোকাল নেটওয়ার্ক নেই। অ্যাসোশিয়েশন নেই। পুলিশের কিন্তু খুব নেটওয়ার্ক। অনেক সোর্স থাকে। তাদের একটা সিস্টেম আছে খবর আগাম সংগ্রহ করার। ওই সিস্টেমের কারণে তারা খুব দ্রুতই খবর পায়। মানে,যদি একটা ঘটনা ঘটে, পুলিশ ৩০ মিনিটে পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু সেনাবাহিনী গত ছয় মাসে এটা অর্জন করতে পারেনি। এই দক্ষতা সেনাবাহিনীর অর্জন করার চিন্তাটাও অস্বাভাবিক। দু'জনের কাজ আলাদা।

অর্ক: আচ্ছা, আপনি দফতরবিহীন উপদেষ্টা। এটা কি ক্ষমতাবিহীন দায়িত্ব না দায়িত্ববিহীন ক্ষমতা? আপনার দায়িত্বের জায়গাগুলি কী কী?

মাহফুজ: এই সরকার যখন গঠিত হয়েছে, দু'জন ছাত্র মন্ত্রক পেল। অন্য যাঁরা মন্ত্রক পেলেন, তাঁদের একটা অংশ সাবেক অ্যাক্টিভিস্ট। রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী। মানবাধিকার কর্মী। টেকনোক্র্যাট। আছেন কিছু সাবেক আমলা এবং সাবেক মিলিটারি পারসোনাল। আর আমার কাজটা হচ্ছে রাজনৈতিক বোঝাপড়াগুলি তুলে ধরা। সরকারের কিছু রাজনৈতিক দায় আছে। সেই দায়টা পালন হচ্ছে কিনা তা সব সময় আমার পর্যবেক্ষণে ছিল গত চার-পাঁচ মাস। আমি কমিউনিকেশনগুলো করেছি প্রফেসর ইউনূসের পক্ষ থেকে। স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট ছিলাম, স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট থেকে অ্যাডভাইজার হয়েছি। দফতরবিহীন মন্ত্রী বলছেন, যখন বিবেচিত হই সে সময় তো দফতরের প্রশ্ন আসে না। এটা নভেম্বর থেকে হয়েছে, যাতে আমি ক্যাবিনেট মিটিংয়ে আমি অংশ নিতে পারি। এতটুকুর জন্যই যাতে অন্তত ওইখানে যে পলিসিগুলো নেওয়া হচ্ছে সেখানে আমি আমার মতামত দিতে পারি।

অর্ক: আপনাদের সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে এই সরকার জেলায় যায় না। কী বলবেন?

মাহফুজ: এটার পজিটিভ-নেগেটিভ আছে। জেলায় গেলে বলবে আমরা রাজনীতি করছি। আমরা দল গোচ্ছাছি। আবার জেলায় না গেলেও চলে না। স্থানীয় প্রশাসন যদি কোথাও দেখে যে এই মন্ত্রী আসছে, তখন সে অ্যাক্টিভেটেড হয়। অন্তত এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ তাঁর, মানে এক ধরনের জোশ থাকে। কিন্তু এটা আমাদের হয় না কারণ, সরকার একেবারে ওয়ার্ড লেভেলের লিডারশিপ থেকে শুরু করে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের তো সর্বসাকুল্যে ২৪টা লোক। ধরুন চট্টগ্রামের মেয়র একজন। ওঁর কিন্তু ওয়ার্ড কাউন্সিলরও নেই। হি ইজ রানিং দ্য শো। আমাদের কাজ নির্বাচন সংস্কার। বিচারের কাজটা অগ্রসর করে দেওয়া। বিচার-নির্বাচন করে চলে যাওয়া।

অর্ক: আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আপনাদের কাজ না?

মাহফুজ: আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, দ্রব্যমূল্য হ্রাস অবশ্যই আমাদের কাজ। কিন্তু এগুলিকে হাতেকলমে রোজ করার সামর্থ্য পুরো দেশব্যাপী থাকতে হবে তো। আমাদের সঙ্গে তো ব্যবসায়ীরা যুক্ত নন। একটা দলের সঙ্গে তো ব্যবসায়ীরা যুক্ত থাকে। দলের কথা ব্যবসায়ীরা শোনে। একটা দলের সঙ্গে শিক্ষকরা যুক্ত থাকে। শিক্ষকের কথা শোনে। আমাদের কথা তত লোক শোনে না কারণ আমার ওই কোটারিগুলো নেই। ওই কোটারিগুলো আওয়ামী লীগের আছে। বিএনপি-র আছে। জামায়াতের আছে। এদের কেউ সরকার ক্ষমতায় থাকলে ওই কোটারিগুলোকে দিয়ে এই সেগমেন্টগুলোকে সে চালিত করতে পারত। প্রভাবিত করতে পারত। আমার তো সে সুযোগটা নেই। আমরা অনেকটা উপর থেকে চালাচ্ছি। সদিচ্ছা দিয়ে চালাচ্ছি। মানুষ সদিচ্ছা দিয়েই আমাকে দেখছে। মানুষ বলবে, ইউনূস সরকার ভালো। কিন্তু আমরা (মানুষ) তাদেরকে কাজ করতে দিচ্ছি না। আমাদের (ব্যক্তিগত ভাবে) দোষ দেবে। কিন্তু ইউনূস সরকারকে দোষ দেবে না। কারণ সরকারে সবাই যে রেসপন্সিভ এটা সবাই জানে। যদি একটা ঘটনা ঘটে আমরা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিই। যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা কথাবার্তা তৈরি হয়, অমুক কাজটা লাগবে, পরের দিন মানুষ দেখে কাজটা হচ্ছে। মানুষ জানে এই সরকারে যে ২৪-২৫ জন যারা আছেন উপদেষ্টা, তাদের সদিচ্ছা আছে। কিন্তু সদিচ্ছা দিয়ে তো আসলে রাষ্ট্র পুরোটা চালানো যায় না। ওইখানে আমাদের একটা সংকট রয়ে গেছে।

অর্ক: মাজার ভাঙার ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

মাহফুজ: যতগুলো মাজার হামলা হয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো মামলা হয়েছে, গ্রেফতারও হয়েছে এবং আমরা চেষ্টা করছি যে মাজারে হামলাটাকেও আইনের আওতায় আনার জন্য। যেখানে হামলা হয়েছে, ওই ভাঙচুরগুলোকে আইডেন্টিফাই করে, এগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় কিনা তা দেখছি আমরা। যারা ভাঙচুরে জড়িত তাদের বয়ান রেকর্ড করা হবে। সাভারে যে ঘটনা ঘটছে সেখানে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন তদন্ত করতে গিয়েছে। এটা একটা উচ্চপর্যায়ের তদন্ত। ফলত আমরা এটাকে ছাড় দিচ্ছি না। পাশাপাশি হেফাজত-এ-ইসলাম বিবৃতি দিয়েছে। আমি মনে করি ওদের বিবৃতি একটু দেরিতে এল। তবে এটা মোটামুটি সমাধান হয়ে যাবে। আমরা মনে করি না আর হবে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে এটা কমে যাবে।

অর্ক: মানুষ বলছে, সরকারের একাংশ চায় না নির্বাচন হোক। জামায়াতও চায় না নির্বাচন হোক। এই সাদৃশ্য নিয়ে কী বলবেন?

মাহফুজ: এটা এক ধরনের সরলীকরণ হলো। কারণ দল এক ধরনের জিনিস আর জনগণ আরেক ধরনের জিনিস। এই সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায় না। সরকার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকবে। সংস্কার কমিশনের যে যে রিপোর্ট আসবে, সেই সব রিপোর্টের ভিত্তিতে একটা সময় পর্যন্তই থাকবে। সরকার দুটো সময় বেঁধে দিয়েছে। অলরেডি। একটা ডিসেম্বর, একটা জুন। এর বাইরে সরকারের আর কোনও পরিকল্পনা নেই। কোনও গোপন পরিকল্পনা নেই সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার। এটা খুবই স্পষ্ট। জামায়াতের বিষয় হলো, তার সময় লাগবে। একটা নয়া আবিষ্কৃত বাস্তবতা সে পেয়েছে। গত ১৫ বছর সে এলাকায়-এলাকায় যেতে পারেনি। সে এলাকায় গিয়ে ঘোষণার চেষ্টা করছে। সে বিএনপি-কে একটা পাল্টা দেওয়ার চেষ্টা করবে। এতটুকুই। জামায়াতের তো এখানে একটা ইন্টারেস্ট অবশ্যই আছে। জামায়াত হয়তো ২৮-এ নির্বাচন করলে আরও ১০টা সিট বেশি পেত। জামায়াতের সিট বাড়ানোর কাজ কি আমাদের? এটা তো আমাদের কাজ না। ফলত আমার কাজটা হচ্ছে যে আমি একটা রোডম্যাপ তৈরি করছি, ওই রোডম্যাপের আওতায় রাজনৈতিক কথাবার্তা হবে। বিএনপি তার অংশীদার, সব দল অংশীদার। ওঁরা যদি মনে করেন ডিসেম্বর, ডিসেম্বরে হবে। যদি মনে করেন জুন, তাহলে তাই।

অর্ক: পুলিশ অসক্রিয় হলে ভোটপ্রক্রিয়া চালিয়ে নিয়ে যাবেন কী করে?

মাহফুজ: এটাই আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস। সবাই বলছে দ্রুত নির্বাচন চাই কিন্তু এই অবস্থায় নির্বাচন হলে আরও সংঘাত এবং সন্ত্রাস হবে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট এসেছে। ওটা ধরে আমরা কাজ করতে পারব এবং তাদের রি-অ্যাক্টিভেট করার জন্য আমরা যে প্ল্যান করছি সাধারণ মানুষ-ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের এক ধরনের যোগাযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে স্থানীয়ভাবে। পুলিশদের ভিতরে যারা অপরাধী (হয়তো একটা অংশ অপরাধী), তাদের শনাক্ত করে অন্যদের ক্ষমা ঘোষণা করে দেওয়া। তাহলে আর অন্য কেউ পুলিশকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবে না। আরেকটা জিনিস হচ্ছে পোশাক পরিবর্তন। পুলিশের নীল পোশাক ট্রমা তৈরি করে। আমার নিজের ক্ষেত্রে হয়েছে। হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলে আমার ভয় কাজ করে। ওই যে যখন কারফিউয়ের সময়ে যে হেলিকপ্টারগুলো উড়ান দিত এবং গুলি করতে, এই জিনিসগুলোতে ট্রমা আছে। অনেকে বলছে পুলিশের ড্রেস চেঞ্জ করে কিছুই হয় না। এটা আসলে খুবই ম্যাটার করে। আমি তাদের দেখছি। আমার চোখে ওই রঙটা লাগলে আমার গা রি-রি করে। এটা খুবই সাইকোলজিক্যাল। আমি পুলিশকে ভয় পেতাম ক্ষমতায় আসার আগে। ভয় পাব না? আমার সঙ্গে তার দূরত্বটা সাইকোলজিক্যাল ডিফারেন্স, এক ধরনের ডিস্টেন্স। এটা আমি বুঝতে পারি। এই রং চেঞ্জ করাটাই এই জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রং বদল করলে মানুষ আশ্বস্ত হবে। পাশাপাশি আসামী চিহ্নিত করতেই হবে। যত দ্রুত সম্ভব। আরও দ্রুত করার জন্য আমাদের ইন্সটিটিউশনগুলোর পুনরুজ্জীবন দরকার। ওইটা আমরা করার জন্য আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেও হয়তো পারছি না। সময় লাগছে। একটা সময়ে গিয়ে এটা হবে। তখন আর সমস্যাগুলো থাকবে না। শহিদ, আহত পরিবারগুলিকে দ্রুততার সঙ্গে অর্থসাহায্য দেওয়া জরুরি। এটা হয়ে গেলে এই নিয়ে তো কেউ ইস্যু করতে পারবেন না। আমাদের এখানে ইস্যু আট-দশটা। আট-দশটা ইস্যু আমরাই সমাধান করলে জনগণ অনেকটা আশ্বস্ত হবেন, তাঁরা সুস্থ জীবনে ফিরতে চান।

অর্ক: ভারতীয় লিগ্যাসি মিডিয়ার একটা বড় অংশ প্রচার করে বাংলাদেশ জঙ্গিদের হাতে চলে গিয়েছে। তাছাড়া হিন্দুত্বের পতাকা সামনে রেখে যারা ভোট চায়, যারা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার বহন করে, সবাইকে নিয়েই এই বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে কলেমা আঁকা পতাকা নিয়ে কিছু লোক সারা দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ভিস্যুয়াল এবং সংশ্লিষ্ট ন্যারেটিভ আপনি চ্যালেঞ্জ করবেন কী করে?

মাহফুজ: এটা আমরা অতীতে করেছি। সেপ্টেম্বরে এই কালো পতাকার এক ধরনের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। ওই সময় আমরা কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়ায় ওটা বন্ধ হয়ে গেছে। খুবই সাবোটাজ হচ্ছে। আমাদের আন্দোলনগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে। আপনি দেখবেন ওখানে (৩২ ধানমন্ডি) একেবারে নন-হিজাবি, প্যান্ট-শার্ট পরা মেয়েরা, টপ পরা মেয়েরাও এসে শামিল হয়েছিল।

অর্ক: কিন্তু টিআরপি তো কলেমা আঁকা পতাকায়!

মাহফুজ: হ্যাঁ, ওরা এটাই ব্যবহার করছে এবং এই ব্যবহারের জন্য সুযোগটা করে দিচ্ছে এই পতাকাধারীরা। ওরা খুব স্পেসিফিক এজেন্ডার ভিত্তিতে এটা করছে। কেন আমরা ওই সময়ে এগুলি আটকাতে পেরেছিলাম? আমরা দু-তিনটে লোককে শনাক্ত করেছি। তারা কী করত? মিছিল হতো ছাত্রদের। ওই মিছিলে এসে এই পতাকা ঢুকিয়ে দিত। মানে পকেটে রাখত পতাকা। আমরা ওই লোকগুলোকে বাতিল করেছি ধরে ধরে। গণ আন্দোলনে অনেক পতাকা আসতে পারে। একটা লাল পতাকা বা কালো পতাকা আসতে পারে। পতাকা তো অনেক ধরনের হতে পারে। কলেমার পতাকায় তো সমস্যা নেই। কলেমাও লিখতে পারে কেউ চাইলে কিন্তু ওদের পতাকার একটা ধরন আছে। সবাই জানে ওটা আইসিস-এর বা আল কায়দার ধরন। এরা এই ছবিটা সেল করার চেষ্টা করে। বোঝাতে চায় এই জনতা আমাদের। টাকা তোলা হয় এগুলি দেখিয়ে। বুজরুকি আর কী! এটার সত্যতা নেই। বাংলাদেশের আন্দোলন অনেক প্রগতিবাদী, নন-বাইনারি মুভমেন্ট ছিল। অনেক বামপন্থী এখানে অংশগ্রহণ করছে। অনেক ডানপন্থীও এখানে অংশগ্রহণ করছে, কিন্তু কোনেওটাই মুখ্য হয়ে ওঠেনি। এটাই আমাদের সাফল্য। আমরা বলতে পারব যে এটা বামেরও না, ডানেরও না। এটা একটা সেন্ট্রিস্ট অবস্থান বলা যায়। আমরা সেটা ধরে রাখতে চাই। বারবার তো ফস্কে যাবেই, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

অর্ক: নতুন দলের সঙ্গে আপনি কতটা জড়িত? তাত্ত্বিকভাবে, আদর্শিকভাবে?

মাহফুজ: তাত্ত্বিকভাবে আমার হয়তো অনেকগুলো বক্তব্য আছে। ওই বক্তব্য হয়তো অনুসৃত হবে, এতটুকুই কিন্তু আমি নিজে গিয়ে অংশ নিচ্ছি না।

অর্ক: আপনি অংশ নিলে কিন্তু বলা হবে আপনি জিয়াউর রহমানের মতো কাজ করছেন, সরকার থেকে দল...

মাহফুজ: না, আমরা এটা করব না। যারা বাইরে তারাই করবে, অথবা সরকার থেকে বেরিয়ে করবে। চিন্তা তো একটা ফ্লো। আপনি বলতে পারবেন না, তুমি চিন্তা কোরো না। ফলত আমরা এখানে চিন্তা করলে, হয়তো রাজনৈতিক দলের উপর তার প্রভাব পড়বে। আমরা অ্যাক্টিভিজমটা করব না কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা তো সবার আছে এবং সরকারের প্রতিনিধিরাও তো কেউ বিএনপি, কেউ জামায়াত সমর্থক। তাতে তো কোনও অসুবিধে নেই।

অর্ক: নির্বাচন হয়ে গেলে আপনার পরবর্তী পেশা কী হবে?

মাহফুজ: আমি হয়তো রাজনীতিতে যাবে।

অর্ক: আপনি তখন রাজনীতিতে যাবেন, অর্থাৎ নতুন দলে যাবেন।

মাহফুজ: নতুন দলে যেতে পারি, অন্য কিছুও তো করতে পারি।

অর্ক: বিএনপি-তে যাবেন?

মাহফুজ: না মানে…

অর্ক: বিএনপিতে যাবেন না। আপনি জামায়াত করবেন এই সম্ভাবনা মনে হয় নেই। আপনি আওয়ামী লীগ করবেন এমন সম্ভাবনাও নেই। তাহলে আপনি কোথায় যাবেন? নতুন দলেই যাবেন, যে দলের তাত্ত্বিক কাঠামো এখন তৈরি করছেন।

মাহফুজ: এখনই বলছি না। তবে, নতুন দল তো একটা অনুপ্রেরণা। আমাদের প্রয়োজন অনুপ্রেরণা। আমরা সবাই মিলে রক্ত দিচ্ছি, সবাই মিলে একটা সম্ভাবনা নিয়ে আছি। আর আমরা তাজা রক্ত, আমাদের এখনও করাপ্ট করতে পারেনি কেউ। আমরা এই সম্ভাবনাকে তো আমরা চালিয়ে নিতে চাইব। এটা তো আমাদের জন্য দরকারি।

অর্ক: সরকারের ভেতরে একজন আছে যার মাথায় চাণক্যের বুদ্ধি। যার বুদ্ধির উপর অনেকের নির্ভরতা আছে। তিনি চিন্তা বিনিময় করবেন। কিন্তু দলটাকে কিংস পার্টি বলব না?

মাহফুজ: আমাদের সরকারে অনেক উপদেষ্টা আছেন যাঁরা সরাসরি বিএনপি বা জামায়াতের সমর্থক, নানা সময়ে তাদের পক্ষে লিখেছেন, এখনও হয়তো পরামর্শ দিচ্ছেন, চিন্তা ভাগ করে নিচ্ছেন। আমি এখানে বুদ্ধি দিয়ে একটা পার্টি করে ফেলব এটা তো আসলে অসম্ভব। মানে এখানে তো মাঠে হাজারেও কাজ আছে। হাজারেও কষ্টের কাহিনি আছে। মাঠে-ঘাটে যেতে হবে। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে, টাকা-পয়সা সামলাতে হবে, নেতৃত্ব সামলাতে হবে। কিংস পার্টি রাষ্ট্রের সুযোগসুবিধে ব্যবহার করে। আমি তো রাষ্ট্রের সুবিধেগুলি ইউজ করতে দেবে না কাউকেই। কিংস পার্টি রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবহার করে। এটাও আমরা করতে দেবে না। বুদ্ধির কথা যদি বলেন, এটা একটা ফ্লোয়িং জিনিস। এটা যেতেই পারে। মানে আমি লিখতে পারি হয়তো। এই লেখা থেকেই তারা মনে রসদ নিতে পারে। এর বাইরে আমি আর কোনওভাবে ফিন্যান্স করব না। গভর্মেন্ট অডিটোরিয়াম বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধে দেব না। এটা আমাদের নীতি।

অর্ক: প্রথম আলোর একটা রিপোর্টে আমি পড়ছি বহু জার্নালিস্টের প্রেস আইডি অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল হয়ে গেছে। আপনারা তো সেটা মানতে রাজি নন।

মাহফুজ: প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন সচিবালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাতিল হয়েছে। এছাড়া সবটাই আছে। তাঁরা সাংবাদিকতা করতে পারবেন। প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন শুনলে মনে হবে যে বোধহয় সে সাংবাদিকতা করতে পারছে না। এটা সত্য না। বরং সচিবালয়ে ঢোকার ক্ষেত্রে যে কার্ডটা লাগে সেই কার্ডটা বাতিল হয়েছে। সচিবালয়ে কী হতো সেটা আপনাকে একটু খুলে বলি। সচিবালয়ে অ্যাক্রেডিটেশনের নামে আওয়ামী লী,গ ছাত্রলীগের অনেক কর্মীকে এই কার্ড দেওয়া হয়েছে। ফলত দেখা যায়, আমাদের এখানে মিডিয়া ইলেকট্রনিক্স এবং টিভি অন্যান্য মিলিয়ে ধরুন ১৫০ হতে পারে কিন্তু প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড কত আছে জানেন? তিন হাজার! ওই কার্ড কীভাবে হয়? ধরুন ‘নোয়াখালি প্রভাত’ একটা পত্রিকার নাম। পত্রিকা খুলে রিপোর্টার সেজে লোকজন ভেতরে এসে হয়তো দালালি করতো, টেন্ডার আদায় করত। যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাঁরা সচিবালয়ে ঢুকে প্রশ্ন করতে পারবেন না মন্ত্রীদেরকে। কিন্তু এর বাইরে তিনি পুরো বাংলাদেশে চাইলে প্রশ্ন করতে পারবেন। দ্যাটস অল।

অর্ক: টিভি টুডে-এর সম্পাদক মঞ্জুরুল আহাসান বুলবুল। আরও দু'একটা নাম বলছি। দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নিউজ ২৪ টেলিভিশনের হেড অফ নিউজ রাহুল রাহা, এটিএন নিউজের বার্তা প্রধান নুরুল আমীন প্রভাস, দৈনিক ডেসটিনির উপ-সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, ডিবিসি নিউজের প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম, নিউজ ২৪ এর সিনিয়র রিপোর্টার জয়দেব চন্দ্র দাস— এরা সবাই! আমি নাম আর পড়লাম না। ওমর ফারুক, মমতা ইসলাম, সোমা... এরা সবাই বলছেন আওয়ামী লীগ?

মাহফুজ: এদের একটা অংশ তো একটা বড় অংশই আওয়ামী লীগ।

অর্ক: বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করা যায় না?

মাহফুজ: ওঁরা বিগত গভর্নমেন্টের যাবতীয় প্রোপাগন্ডার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন ওঁদের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণিত না হলে আমরা কেন তাঁদের গ্রেফতার করব? তাদের একটা বড় অংশকে কিন্তু গ্রেফতার করাও হয়নি। তারা এখনও সাংবাদিকতা করছে। অ্যাক্রিডিটেশন বাতিলের ব্যাপারটা শুধুমাত্র সচিবালয়ে ঢোকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

অর্ক: এ কথাটা কিন্তু প্রথম আলো লেখেনি। তাহলে আপনি বলছেন প্রথম আলো ভুল বয়ান প্রচার করল?

মাহফুজ: পুরো ব্যাখ্যাটা তারা দেয়নি। আমি তথ্যমন্ত্রী না কিন্তু আমাদের কাছে যে ব্যাখ্যাটা আছে সেটা হচ্ছে এরকম যে, সচিবালয়ে ঢোকার ক্ষেত্রে এই অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডটা ছিল। সচিবালয়ে প্রেমিসেস