মামলার রায়ের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিতে রাজি নন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তবে তিনি মনে করেন, জুলাই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান কয়েকটি মামলার বিচার এ বছরেই শেষ করা সম্ভব হবে। ট্রাইব্যুনালের নিজ দপ্তরে বুধবার সমকালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তাজুল ইসলাম।
সমকাল: ছয় মাসে মামলা ও তদন্ত কার্যক্রম কতদূর এগিয়েছে?
তাজুল ইসলাম: শুধু জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার নয়, আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বিচার কার্যক্রম ট্রাইব্যুনালে চলমান। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে প্রায় ৩০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে ১৬টি মামলা (সিম কেস) করেছি। এর মধ্যে তিনটি গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা; বাকিগুলো জুলাই-আগস্ট গণহত্যা বা ওই সময়কার অপরাধের অভিযোগে।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে নিরপেক্ষ তদন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটি হত্যা মামলার তদন্তে বছরের পর বছর লাগে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিস্তৃতি দেশজুড়ে হওয়ায় এর সঙ্গে হাজারো অপরাধী জড়িত। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ফলে এখানে আমরা সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন না পেলে বিচার ব্যাহত হবে। সঠিক বিচার না হয়ে আসামি বের হয়ে গেলে সমস্যা তৈরি হবে। এজন্য চোখ-কান খোলা ও আন্তর্জাতিক মান বজার রেখে তদন্ত করতে হচ্ছে।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারে মানুষের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা দিনরাত কাজ করছে। গণহত্যার বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করা হচ্ছে এবং অধিকাংশ প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার পথে। আগামী এক মাসের মধ্যে দু-একটা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমকাল: প্রথম মামলা রায়ের পর্যায়ে আসতে কতদিন লাগতে পারে?
তাজুল ইসলাম: চিফ প্রসিকিউটরের পক্ষ থেকে সময় বেঁধে দেওয়া ঠিক হবে না। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হলেই আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু হবে। বিচার শেষ হতে কতদিন লাগবে, তা নির্ভর করে ট্রাইব্যুনালের ওপর। তবে আমরা এক দিনও অতিরিক্ত সময় চাইব না, মুলতবি ছাড়া মামলার বিচারকাজ চলবে। বিচারের প্রথম দিন থেকে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। আমরা আশা করছি, এ বছরের মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি মামলার বিচার শেষ করা সম্ভব হবে।
সমকাল: তদন্ত ও বিচারকাজে কোনো কিছুকে কি বাধা মনে করছেন?
তাজুল ইসলাম: এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো বাধা নেই। আমাদের ওপর জনগণের প্রত্যাশার অদৃশ্য চাপকেই আমরা বড় বাধা মনে করছি। কারণ জুলাই-আগস্টে যে গণহত্যা হয়েছে, যারা গুম-খুন করেছে, মানুষ দ্রুত তাদের বিচার দেখতে চান। আবার তারা চান, বিচার আন্তর্জাতিক মানের ও নিরপেক্ষ হোক। দুটির সমন্বয় করা বড় ধরনের চাপ। তবে আমরা কোনো আপস করছি না।
এর বাইরে আমরা দেখছি, কিছু কিছু ট্রাইব্যুনালের
আদেশ পালন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা করছে। তবে তাদের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়েছে। তাদের কার্যকর করতে রাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে। ফলে এসব মামলার ক্ষেত্রে যে ধরনের সহযোগিতা দরকার, পুলিশ বাহিনী সহায়তা করার সেই পর্যায়ে নেই। ফলে অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না, তারা পালিয়ে যাচ্ছেন। এ জায়গায় যত দ্রুত সম্ভব রিকভারি করা যাবে, দেশ ও জাতির জন্য তত মঙ্গল হবে।
সমকাল: গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে আপনাদের মূল ভিত্তি কী?
তাজুল ইসলাম: আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত যেভাবে হয়; আবার দেশে হত্যার তদন্ত যে দণ্ডবিধিতে হয়– দুটি একই রকম হবে না। এখানে আমাকে ঘটনার কমান্ড রেসপনসিবিলিটি প্রমাণ করতে হবে। পুলিশ বেপরোয়া গুলি করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে, তা প্রমাণ করা জরুরি। এ জন্য আন্তর্জাতিক মানের পাশাপাশি অপরাধের ভিন্নতা সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের ভিত্তি হচ্ছে, মানুষের করা অভিযোগ। তদন্ত সংস্থা এ দেশে কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে মনে করলে, নিজ উদ্যোগেও তদন্ত শুরু করতে পারে। তদন্তের ভিত্তি হলো তদন্ত সংস্থার প্রাপ্ত তথ্যের জ্ঞান। আর জুলাই-আগস্টে যা হয়েছে, তা সবাই জানে এবং এটি সাধারণ জ্ঞান। এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে ভুক্তভোগীর অভিযোগ, সংঘটিত অপরাধের ভিডিও, ডকুমেন্টস, সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য– সব কিছুকেই ভিত্তি ধরা হয়েছে।
সমকাল: আপনি এ ট্রাইব্যুনালে আগে আসামিপক্ষের হয়ে লড়েছেন। অভিযোগ করতেন, আন্তর্জাতিক মানের নয়, আইনের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এবং আসামিপক্ষের সমান সুযোগ নেই। এখন কী বলবেন?
তাজুল ইসলাম: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আগের আইনে অনেক সংশোধনী এনে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। এখন ট্রাইব্যুনালের বিধিমালায় কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। এ নিয়ে প্রসিকিউশন এজেন্সি ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আইনে আগে যেসব সুযোগ ছিল না, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো ঘাটতি নেই বলে আমরা মনে করি। তবে আইন যতই থাকুক, আপনি অপপ্রয়োগ করলে তা আইন দিয়ে ঠেকানো যাবে না।
সমকাল: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইসিটি আইনে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে। সেটির সঙ্গে এখনকার পার্থক্য কী?
তাজুল ইসলাম: আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কারণ ওইসব অপরাধের তথ্যপ্রমাণ ছিল ৪০-৪৫ বছরের পুরোনো। মিথ্যা-বানোয়াট সাক্ষী বানিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করা হয়েছে। বর্তমানে যে অপরাধের বিচার হচ্ছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের। এটার লাইভ এভিডেন্স, ভিডিও ফুটেজ, চাক্ষুষ সাক্ষী, দলিল-দস্তাবেজসহ বিভিন্ন ডকুমেন্ট রয়েছে।
এ ছাড়া বর্তমান সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সত্যিকারের যারা অপরাধী, বাংলাদেশকে যারা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল, ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য গণহত্যা চালিয়েছে, গুম করেছে, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে নিরাপদ করা, যেন আর কোনো স্বৈরশাসক আসতে না পারে। দুটি বিচার কার্যক্রমের গুণগত ও উদ্দেশ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
সমকাল: নির্বাচনে অযোগ্য করতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বিচারের কাজ দ্রুত করা হচ্ছে– এ অভিযোগের জবাব কী দেবেন?
তাজুল ইসলাম: দেখুন, এখানে অপরাধীদের বিচার হচ্ছে– তিনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী না এমপি, সেটি বড় কথা নয়। অপরাধীরা গত ১৫ বছরে পুরো রাষ্ট্রকে কবজা করে, রাষ্ট্রের সব অর্গান ব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তারা নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে গণহত্যা চালিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। সুতরাং তাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ, এমপি সম্মিলিতভাবে এসব অপরাধের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও সশরীরে অংশ নিয়েছেন। আমরা আইনের চোখে অপরাধকে দেখছি, অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করছি। এখানে নির্বাচন কোনো ইস্যু নয়। বিচার নির্বাচনের আগে বা পরে হোক, সেটা বড় বিষয় নয়। রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এসব অপরাধীকে রাজনীতিতে আবার আসার সুযোগ তারা দেবেন কিনা?
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তাজুল ইসলাম: সমকালের পাঠকদেরও ধন্যবাদ।