ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৪৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির লাশ পড়ার পর গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হয় গত জানুয়ারির মাঝামাঝি। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান, তিনি গাজাবাসীকে মিসর ও জর্ডানে সরিয়ে শহরটিকে খালি করে পরিষ্কার করতে চান। তবে কীভাবে তিনি এটি করতে চান, সেটি স্পষ্ট করে বলেননি।
যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখেন ট্রাম্পের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী বন্ধু ও তাঁর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ। ট্রাম্পের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী জামাতা জ্যারেড কুশনারের বক্তব্য এবং স্টিভ উইটকফের অবস্থান বিবেচনায় বলা যায়, ট্রাম্পের গাজা খালি করতে চাওয়ার পেছনে আসল উদ্দেশ্য মূলত গাজায় মার্কিন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের ব্যবসার পথ খুলে দেওয়া।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জর্ডানে ২৩ লাখ ৯০ হাজারের বেশি নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৯ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় সেখান থেকে পালিয়ে আসা লোকদের বংশধর।
ট্রাম্প বলেন, তিনি চান, জর্ডান এবং মিশর গাজার ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসুক এবং তিনি এই বিষয়ে রবিবার মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা এক মিলিয়ন বা তারও বেশি মানুষের কথা বলছেন এবং আমরা পুরো বিষয়টা পরিষ্কার করতে পারি।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আমি জানি না, ঠিক কীভাবে কী হবে। তবে কিছু একটা তো ঘটতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো—এটি সত্যিই এখন এক ধরনের ধ্বংসাবশেষ। প্রায় সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সেখানে মানুষ মরছে। তাই, আমি চাই কিছু আরব দেশ নিয়ে কাজ করতে এবং অন্য কোনো স্থানে তাদের (ফিলিস্তিনিদের) বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে, যেখানে তারা হয়তো শান্তিতে বসবাস করতে পারে।’ সাবেক আবাসন ব্যবসায়ী এই প্রেসিডেন্ট বলেছেন, সম্ভাব্য এই বাসস্থানের ব্যবস্থা ‘অস্থায়ী’ হতে পারে অথবা ‘দীর্ঘমেয়াদি’ হতে পারে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্য দীর্ঘদিনের মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। কারণ, দেশটি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জন্য দুই রাষ্ট্রের সমাধান প্রস্তাব করে আসছে। এ ছাড়া, এক সময় এই অঞ্চলে এমন ভয় ছিল যে, ইসরায়েল গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতিবেশী দেশে স্থানান্তরিত করতে চায়। যদিও ইসরায়েল এই বিষয়টি অস্বীকার করে, কিন্তু দেশটির বর্তমান শাসক দলের একটি অংশ এই ধারণাকে সমর্থন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অবস্থানের বিরোধী হলেও এটি তাঁর আইনজীবী জামাতা ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী জ্যারেড কুশনারের মন্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। জ্যারেড কুশনার ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজার জলসীমার ভূমিকে ‘অত্যন্ত মূল্যবান’ বলে মন্তব্য করেছিলেন এবং ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে স্থানান্তরিত করতে এবং ‘এটি খালি’ করার প্রস্তাব করেন।
জ্যারেড কুশনারের মন্তব্য ‘গাজা জলসীমার ভূমি অত্যন্ত মূল্যবান’—থেকেই অনুমান করা যায় তিনি বিষয়টিকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন। জ্যারেড কুশনারের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কুশনার রিয়েল এস্টেট গ্রুপ ইসরায়েলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। এমনকি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারদের অবৈধ বসতি নির্মাণ প্রকল্পেও যুক্ত আছে কুশনার রিয়েল এস্টেট কোম্পানি।
এবার আসা যাক, স্টিভ উইটকফের কথায়। তিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ। নিউইয়র্কভিত্তিক এই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূলমন্ত্র ‘ব্যবসাই সর্বোত্তম পররাষ্ট্রনীতির’ অনুসারী। এই নীতি অনুসরণ করেই স্টিভ উইটকফ যখন জানুয়ারির মাঝামাঝি গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলতে যান, তখন রীতিমতো ধমক দিয়েছেন।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উইটকফ নেতানিয়াহুকে বলেন, কাতারের রাজধানী দোহায় যারা যুদ্ধবিরতি আলোচনা করছে তাদের এখনই যুদ্ধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আলোচকদের সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। যদি নেতানিয়াহু এইভাবে কাজ করতে না চান, তবে সবাইকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।
এই উক্তি থেকেই স্পষ্ট যে, ট্রাম্প এবং উইটকফ কতটা বেপরোয়া ছিলেন গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, গাজায় যুদ্ধবিরতি কী কেবলই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা সম্ভব? বিশেষ করে ট্রাম্পের মতো ব্যবসা বুদ্ধিসম্পন্ন লোক যখন যুদ্ধবিরতি শুরুর পরপরই গাজা খালি করার কথা বলেন, তখন সেটাকে কী স্রেফ কথার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব?
বিশেষ করে চিত্রকল্প যখন এমন যে, উইটকফ চার দশক ধরে ট্রাম্পের বন্ধু। তাঁরা একসঙ্গে গলফ খেলেন এবং গত বছরের সেপ্টেম্বর ট্রাম্পের ফ্লোরিডার গলফ কোর্সে যখন তাঁর ওপর হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে, তখন উইটকফ সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এখন তিনি ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত। এই অবস্থায় বিষয়টি কী ইঙ্গিত দেয়?
ট্রাম্প-উইটকফের বন্ধুত্বের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মার্কিন থিংক ট্যাংক কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর ফেলো ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহা হাসান বলেন, ‘এই ইতিহাস এবং সম্পর্কের দীর্ঘস্থায়িত্ব গভীর আস্থা ও আনুগত্যের ইঙ্গিত দেয়, যা উইটকফকে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি সংক্রান্ত বিষয়ে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে।’ এই অবারিত সুযোগ উইটকফকে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে গাজায় যে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সুযোগ দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইহুদি উইটকফের মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি আলাদা টান থাকার কথাও মার্কিন সমাজে অবিদিত নয়।
যাই হোক, গাজায় ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে নিজেদের ব্যবসায় সম্প্রসারণের আকাঙ্ক্ষা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিছু বিশ্লেষক ট্রাম্পের মন্তব্যকে গাজায় ‘জাতিগত নিধন’ চালানোর ইঙ্গিত বলে অভিহিত করেছেন।
মার্কিন থিংক ট্যাংক আরব সেন্টারের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রোগ্রামের প্রধান ইউসুফ মনোয়ার বলেন, ‘ট্রাম্পের মন্তব্য অত্যন্ত আপত্তিজনক এবং এটি সব ধরনের প্রচলিত নিয়ম এবং মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।’ তিনি বলেন, ট্রাম্পের মন্তব্যকে সংশয়াপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত।
মনোয়ার বলেন, ‘ট্রাম্প নানা রকম কথা বলেন। কখনো কখনো তিনি যা বলেন, তা তাঁর মানে থাকে আবার কখনো মানে থাকে না।’ তিনি বলেন, গাজা থেকে ‘জাতিগতভাবে স্থানচ্যুত’ করার ধারণা নতুন কিছু নয় এবং এটি অক্টোবর ২০২৩ থেকে যুদ্ধের শুরু থেকেই জারি ছিল।
তবে ট্রাম্পের বক্তব্যের পর মিসর দ্রুতই এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জর্ডানও এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। মিসর-জর্ডান প্রত্যাখ্যান করলেও ব্যক্তিটি যখন ট্রাম্প, তখন তারপরও গাজাবাসীর ভাগ্য নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা থেকে যায়।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও রয়টার্স