Image description

ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক মহাত্মা গান্ধী। তিনি শান্তি, মুক্তি ও মানবতার প্রতীক। ভারতের স্বাধীনতার ৬ মাসের কম সময়ের ব্যবধানে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। আজ ফিরে দেখার আয়োজন মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে।

শান্তি, মুক্তি ও মানবতার প্রতীক তিনি। আমৃত্যু এই নীতিতে অটল থেকেছেন। অহিংস পথে ব্রিটিশবিরোধী বিরামহীন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কারাভোগ করেছেন। জীবনভর তাঁর এমন সংগ্রাম তাঁকে করে তোলে অনন্য। তাঁর নামযশ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।

খুবই সাদামাটা, অথচ অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিক, আধ্যাত্মিক এই মানুষটির নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ‘মহাত্মা গান্ধী’ নামেই বহুল পরিচিত। এই নামের অর্থ ‘মহান আত্মা’। সম্মান করে অনেকে তাঁকে ‘বাপু’ (বাবা) বলেও ডাকতেন।

ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক মহাত্মা গান্ধী। তবে ভারতের স্বাধীনতার ছয় মাসের কম সময়ের ব্যবধানে নৃশংস গুপ্তহত্যার শিকার হন এই শান্তিকামী নেতা।

 

ধর্মীয় পরিবারে জন্ম

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্ম ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর, ব্রিটিশশাসিত ভারতের পোরবন্দরের একটি অভিজাত হিন্দু পরিবারে। তাঁর জন্মস্থান এলাকাটি এখনকার ভারতের গুজরাট রাজ্যের অন্তর্গত।

বাবা করমচাঁদ উত্তমচাঁদ গান্ধী। তিনি ছিলেন পোরবন্দরের রাজদেওয়ান (মুখ্যমন্ত্রী)। মা পুতলিবাই গান্ধী। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। ছেলের মধ্যে তিনি ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার সঞ্চার ঘটিয়েছিলেন। নিরামিষ ভোজন, ধর্মীয় সহনশীলতা, সহজ-সাধারণ জীবনযাপন, অহিংসার ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি।

মহাত্মা গান্ধী ১৩ বছর বয়সে মা–বাবার পছন্দে ১৪ বছর বয়সী কস্তুরবা মাখাঞ্জিকে বিয়ে করেন। ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে আইনশাস্ত্র পড়তে মহাত্মা গান্ধী লন্ডন যান। ১৮৯১ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন।

লন্ডনে পড়া শেষে মহাত্মা গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন। আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রথম মামলাতেই তিনি হেরে যান। তিনি অপমানিত হন। একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ভারতীয় ফার্মে কাজের প্রস্তাব পান তিনি।

 

দক্ষিণ আফ্রিকায় সংগ্রাম

১৮৯৩ সালে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশে ভারত ছাড়েন। পরবর্তী ২১ বছর তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকাতেই কাটে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সাধারণভাবে প্রচলিত বৈষম্যের শিকার হন মহাত্মা গান্ধী। এই আচরণে তিনি হতবাক হন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় অভিবাসীদের অধিকার আদায়ে মহাত্মা গান্ধী সোচ্চার হন। ভারতীয়দের অধিকার আদায়ে ১৮৯৪ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করেন নাটাল ভারতীয় কংগ্রেস। দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর হাত ধরে বিকশিত হয় অহিংস আন্দোলন ‘সত্যাগ্রহ’।

অহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধী একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালেই তাঁর পরিচিতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে ১৯০৬ সালে ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করেন মহাত্মা গান্ধী। এর পর থেকে তিনি ব্রহ্মচর্য পালনে আরও কঠোর হতে শুরু করেন।

 

ভারতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ

১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে ভারতে ফিরে আসেন মহাত্মা গান্ধী। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগে তিনি তিনটি আঞ্চলিক সত্যাগ্রহ—চম্পারণ (১৯১৭), খেদা ও আহমেদাবাদ (১৯১৮) পরিচালনা করেন। কৃষক-শ্রমিকদের সমস্যা-অধিকার নিয়ে করা পৃথক এই সত্যাগ্রহের মাধ্যমে তিনি ভারতজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। এর মধ্যে ১৯১৯ সালের গোড়ার দিকে দমনমূলক রাওলাট আইন পাস করে ব্রিটিশ সরকার। এই আইন ব্রিটিশ সরকারকে বিনা কারণে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করার ক্ষমতা দেয়।

মহাত্মা গান্ধী এই আইনকে ‘কালো আইন’ বলে অভিহিত করেন। তিনি এই আইনের বিরুদ্ধে অহিংস সত্যাগ্রহের ডাক দেন। এই আইনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলন তাঁকে ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামের মূলধারায় নিয়ে আসে। ভারতীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধী যুগের সূচনা হয়।

 

অসহযোগ আন্দোলন

রাওলাট আইন ও স্থানীয় দুই জনপ্রিয় রাজনীতিককে (সাইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপল) গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে অনেক মানুষ জড়ো হন। সেদিন পাঞ্জাবের অন্যতম বৃহৎ উৎসব বৈশাখীর দিন ছিল।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হয়। গুলিতে কয়েক শ মানুষ নিহত হন। আহত হন হাজারো মানুষ। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি পরিত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় মুসলমানরা খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯-২৪) শুরু করেন। অন্যদিকে রাওলাট আইন থেকে শুরু করে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-২২)।

 

১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে খেলাফত আন্দোলনের প্রতি মহাত্মা গান্ধী সমর্থন দেন। বিনিময়ে খেলাফত আন্দোলনের নেতারা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

এভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ে ওঠে। ব্যাপক সহিংসতাসহ বেশ কিছু বড় ঘটনার জেরে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহাত্মা গান্ধী তাঁর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।

রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ১৯২২ সালের ১০ মার্চ মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচার–সংক্রান্ত স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯২৪ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

আইন অমান্য আন্দোলন

ভারতের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন ও তা চূড়ান্তকরণে ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সাইমন কমিশন গঠন করে। ব্রিটিশ সংসদীয় এই কমিশনকে পুরোপুরি ‘শ্বেতাঙ্গ কমিশন’ অভিহিত করে তা বর্জন করেন ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা।

পাল্টা হিসেবে ১৯২৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতের জন্য একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকারকে ‘নেহরু রিপোর্ট’ পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করতে চাপ দেয় কংগ্রেস।

ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ সালে ঘোষণা দেয়, শিগগিরই ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরুর মতো কংগ্রেসের তরুণ নেতারা দাবি করেন, তাঁদের সংগ্রামের লক্ষ্য ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা।

 
 

এমন প্রেক্ষাপটে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেস। মহাত্মা গান্ধীকে এই আন্দোলন পরিচালনার নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। তিনি অহিংস পন্থায় এই আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩০ সালে তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। শিগগির এই আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুসহ অন্যান্য নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। মহাত্মা গান্ধীসহ কংগ্রেসের নেতাদের ১৯৩১ সালের জানুয়ারিতে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৩১ সালের মার্চ মাসে মহাত্মা গান্ধী ও ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড আরউইনের মধ্যে চুক্তি (গান্ধী-আরউইন চুক্তি) হয়। গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলনে বিরতি দেন।

ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে আলোচনা করতে কংগ্রেসের একক প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বরে লন্ডনের গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়।

সরকারের দমননীতির জেরে ১৯৩২ সালের জানুয়ারিতে আবার আইন অমান্য আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে এই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৪০ সালের মার্চে লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। জিন্নাহর ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মুসলিম লীগের অধিবেশনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রসমূহ (স্টেটস) গঠনের রূপরেখার একটি প্রস্তাব (লাহোর প্রস্তাব) উত্থাপন করেন। পরে প্রবল উৎসাহে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।

 

ভারত ছাড় আন্দোলন

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের দাবিতে ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তাব পাস হয়। এরপরই অহিংস পথে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়।

তবে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন আর অহিংস থাকেনি। আন্দোলন একপর্যায়ে পরিণত হয় বিদ্রোহে। ভারত ছাড় আন্দোলনকে ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেন।

ভারত ছাড় আন্দোলন স্বাধীনতার দাবিকে মৌলিক দাবিতে পরিণত করে। এই আন্দোলনের পর মহাত্মা গান্ধীসহ ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামীদের আর পেছনে ফেরার কোনো পথ ছিল না।

 

ভারতের স্বাধীনতা

১৯৪৫ সাল নাগাদ ব্রিটিশরা বুঝে যায়, ভারত ছাড়তে হবে। ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ভারতত্যাগের বিষয়ে একটা ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৪৮ সালের জুন মাস নাগাদ ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগ করার অভিপ্রায়ের কথা জানান। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রণীত হয় ভারতের স্বাধীনতা আইন।

১৯৪৭ সালের ২ জুন রাতে কংগ্রেস, মুসলিম লীগসহ ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং ভারত বিভাজনের ঘোষণা দেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের কাছে এবং ১৫ আগস্ট ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

দেশ বিভাজনের পর আরও সহিংসতা, আরও দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে অনশন করে কলকাতাকে দাঙ্গার আগুন থেকে রক্ষা করেন মহাত্মা গান্ধী। পরে তিনি কলকাতা থেকে দিল্লিতে ছুটে যান। মুসলমানদের নিরাপত্তা, অধিকারসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিনি অনশন শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ১৩ থেকে ১৮ জানুয়ারি দিল্লিতে এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ অনশন।

 

অহিংসার পূজারি সহিংসতার শিকার

মহাত্মা গান্ধী দিল্লির বিড়লা হাউসে অবস্থান করছিলেন। তাঁর অনশনভঙ্গের দুই দিন পর বিড়লা হাউসে একটি বোমা হামলা হয়। তবে এই হামলায় তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি।

বিড়লা হাউসে সকাল ও সন্ধ্যায় প্রার্থনাসভা করতেন মহাত্মা গান্ধী। সভায় সব ধর্মের কথা বলা হতো। সভায় প্রতিদিন অংশ নিতেন কয়েক শ মানুষ।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৫টার কিছু পর দুই আত্মীয় আভা ও মানুর কাঁধে হাত রেখে প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এগোতে থাকেন মহাত্মা গান্ধী। হঠাৎ তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান নাথুরাম গডসে নামের এক ব্যক্তি।

নাথুরাম তাঁর হাতজোড় করে মহাত্মা গান্ধীকে বলেন, ‘বাপু, নমস্কার।’ তখন নাথুরামকে সরে যেতে বলেন মানু। মানুকে ধাক্কা দেন নাথুরাম। এরপরই তিনি মহাত্মা গান্ধীর দিকে পিস্তল তাক করে চোখের নিমেষে পরপর তিনটি গুলি চালান। মহাত্মা গান্ধী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। দ্রুত তাঁকে বিড়লা হাউসে তাঁর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

মহাত্মা গান্ধীর মরদেহ বিড়লা হাউসে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পরে সেখানে পৌঁছান তাঁর ছোট ছেলে দেবদাস গান্ধী। তিনি মহাত্মা গান্ধীর শরীর থেকে কাপড়টি সরিয়ে দেন। সবার উদ্দেশে বলেন, ‘অহিংসার পূজারির সঙ্গে হওয়া হিংসার ঘটনা দুনিয়া দেখুক।’

 

নাথুরামের ফাঁসি

নাথুরাম কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন। হিন্দু মহাসভায় যোগ দেওয়ার আগে তিনি আরেক কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সদস্য ছিলেন।

মহাত্মা গান্ধীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন নাথুরাম। তাঁর অভিযোগ ছিল, দেশভাগের জন্য মহাত্মা গান্ধীই দায়ী। মুসলিম সম্প্রদায় ও পাকিস্তানের প্রতি মহাত্মা গান্ধীর মনোভাব ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ ও নমনীয়।

মহাত্মা গান্ধী হত্যা মামলার বিচার চলাকালে আদালতে নাথুরাম বলেছিলেন, ‘গান্ধীজি দেশের জন্য যা করেছেন, এর জন্য আমি তাঁকে সম্মান করি। গুলি চালানোর আগে তাই আমি মাথা নিচু করে তাঁকে প্রণামও করেছিলাম। কিন্তু সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে ভাগ করার অধিকার কারও নেই, তিনি যত বড়ই মহাত্মা হোন না কেন। আর এর বিচার করবে—এমন কোনো আইন-আদালত নেই। সে জন্যই আমি গান্ধীকে গুলি করেছিলাম।’

মহাত্মা গান্ধী হত্যা মামলায় নাথুরাম ও তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্তের ফাঁসির আদেশ হয়। নাথুরামের ভাই গোপাল গডসেসহ ছয়জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর নাথুরাম ও নারায়ণের ফাঁসি কার্যকর হয়।

২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবরকে (মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন) ‘আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, বিবিসি, এমকেগান্ধী ডট ওআরজি।