Image description
 

দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে অবশেষে প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের নীতিনির্ধারক মহলেও সৃষ্টি করেছে নতুন কৌতূহল ও সমীকরণ। ভারতীয় প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এক বিশেষ বিশ্লেষণে জানিয়েছে, তারেক রহমানের এই ফিরে আসা দিল্লির জন্য কেন তাৎপর্যপূর্ণ—এবং অনেক ক্ষেত্রে স্বস্তির খবরও হতে পারে।

ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রায় ১৭ বছর ধরে ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে বিএনপির পোস্টার ও ব্যানারে তারেক রহমানের ছবি থাকলেও তিনি শারীরিকভাবে দেশে ছিলেন না। সমাবেশে শোনা যেত তাঁর অডিও বার্তা। বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে এবং একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ডার্ক প্রিন্স’ হিসেবে পরিচিত তারেক রহমান দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের স্বেচ্ছা নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে ঢাকায় ফেরেন।

সহিংসতায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ ও বিএনপির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্ত। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর প্রত্যাবর্তনকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছে বিশ্লেষকরা—যার প্রভাব ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হিসাবেও পড়তে পারে।

তারেক রহমান স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান। দেশে ফিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, “দীর্ঘ ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর বাংলাদেশে!” দিল্লির দৃষ্টিতে এই প্রত্যাবর্তন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ।

ইন্ডিয়া টুডের বিশ্লেষণে বলা হয়, এমন এক সময়ে তারেক রহমান দেশে ফিরলেন, যখন বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে সংকটময় সন্ধিক্ষণে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সময়ে উগ্র ইসলামপন্থীদের তৎপরতা ও ভারতবিরোধী বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দিল্লির উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা বেশি। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে নিষিদ্ধ থাকা এই দলটি ক্ষমতাচ্যুতির পর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে, যা ভারতের নিরাপত্তা ভাবনায় প্রভাব ফেলছে।

সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি সর্বাধিক আসন পেতে পারে। তবে একসময় বিএনপির মিত্র থাকা জামায়াতে ইসলামীও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াতপন্থী ছাত্র সংগঠনের অপ্রত্যাশিত সাফল্য ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে ভারত বিএনপিকে তুলনামূলকভাবে একটি উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখছে, যদিও অতীতে দুই দেশের সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিল না। নয়াদিল্লির প্রত্যাশা, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঙা হবে এবং দলটি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হবে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখলেও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি অনুসরণ করেছিল এবং পাকিস্তান থেকে দূরত্ব রেখেছিল। তবে ইউনূস সরকারের সময়ে এই নীতিতে পরিবর্তন এসেছে বলে ভারতের ধারণা। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ভারতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

ভারত আশা করছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আবারও পরিবর্তন আসবে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বিএনপির মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের কিছু ইঙ্গিতও মিলেছে। গত ১ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুরুতর অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের সমর্থনের কথা জানান। বিএনপির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়—যা দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সৌহার্দ্যের বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভারতের জন্য আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো—তারেক রহমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য প্রকাশ করেছেন এবং দীর্ঘমেয়াদি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ইউনূস সরকারের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনা করেছেন এবং নির্বাচনে তাদের সঙ্গে জোট না করার ঘোষণা দিয়েছেন।

চলতি বছরের শুরুতে তারেক রহমান ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ নামে একটি পররাষ্ট্রনীতির ধারণা তুলে ধরেন, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির অনুকরণে তৈরি। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “নট দিল্লি, নট পিন্ডি—সবকিছুর আগে বাংলাদেশ,” অর্থাৎ দিল্লি বা রাওয়ালপিন্ডির ঘনিষ্ঠতার বদলে জাতীয় স্বার্থই অগ্রাধিকার পাবে।

ঢাকায় ফিরে তারেক রহমানকে ঘিরে ব্যাপক শোডাউন দেখা যায়। বিমানবন্দর থেকে তাঁর বাসভবন পর্যন্ত রোডশোতে বিএনপির প্রায় ৫০ লাখ নেতা-কর্মী অংশ নিয়েছেন বলে দলটির দাবি। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি বগুড়া-৬ (সদর) আসন থেকে এবং বেগম খালেদা জিয়া বগুড়া-৭ (গাবতলী–শাজাহানপুর) আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।

ইন্ডিয়া টুডে জানায়, এই শক্তি প্রদর্শনে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো অসন্তুষ্ট। নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, প্রায় ১০টি বিশেষ ট্রেনে তিন লাখের বেশি বিএনপি সমর্থক ঢাকায় আসেন—যা দলটির ভাষায় ছিল ‘অভূতপূর্ব সমাবেশ’।

রয়টার্সকে বিএনপির সিনিয়র নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, “এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি নির্ধারণী মুহূর্ত।”

তারেক রহমান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছেলে। ২০০৮ সাল থেকে তিনি লন্ডনে বসবাস করছিলেন এবং সেখান থেকেই বিএনপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় দণ্ড দেওয়া হয়, যেগুলো বিএনপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে। ২০০৭ সালে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি অবস্থায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।

২০০৮ সালে জামিন পেয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি পান তিনি। ২০০৪ সালের ঢাকার গ্রেনেড হামলা মামলায় তাঁকে অনুপস্থিতিতে সাজা দেওয়া হয়েছিল। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২৪ জন নিহত হন এবং শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবে গত এক বছরে গ্রেনেড হামলাসহ বড় সব মামলায় আদালতে তিনি খালাস পান।

বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য বড় শক্তি হলেও সামনে তাঁর চ্যালেঞ্জ কম নয়। সহিংসতা ও আন্দোলনে বিপর্যস্ত একটি দেশে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং তরুণ ভোটারদের আস্থা অর্জন—এই দুই পরীক্ষাতেই এখন তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে। একই সঙ্গে এই পরিবর্তনের দিকে নিবিড় নজর রাখছে ভারতও।

 সুত্র- ইন্ডিয়া টুডে।