গত এক বছরে ভারতে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে সাধারণ মুসলিম ও বাংলাভাষীদের ওপর উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর হামলা ও নিপিড়ন এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তবে বিস্ময়করভাবে, এই একই সময়ে খুনি হাসিনাসহ ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের শত শত চিহ্নিত নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের ওপর এ ধরনের কোনো হামলা বা হেনস্তার ঘটনা ঘটেনি। এই বৈপরীত্যের পেছনে আসলে রহস্য কী তা নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল আছে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে।
সম্প্রতি ভারতের কেরালা রাজ্যের পালক্কাদ জেলায় নিজ দেশের এক দলিত পরিযায়ী শ্রমিককে কেবল ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। নিহত ব্যক্তির নাম রামনামায়ণ বাঘেল (৩১)। তিনি ছত্তিশগড়ের শক্তি জেলার করহি গ্রামের বাসিন্দা। কেরালা পুলিশ এই গণপিটুনির ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের অনেকেই বিজেপি ও আরএসএসের সাথে যুক্ত বলে জানা যায়।
গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে কেবল ‘বাংলাদেশি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে হিন্দুত্ববাদী মবের গণপিটুনিতে অন্তত ১১ জন বাংলাভাষী মুসলিম নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রিপুরায় ‘গরুচোর’ সন্দেহে তিন বাংলাদেশিকে তীর মেরে হত্যার ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
শুধু শারীরিক হামলা নয়, ‘বাংলাদেশি হটাও’ অভিযানের নামে মুম্বাই, দিল্লি এবং হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ছত্তিশগড় ও ওড়িশায়ও অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর উগ্রবাদী হামলার খবর পাওয়া গেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, প্রায় ১৫০০ এর বেশি ব্যক্তিকে নিয়মবহির্ভূতভাবে আটক বা সীমান্ত দিয়ে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে হেনস্তা হওয়ার ঘটনা এখন প্রাত্যহিক চিত্র।
তবে এই সহিংসতার একটি রহস্যজনক দিক তুলে ধরে সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছেন, কেবল বাংলাদেশি সন্দেহে সহস্রাধিক সাধারণ মানুষ হামলার শিকার হলেও, কেন ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের কোনো ‘সন্ত্রাসী’ বা প্রভাবশালী নেতা আজ পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদী মবের হামলার লক্ষ্যবস্তু হননি? পলাতক শত শত আওয়ামী সন্ত্রাসী কীভাবে নিরাপদে?
যেখানে একজন সাধারণ রিকশাচালক বা শ্রমিক কেবল বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে হামলার শিকার হচ্ছেন, সেখানে শত শত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ভারতে নিরাপদে অবস্থান করছেন। পলাতক এসব আওয়ামী নেতাদের গায়ে মব জাস্টিসের একটি আঁচড়ও না লাগার পেছনে ৪টি প্রধান কারণ শনাক্ত করছেন বিশ্লেষকরা।
প্রথমত, ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং তাদের আদর্শিক সংগঠনগুলো (যেমন আরএসএস) আওয়ামী লীগকে তাদের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক মিত্র মনে করে। অনেক বিশেষজ্ঞ আওয়ামী লীগকে ভারতের প্রক্সি দল হিসেবেও বিবেচনা করে থাকেন। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ একটি ‘ভারত-বান্ধব’ দল, যারা ক্ষমতায় থাকাকালীন নিজ দেশের সবকিছু উজাড় করে হলেও ভারতের নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত রেখেছে। আর একারণেই ভারতের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো গণহত্যাকারী দলটির পলাতক নেতাকর্মীদের পরমাত্মীয় হিসেবেই বিবেচনা করে।
দ্বিতীয়ত, ভারতে মব হামলার শিকার সাধারণত তারাই হন যাদের বাহ্যিক বেশভূষা (যেমন দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি) দেখে ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করা যায়। আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের জীবনযাপন এবং বেশভূষা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর শত্রু-তালিকার বর্ণনার সাথে মেলে না।ফলে মুসলিম চিহ্ন ত্যাগ করে সহজেই হিন্দুত্ববাদীদের প্রাথমিক সন্দেহ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয় তারা।
তৃতীয়ত, ভারতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কোনো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নেই। অন্যদিকে, হাই-প্রোফাইল আওয়ামী নেতাদের অনেকেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে ও আশ্রয়ে নিরাপদ জায়গায় রয়েছেন। আরও কথিত আছে, নয়াদিল্লি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে হারানো আধিপত্যবাদ পুনরুদ্ধারে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পে রেখে অস্ত্র ও গেরিলা যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আর এভাবেই তারা সাধারণ মবের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
চতুর্থ কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো প্রচার করতে চায় যে, বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত এবং আওয়ামী লীগই তাদের একমাত্র রক্ষক ছিল। এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে তারা আওয়ামী নেতাদের ওপর হামলা করে নিজেদের প্রচারণাকে দুর্বল করতে চায় না।
এছাড়াও, বিশ্লেষকরা বলছেন, জনতার রোষাণল থেকে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রেখেছেন এবং সেই নামে অনেকে দেশটির আধার কার্ডও বানিয়ে ফেলেছেন। একাজে তাদের সহায়তা করছে ভারতের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা র’ । আবার কেউ কেউ বলেছেন, মোদি সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় সেবাদাসদের সুরক্ষায় বিশেষ ডিজিটাল আইডিও সরবরাহ করা হয়ে থাকতে পারে। অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা পালানোর সময় লুটপাটের বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে নিয়ে গেছেন। আর সেই অর্থ দিয়ে সুরক্ষিত ও অভিজাত এলাকাগুলোতে বসবাস করছেন তারা। ফলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বাংলাদেশ ও মুসলিম-বিরোধী হিংস্র থাবা থেকে নিরাপদে খাকতে সক্ষম হচ্ছেন জনরোষের মুখে পালিয়ে বাঁচা এই সন্ত্রাসীরা।
ভারতে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে হামলা: ভুক্তভোগীদের প্রকৃত সংখ্যা কত?
ভারতে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার অনেক ঘটনাই পুলিশি নথিতে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে নথিবদ্ধ করা হয়। একটি প্রতিবেদন মতে, ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে কেবল ‘বাংলাদেশি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে হিন্দুত্ববাদী মবের গণপিটুনিতে অন্তত ১১ জন বাংলাভাষী মুসলিম নিহত হয়েছেন। সাউথ এশিয়া জাস্টিস ক্যাম্পেইনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেই ভারতে অন্তত ১০০ জন মুসলিম ধর্মীয় পরিচয় বা অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৭১৯ জনকে ‘অবৈধ’ তকমা দিয়ে বিতাড়িত করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বৈধ ভারতীয় আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও বাংলাভাষীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আসাম ও দিল্লিতে উচ্ছেদ অভিযান ও ধরপাকড়ের নামে কয়েক হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়েছে।
ভারতে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি এখন কেবল একটি জাতীয়তা নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণ শ্রমিকরা যখন পিটুনির শিকার হচ্ছেন, তখন প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে আড়ালে থাকছেন—যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে ‘দ্বিমুখী নীতি’ হিসেবে সমালোচিত হচ্ছে।
‘‘এটি একটি দ্বিচারিতা। যে ভাষায় কথা বলার কারণে বা যে ভৌগোলিক পরিচয় দেওয়ার কারণে একজন সাধারণ শ্রমিক পিটুনি খাচ্ছেন, সেই একই ভাষা ও পরিচয়ের রাজনৈতিক নেতারা (আওয়ামী লীগ) ভারতের উচ্চ মহলে আতিথ্য পাচ্ছেন’’ , বলছিলেন একজন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সমালোচকরা বলছেন, ভারতে ‘বাংলাদেশি’ তকমাটি এখন মূলত সাধারণ দরিদ্র ও মুসলিম বাংলাভাষীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে ‘পলাতক আওয়ামী সন্ত্রাসীরা’ সেখানে কেবল নিরাপদই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে সম্মানিত অতিথি হিসেবেই অবস্থান করছেন। এই রহস্যময় বৈপরীত্যই প্রমাণ করে যে, ভারতে মব ভায়োলেন্স কেবল কোনো অনুপ্রবেশ' বিরোধী আন্দোলন নয়, বরং এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় এজেন্ডার অংশ।