Image description

ভারতের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপির গেরুয়া রঙের ছটা পশ্চিমে গুজরাট ও রাজস্থান থেকে শুরু করে পুবে হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ হয়ে বিহারে এসে পড়েছে। এরপর একটু ভিন্ন রং। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গ তথা তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনাধীন রাজ্য।

এরপর আবার শুরু হয়েছে গেরুয়ার বিস্তার—আসাম থেকে মণিপুর ও সংলগ্ন রাজ্যগুলো।

ভূ-ভারতের পুব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত একটি ছাড়া সব রাজ্যেই বিজেপির শাসন। সেই রাজ্যটিই এবার বিজেপির 'মান রক্ষার' বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী মার্চ-এপ্রিলে সেখানে ২৯৪ আসনের বিধানসভা নির্বাচন। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ২১৫ আসন পেয়ে তৃণমূল হয় প্রধান দল। সেই নির্বাচনে ৭৭ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধীদল হয় বিজেপি।

তবে, ২০২৬ সালের নির্বাচনে দুই দলই চায় বিজয়ী হতে।

একটু ফিরে দেখা

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। তারা সেই রাজ্যে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে পরাজিত করে। সেই হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের শাসন চলছে প্রায় ১৪ বছর ধরে। বামদের রেকর্ড ভাঙতে দলটির প্রয়োজন আরও ২০ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকা।

কিন্তু, তৃণমূলকে আর ক্ষমতায় দেখতে নারাজ কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। তারা চায় পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা-ভাগীরথী বিধৌত পলি জমিতে 'পদ্ম' ফোটাতে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে তারা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাম্বলীদের মনে হিন্দুত্ববাদ জোরালো করতে চায়। বিজেপি বলছে—পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু বাঙালিদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। সেখানে মুসলমানরা ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি বদলাতে প্রয়োজন রাজ্যে নরেন্দ্র মোদির দলকে ক্ষমতায় আনা।

বিজেপি নেতারা বিষয়টিকে আখ্যা দিচ্ছেন 'ডাবল ইঞ্জিন' সরকার হিসেবে। অর্থাৎ, কেন্দ্র ও রাজ্য—উভয় জায়গায় বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে উন্নয়ন দ্রুততর হবে বলেও জনগণকে আশ্বাস দিচ্ছেন তারা।

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করে। এর দুই বছর পর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার উদ্যোগ নেয়। রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল থেকে অনেক আলোচিত নেতা বিজেপিতে যোগ দেন। তবে তাদের সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে।

পরপর দুইবার ব্যর্থ হলেও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী ভাবনার ব্যাপক বিস্তার ঘটানোর আশা ছাড়েনি বিজেপি। দলের নেতাকর্মীরা রাজ্যে হিন্দুধর্ম-পুরাণের চর্চা বাড়িয়ে দেন। তারা উত্তর ভারতের রামনবমীসহ অন্যান্য পুরাণভিত্তিক উৎসবকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কর্মসূচি নেন।

বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গের জনমনে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগানকে 'গেঁথে' দেওয়ার চেষ্টা করেন। হাজারো কর্মীর মাধ্যমে নেতারা রাম-হনুমানের মাহাত্ম্য বাঙালির 'ঘরে ঘরে' পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান।

এসবের পাশাপাশি বিজেপির নেতারা তৃণমূলের বিরুদ্ধে 'মুসলিম তোষণের' অভিযোগ তুলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন—শুধু হিন্দু ভোট নিজেদের বাক্সে আনতে পারলে জিতে যাবে বিজেপি। তাদের জিততে মুসলিম ভোটের প্রয়োজন হবে না।

ভারতের পার্লামেন্ট চত্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি হাতে বিরোধী সংসদ সদস্যদের বিক্ষোভ। ছবি: এবিপি আনন্দের সৌজন্যে

নতুন আশা বিহার-বিজয়

গত নভেম্বরে উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া পূর্ব ভারতীয় রাজ্য বিহার বিজয়ের পর বেশ চাঙা বিজেপি। ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য হিসেবে বিবেচিত বিহারের বিধানসভায় ২৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি-জোট পায় ২০২ আসন। বিজেপি এককভাবে পায় ৮৯ আসন। 

জাতপাতে জর্জরিত এই রাজ্যে বিজেপির এত আসন প্রতিবেশী রাজ্যের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে। তারা এখন নতুন আশায় উদ্বেলিত। আর সেই আশা হচ্ছে—পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এবার বিজেপির পতাকাকে সমুন্নত করা।

আগেই বলা হয়েছিল ২০১৪ সালে দিল্লির মসনদে বসার পর বিজেপি আশা করেছিল তাদের গেরুয়া বর্ণ দেশের রাজ্যগুলোকে রাঙিয়ে তুলবে। গত ১০ বছরে একের পর এক রাজ্য বিজেপি-জোটের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করলেও বাদ থেকে যায় পশ্চিমবঙ্গ।

সেই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের মন জয় করতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজ্য-ভ্রমণে এসে বাংলায় কথা বলেন। বাঙালি মনীষীদের ভারত-সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস-স্রষ্টা বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ'কে নরেন্দ্র মোদি নিয়ে আসেন রাজনীতির মঞ্চে।

পাঠকমাত্রই জানেন যে, 'আনন্দমঠ' একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। সেখানে লেখক হিন্দুদের শত্রু হিসেবে মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেছেন। আর শাসক ইংরেজদের বলেছেন হিন্দুদের 'ত্রাণকর্তা' হিসেবে। এই উপন্যাসটি অনেক মুসলমানের কাছে 'বিতর্কিত'। উপন্যাসে ব্যবহৃত 'বন্দে মাতরম' গানটিও একই তকমা পায়।

ইতিহাস বলছে—১৮৬৫ সাল থেকে ১৮৮৭ সালের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন ১৪ উপন্যাস। কালানুক্রম অনুসারে 'আনন্দমঠ' হচ্ছে ১২তম উপন্যাস। এটি লেখা হয়েছিল ১৮৮২ সালে। প্রায় ১৪৩ বছর পুরোনো এই উপন্যাসকে বিজেপি নেতা গ্রহণ করেছেন 'ব্রহ্মাস্ত্র' হিসেবে। এই বইয়ে ব্যবহার করা 'বন্দে মাতরম' গানটিকে নিয়ে করা হচ্ছে উৎসব।

গত ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দ এক প্রতিবেদনে জানায়—গত ৮ ডিসেম্বর 'বন্দে মাতরমের' দেড়শ বছর পূর্তি নিয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে 'বঙ্কিমদা' বলে সম্বোধন করেন।

বক্তৃতা চলার সময় এমন সম্বোধনের প্রতিবাদ করেন তৃণমূলের সংসদ সদস্য সৌগত রায়। তিনি 'বঙ্কিম বাবু' বলার পরামর্শ দেন। নরেন্দ্র মোদিও সঙ্গে সঙ্গে তা শুধরে নেন। তৃণমূল নেতাকে ধন্যবাদ দেন। তবে এটাও বুঝিয়ে দেন যে, বাংলা তার মাতৃভাষা নয়, তাই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়—শুধু তাই নয়, একই দিনে নরেন্দ্র মোদি একই স্থানে দাঁড়িয়ে আরেকটি ভুল করে বসেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী মাস্টারদা সূর্যসেনকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুধু 'মাস্টার' শব্দটি ব্যবহার করেন। ফলে রাজনৈতিক বিতর্কের পালে লাগে বাড়তি হাওয়া।

নতুন বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এমন শব্দচয়নকে 'আলোচনা'র বিষয় করেছে বিরোধী জাতীয় কংগ্রেস ও তাদের জোটসঙ্গী তৃণমূল কংগ্রেস। জাতীয় কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সরব হয়েছেন কেননা, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে 'বন্দে মাতরম' গানটির অঙ্গচ্ছেদের অভিযোগ আনা হয়েছে বিজেপির পক্ষ থেকে।

প্রিয়াঙ্কার জবাব ছিল—'বন্দে মাতরম' গানটিকে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে এমনটি করা হয়েছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছিলেন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, শীর্ষ নেতা সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও বাবাসাহেব আম্বেদকর।

বিরোধীদের পাশাপাশি বিজেপির জোটসঙ্গীদের কেউ কেউ বলছে—'বন্দে মাতরম' গান গেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী কংগ্রেস নেতাকর্মীরা যখন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তখন বিজেপির আদর্শ দল আরএসএস ইংরেজদের 'বন্দনা' করেছে।

এতকিছুর পরও বিতর্ক বিজেপির পিছু ছাড়েনি।

গত ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটিন-এর বাংলা সংস্করণে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়—'যেন মনে হচ্ছে শ্যামদা, হরিদা...', বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে 'বঙ্কিমদা', মোদিকে তীব্র কটাক্ষ মমতার।

প্রতিবেদনে বলা হয়—কারও নাম উচ্চারণ না করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'আপনাদের তো মাথা নিচু করে নাকখত দেওয়া উচিত জনগণের কাছে। তাতেও ক্ষমা হবে না।'

একইদিনে এবিপি আনন্দ জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির 'বঙ্কিমদা' মন্তব্যের বিরোধিতায় তৃণমূলের সংসদ সদস্যরা মৌন প্রতিবাদ করেছেন। সেসময় তাদের হাতে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ভোটের আগে বিজেপি বাংলার মানুষের মন পেতে চেষ্টা করে। বাংলার মনীষীদের নাম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উচ্চারণের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে প্রতিবারের মতো এবারও 'হোঁচট' খেলেন তিনি!