নতুন বছরের প্রথমদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। মোট আসন ২৯৪টি। গত নির্বাচনে ২১৫ আসন পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য-সরকার গঠন করে এবং ৭৭ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধীদল হয় বিজেপি।
আগামী নির্বাচনে এই দুই দলই বিজয় আশা করছে। তবে কোনো দলই ১৪৮ আসনের বেশি পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন তৃণমূলের বহিষ্কৃত নেতা ও মুর্শিদাবাদের প্রভাবশালী বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। বলেছেন—তিনি নতুন দল গঠন করবেন।
তৃণমূলের অনেক নেতা সদ্য বহিষ্কৃত হুমায়ুন কবীরের এমন ঘোষণায় বলছেন যে, তিনি 'বিজেপির হয়ে কাজ করছেন'।
এ দিকে, রাজ্যের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো থেকে ৯০ মুসলমান বিধায়ক নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছেন হুমায়ুন কবীর। তিনি মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বিজেপির 'ভয়' দেখিয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী বিধানসভা নির্বাচনে জিততে পারবেন না।

তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতার 'হিন্দু' তোষণনীতির সমালোচনা করে বলেছেন, এই তৃণমূল নেত্রী মুসলমানদের 'ভোট ব্যাংক' হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার মতে, গুজরাটে বিজেপি প্রায় ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। সেখান থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানরা পালিয়ে যায়নি। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলেও মনে করেন তিনি।
হুমায়ুন কবীরের বক্তব্য, 'আমার সমর্থন ছাড়া কেউ সরকার গঠন করতে পারবে না। কেউ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইলে আমার দলের বিধায়কদের সমর্থন লাগবে।'
সম্প্রতি, সংবাদমাধ্যম আজকাল বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়—ভারতে ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গেছে যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা ২৭ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। হিন্দু জনসংখ্যা ৭০ দশমিক ৫৪ শতাংশ
এতে আরও বলা হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে—২০২৫ সালে এই সংখ্যা অনেকটাই বদলে গেছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হতে পারে।
আর এমন পরিস্থিতিতে সেখানকার আঞ্চলিক আইন পরিষদ তথা বিধানসভার আসন্ন ভোটযুদ্ধ যেন পরিণত হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত 'ধর্মযুদ্ধে'।
পশ্চিমবঙ্গে 'বাবরি' মসজিদ ও 'রাম' মন্দির
গত ৬ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত জেলা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা-রেজিনগরের মধ্যবর্তী জায়গায় 'বাবরি' মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের ব্যানারে দেখা যায় এর আয়োজক ছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ শাখা। এর প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হুমায়ুন কবীরের নাম।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ধারাভাষ্যে বলা হয়—১৯৯২ সালে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বিজেপি-সমর্থকদের হাতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩৩ বছর বছর পর একই দিনে অযোধ্যা থেকে বহু দূর মুর্শিদাবাদে একই নামে মসজিদ তৈরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মুর্শিদাবাদে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তরের দিন হাজারো মানুষ ঘটনাস্থলে ভিড় করেন।

মসজিদ তৈরিতে সহায়তা হিসেবে কেউ এনেছিলেন ইট, কেউ সিমেন্টের বস্তা, কেউ বা রড। কেউ সহায়তা করেছেন নগদ টাকা দিয়ে। সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, সভাস্থলে রাখা ১১টি বড় দানবাক্স ভিত্তিপ্রস্তরের প্রথম দিনেই ভরে যায়। কিউআর কোড ব্যবহার করে টাকা পাঠানো হচ্ছে ব্যাংকে। বিদেশ থেকে অনুদান আনার জন্যও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সেদিনের ঘটনার উত্তেজনা পশ্চিমবঙ্গের আর সব উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। 'বাবরি' মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তরের দিন মহাসড়কে যানজট হওয়ায় সংবাদমাধ্যমের মূল দৃষ্টি পড়েছিল সেখানে। পায়ে হেঁটে বহু মানুষের ঘটনাস্থলে আসার পাশাপাশি অনেকের মাথায় ইট বহন করে আনার দৃশ্য সংবাদকর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।
পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলোর ভিডিওতে দেখা যায়—সারি সারি মানুষ অনুদানের টাকা গুনছেন। এমনকি, টাকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কর্মীদের টাকা গোনার মেশিন নিয়ে বসতে হয়। মসজিদ উদ্বোধনের জায়গা ভরে গেছে ইটের স্তূপে। সিমেন্ট-লোহার রডও জমেছে সমান তালে।
ঘটনাস্থলে আসা মানুষেরা তাদের ধর্মীয় আবেগ প্রকাশ করেন। কেউ বলেন, 'এতটুকুই সামর্থ্য ছিল, তা দিয়ে গেলাম'।
মানুষের আগ্রহ এত যে, গত ৮ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'তিনিও হুমায়ুন, তিনিও তৃণমূল বিধায়ক! মসজিদের জন্য টাকা দিতে চেয়ে একের পর এক ফোনে বিড়ম্বনায় ডেবরার কবীর'।
এতে আরও বলা হয়, তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুরের এক বিধায়কের নাম হুমায়ুন কবীর। গত দুই দিনে বহু মানুষ তাকে মুর্শিদাবাদের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর ভেবে ফোন দিয়েছিলেন অনুদান পাঠানোর ঠিকানা চেয়ে।
গত ৬ ডিসেম্বর দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বাংলা সংস্করণের এক প্রতিবেদনের শিরোনামে জানানো হয়—বাবরি মসজিদ নির্মাণের বাজেট ৩০০ কোটি। এতে আরও বলা হয়, এক ব্যবসায়ী একাই ৮০ কোটি টাকা দিতে চেয়েছেন।
'বাবরি' মসজিদের প্রধান উদ্যোক্তা হুমায়ুন কবীর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি সরকারের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা নেবেন না। তার যুক্তি—'নিলেই মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট হবে'।
শুধু তাই নয়, এই বিধায়ক আরও জানিয়েছেন যে শুধু মুর্শিদাবাদ বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্য এমনকি, বিদেশ থেকেও অনেকে 'বাবরি' মসজিদ তৈরির অনুদানে অংশ নিতে আগ্রহী।
ঘটনা এখানেই থেমে নেই। গত ৭ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দ জানায়—ইতোমধ্যে মালদা ও বীরভূম থেকেও 'বাবরি' মসজিদ তৈরির প্রস্তাব এসেছে বলে দাবি করেছেন বিধায়ক হুমায়ুন কবীর।
এত গেল মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের 'বাবরি' মসজিদের ঘটনা।
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলো আরও জানায়—একইদিনে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে বিজেপির সাবেক জেলা সভাপতি শাখারভ সরকারের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় রামমন্দিরের শিলাপূজা।
মন্দিরটি ঠিক কোন জায়গায় তৈরি করা হবে তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। কেননা, জমি বরাদ্দ নিয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকার জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করেন সেই বিজেপি নেতা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য—এই দুইটি ঘটনাস্থলের মধ্যে দূরত্ব ছিল ২৫ কিলোমিটার। তবে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আরও যোজন যোজন দূরে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায়শই ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির মোড়কে ঢেকে দেওয়া হলেও এবার বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যের রাজনীতি সরাসরি মসজিদ-মন্দিরে প্রবেশ করেছে।
কারো কারো মতে, আসন্ন ভোটের মাঠে সাধারণ মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সার্বিক উন্নয়নের পরিবর্তে যেন ধর্মপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভোটের আগে রাজ্যের মানুষ যেন এক 'ধর্মযুদ্ধের' প্রস্তুতি পর্বে যোগ দিয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর এবিপি আনন্দের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়—'ইঙ্গিত অন্তত তেমনটাই'।
'দু-কূল হারা' মমতা?
২০২৩ সালে মুসলিমপ্রধান মুর্শিদাবাদে এক বিধানসভার আসনের উপনির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী পরাজিত হন ভারতীয় কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট জোটের প্রার্থীর কাছে। সে বছর ৯ মার্চ বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—মমতা ব্যানার্জীর প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কি মোহভঙ্গ হয়েছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, তৃণমূল প্রার্থীর পরাজয়ের বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে বড় কারণ হচ্ছে—মুসলমানদের একটা অংশের কিছুটা 'মোহভঙ্গ' হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রতি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটারদের কাছে তিনি নিজেকে ধর্মপ্রাণ ও ধর্মজ্ঞান-সমৃদ্ধ হিন্দু হিসেবে তুলে ধরতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। আবার, প্রধান ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের 'ভাই' বলে পরিচয় দেন তিনি।

অনেকের মতে—একদিকে মন্দির উদ্বোধন, পূজায় অংশগ্রহণ ও অন্যদিকে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে যোগ, বিজেপির 'মুসলিমবিরোধিতা' থেকে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার আশ্বাস—সবই তিনি করে থাকেন রাজ্যের 'কল্যাণের' কথা মাথায় রেখে। তবে একসঙ্গে 'দুই কূল' রাখতে গিয়ে তিনি 'দুই কূল' হারাতে যাচ্ছেন।
সমালোচকদের কেউ কেউ বলছেন—দিঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি, দুর্গা পূজায় অনুদান বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া বা রামনবমীতে পশ্চিমবঙ্গে ছুটি ঘোষণা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে চাচ্ছেন।
অন্যদিকে, মাথায় আঁচল দিয়ে ঈদের জামাতে উপস্থিত হওয়া, সুখে-দুঃখে মুসলমানদের পাশে থাকার ঘোষণা, নতুন নতুন মাদরাসার অনুমোদন ইত্যাদির উদ্দেশ্য মুসলিমদের সন্তুষ্ট রাখা।
তারা মনে করছেন—দুই প্রধান ধর্মবিশ্বাসের মানুষদের খুশি রাখতে গিয়ে যেন সবাইকেই 'নাখোশ' করে ফেলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কারো দাবিই যেন তিনি ঠিকঠাক মেটাতে পারছেন না।
বিজেপি হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলে ২০১৪ সাল থেকে টানা ভারত শাসন করছে। সমালোচকদের অনেকে মনে করছেন, মমতা হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য বিজেপির মতো করে এত উচ্চস্বরে বলতে পারেন না; তার দল মূলত সব ধর্মের সমান অধিকারের কথা বলে। অন্যদিকে, অমুসলিম হয়ে মুসলমানদের সব দাবিও মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
তাই আগামী নির্বাচনে জয়ের আশায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ত নিজ রাজ্যের দুই প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আরও বেশি করে ধর্মের কথা বলতে পারেন। ধর্মের ধ্বজা হয়ত আরও উঁচুতে তুলে ধরতে পারেন। যদি তাই হয়, তাহলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে 'ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ' আরও জোরালো হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।