ইরানকে পুরোপুরি ধূলোয় মিশিয়ে দিতে বড়সড় আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল ইসরাইল। কিন্তু সেই অপারেশনের ‘নীল নকশা’ তেহরানকে পাচার করেছে ‘মিত্র’ যুক্তরাষ্ট্রের এক গুপ্তচর।
অভিযোগ উঠেছে, ইরানে হামলার নীল নকশা ও ইহুদিদের যাবতীয় গোপন পরিকল্পনা ইরানের হাতে তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর! এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই তোলপাড় শুরু হয়েছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি টেলিগ্রামে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ (সিআইএ)-র একগুচ্ছ গোপন নথি ফাঁস হয়। সেখানেই ছিল ইরানে সম্ভাব্য ইসরাইলি আক্রমণের যাবতীয় রণকৌশল। সিআইএ-র গুপ্ত নথি ফাঁস হতেই বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে ওয়াশিংটন।
এ ঘটনায় গত বছরের নভেম্বরে কম্বোডিয়ায় গ্রেফতার হন আসিফ উইলিয়াম রহমান। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার তথ্য ফাঁসের অভিযোগ আনে সিআইএ। শুধু তা-ই নয়, ইরানের সঙ্গেও ওই ব্যক্তির যোগাযোগ ছিল বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে সিআইএতে কর্মরত রয়েছেন আসিফ। পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাকে সেখানকার গুপ্ত তথ্য জোগাড় করার দায়িত্ব দিয়েছিল ওয়াশিংটন। এই তথ্যই তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রধান শত্রু ইরানের হাতে তুলে দেন বলে অভিযোগ।
সিআইএ সূত্রে খবর, আসিফ যে তথ্য পাচার করেছেন, তা কেবলমাত্র ‘পঞ্চনেত্র’ (ফাইভ আই) ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর গোয়েন্দাদের কাছে থাকার কথা। আমেরিকা ছাড়া সেই তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং ব্রিটেন। এরা প্রত্যেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশ। ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ায় তাদের কাছেও মুখ পুড়েছে ওয়াশিংটনের।
গোয়েন্দাদের দাবি, মূলত ন্যাশনাল জিওস্প্যাশিয়াল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি (এনজিএ) দ্বারা সংগৃহীত তথ্য পাচার এবং ফাঁস করেছেন আসিফ। কৃত্রিম ফৌজি উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণের কাজ করে থাকে আমেরিকার এই সংস্থা।
ইরানে প্রত্যাঘাতের জন্য যুদ্ধবিমান নিয়ে লাগাতার মহড়া চালায় ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। সেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সম্বলিত রিপোর্ট সিআইএকে পাঠিয়েছিল ওই সংস্থা।
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া নথিগুলো গত বছরের ১৫ ও ১৬ অক্টোবরের। ইরানের প্রতি সহানুভূতিশীল টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
নথিতে আমেরিকার গুপ্তচর উপগ্রহের পাঠানো ছবি ও তার ব্যাখ্যা রয়েছে। ইরানে হামলা চালাতে কীভাবে আইডিএফ প্রস্তুতি নিচ্ছে, কোন কোন হাতিয়ারের ব্যবহার হতে পারে, সেই সংক্রান্ত তথ্যও ছিল সেখানে।
ফাঁস হওয়া দু’টি নথির মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল, ‘ইসরাইল: ইরানে প্রত্যাঘাতের জন্য বিমানবাহিনীর নিরন্তর অনুশীলন’। ওই নথিতে ছিল আইডিএফের বিমানবাহিনীর কসরতের একাধিক ছবি।
মাঝ আকাশে যুদ্ধবিমানে জ্বালানি ভরানোর অনুশীলনে জোর দেয় ইহুদি সেনারা। মহড়ায় ব্যবহার হয়েছিল ৪ থেকে ৫ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা।
পাশাপাশি, অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজের অনুশীলনেও জোর দিয়েছিল ইসরাইল। ইরানে ঢুকে আক্রমণ চালালে প্রত্যাঘাত আসার আশঙ্কা রয়েছে। সেই কথা মাথায় রেখে আগাম প্রস্তুতি নেয় ইসরাইল।
আইডিএফের আশঙ্কা ছিল, ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে ইরান। প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ‘বায়ু প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) তৈরি রাখে তারা।
সিআইএ গুপ্তচরের থেকে ইসরাইলি হামলার পরিকল্পনার বিষয়টি কানে যেতেই সময় নষ্ট করেনি তেহরান। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসে ইরানি প্রশাসন।
পাশাপাশি, এই ইস্যুতে সরাসরি হুমকি দেয় তারা। ইসরাইল আক্রমণ চালালে কঠিন পরিণাম ভুগতে হবে বলেও সতর্ক করে দেশটি। ফলে বাধ্য হয়ে ‘অপারেশন তেহরান’ থেকে সরে আসে ইসরাইল।
গত বছরের অক্টোবর ইসরাইলের উপর বড় আকারের আক্রমণ চালায় ইরানের ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ (আইআরজিসি)। অন্তত ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে চলে লাগাতার হামলা করে দেশটি। সেগুলোর অধিকাংশই মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে পারেনি ইহুদিদের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)।
এই হামলার পরেই ইরানকে হুঁশিয়ারি দেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। স্পষ্ট ভাষায় তিনি জানিয়েছিলেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফল ভুগতে হবে ইরানকে। ওই সময়ে ইরানকে সতর্ক করেছিল আমেরিকাও।
সূত্রের খবর, এরপরই তেহরানকে পুরোপুরি ধূলোয় মিশিয়ে দিতে যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে ফেলে আইডিএফ। অক্টোবরের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে পারস্য উপসাগরের তীরে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল ইহুদি সেনারা। কিন্তু হামলার ‘নীল নকশা’ ফাঁস হওয়ায় বাধ্য হয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন নেতানিয়াহু।