Image description
 

যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের সম্ভাব্য সম্মেলন নিয়ে যে জল্পনা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকটাই অতিরঞ্জিত বলে মনে হচ্ছে।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাঙ্গেরিতে ‘দুই সপ্তাহের মধ্যে’ সাক্ষাৎ করবেন, তার কয়েক দিনের মধ্যেই অনির্দিষ্টকালের জন্য সেই সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।

 
 

দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের মধ্যে প্রাথমিক বৈঠকও বাতিল করা হয়েছে।

মঙ্গলবার বিকেলে হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আমি এমন কোনো বৈঠক করতে চাই না যা বৃথা যাবে। আমি সময় নষ্ট করতে চাই না, তাই দেখি কী হয়।’

Trump Putin up

এই অনিশ্চিত সম্মেলন ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা চেষ্টার সবশেষ অধ্যায়-গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন করার পর যে বিষয়ে তিনি নতুন করে মনোযোগ দিচ্ছেন।

গত সপ্তাহে মিশরে সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তির উদযাপন উপলক্ষে বক্তব্য দেয়ার সময় ট্রাম্প তার প্রধান কূটনৈতিক মধ্যস্থতাকারী স্টিভ উইটকফের দিকে ফিরে নতুন একটি অনুরোধ জানান।

তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার বিষয়টা শেষ করতে হবে।’

তবে গাজায় সাফল্য অর্জনের জন্য যে অনুকূল পরিস্থিতি পেয়েছিল উইটকফ ও তার দল, সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে তৈরি করা কঠিন হতে পারে, কারণ এই যুদ্ধ প্রায় চার বছর ধরে চলছে।

 

ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রভাব গাজায় কার্যকর হলেও ইউক্রেনে সীমিত:

স্টিভ উইটকফের মতে, গাজা চুক্তি বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি ছিল কাতারে হামাসের মধ্যস্থতাকারীদের ওপর ইসরাইলের হামলার সিদ্ধান্ত।

এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদের ক্ষুব্ধ করলেও ট্রাম্পের হাতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে চুক্তিতে রাজি করানোর জন্য প্রয়োজনীয় চাপ তৈরির সুযোগ এনে দেয়।

প্রথম মেয়াদ থেকেই ইসরাইলের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অব্যাহত সমর্থন এক্ষেত্রে তাকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত, পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতির বৈধতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক অভিযানে তার সমর্থন।

আসলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইসরাইলিদের মধ্যে নেতানিয়াহুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয়-যা তাকে ইসরাইলি নেতার ওপর একটি অনন্য প্রভাব প্রদান করে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ আরব নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক, যা তাকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থানে নিয়ে আসে।

তবে, ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের প্রভাব সেই তুলনায় অনেক কম।

গত নয় মাসে তিনি কখনো পুতিনকে, কখনো জেলেনস্কিকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তেমন কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

 

ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের এবং ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র সরবরাহের।

তবে, তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, এমন পদক্ষেপ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিঘ্নিত করতে পারে এবং যুদ্ধকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।

এদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে জেলেনস্কিকে ভর্ৎসনা করেছেন, সাময়িকভাবে ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করেছেন এবং দেশটিতে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করেছেন।

যদিও পরে ইউরোপীয় মিত্রদের উদ্বেগের মুখে তিনি সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন।

তারা সতর্ক করেছিলেন যে ইউক্রেনের পতন পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

পুতিনের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন ট্রাম্প?

ট্রাম্প তার চুক্তি করার ক্ষমতা নিয়ে গর্ব করেন, কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে তার সরাসরি বৈঠকগুলো যুদ্ধের সমাধানের দিকে কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি।

পুতিন সম্ভবত ট্রাম্পের চুক্তি করার আগ্রহ এবং সরাসরি আলোচনার প্রতি বিশ্বাসকে ব্যবহার করছেন তাকে প্রভাবিত করার একটি উপায় হিসেবে।

জুলাই মাসে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আলাস্কায় একটি সম্মেলনের বিষয়ে সম্মত যখন, যখন সিনেট রিপাবলিকানদের সমর্থিত নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজে ট্রাম্প স্বাক্ষর করতে যাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছিল। পরে সেই আইনটি স্থগিত করা হয়।

 

গত সপ্তাহে, যখন খবর ছড়ায় যে, হোয়াইট হাউজ ইউক্রেনকে টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি-এয়ার ব্যাটারি পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে, তখন রুশ নেতা ট্রাম্পকে ফোন করেন, যিনি এরপর বুদাপেস্টে সম্ভাব্য সম্মেলনের কথা বলেন।

পরদিন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে জেলেনস্কিকে স্বাগত জানান, কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ সেই বৈঠক কোনো ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়।

তবে ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেন, তিনি পুতিনের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন না।

তিনি বলেন, ‘তোমরা জানো, আমি জীবনে সেরা সেরা লোকদের সাথে খেলেছি এবং আমি ভালোভাবেই বেরিয়ে এসেছি।’

যদিও ইউক্রেনীয় নেতা ভলোদিমির জেলেনস্কি পরে এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা তুলে ধরেন।

 

তিনি বলেন, ‘যখনই দীর্ঘপাল্লার আঘাত হানার বিষয়টি আমাদের ইউক্রেনের জন্য কিছুটা দূরে চলে গেল, তখনই রাশিয়া প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কূটনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল।’

সুতরাং কয়েক দিনের মধ্যেই ট্রাম্প ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর সম্ভাবনা থেকে পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্টে সম্মেলনের পরিকল্পনায় চলে যান এবং ব্যক্তিগতভাবে জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস-যার কিছু অংশ রাশিয়া এখনো দখল করতে পারেনি-ছেড়ে দিতে চাপ দেন।

শেষ পর্যন্ত তিনি বর্তমান যুদ্ধরেখা ধরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন, যা রাশিয়া গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

গত বছর নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন।

পরে তিনি সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে বলেন, যুদ্ধ শেষ করা তার প্রত্যাশার চেয়ে কঠিন প্রমাণিত হচ্ছে।

এটি তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং এমন একটি শান্তির কাঠামো খুঁজে পাওয়ার কঠিন বাস্তবতা স্বীকার করার একটি বিরল উদাহরণ-যেখানে কোনো পক্ষই যুদ্ধ থামাতে চায় না বা থামাতে সক্ষম নয়।

 

সূত্র: বিবিসি বাংলা