
নাজমুন নাহার। বয়স ৩২ বছর। দুই সন্তানের জননী। চলতি বছরের মার্চে অনুভব করেন বুকে চিন চিন ব্যথা হচ্ছে। মাঝে মধ্যে অক্সিজেন স্বল্পতা বা শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সন্দেহবশত এসেছেন জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে। নানা ধরনের টেস্ট শেষে ধরা পড়ে তার হার্টের ভাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিস্থাপন করতে হবে।
কিন্তু তিনি অপারেশনের জন্য ফিট নন। কারণ তার হার্টরেট অস্বাভাবিক রকম কম (এলভিইএফ-৩২)। দীর্ঘ আট মাসের চিকিৎসায় সেটা বাড়ানো যাচ্ছে না। বরং কমছে। রাজধানীর হৃদরোগ হাসপাতাল, হার্ট ফাউন্ডেশন, কল্যাণপুরের আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসকরা তার এই জটিল অপারেশনের জন্য প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ের কথা বলেন। তারপরও সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম স্বামীও তাকে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে দিশাহারা। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। জমিজমা বিক্রি করে টাকা না হয় ম্যানেজ করলেন, কিন্তু সফল না হলে দুই সন্তানকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন!
একই অবস্থা প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকের ইলেক্ট্রিশিয়ান ইব্রাহীমের। চার মাস আগে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক নিয়ে আসছিলেন হৃদরোগ হাসপাতালে। পরীক্ষা করে ধরা পড়েছে তার তিনটি রিং পরাতে হবে। আর্থিক অসংগতির জন্য তাৎক্ষণিক রিং পরানো সম্ভব হয়নি। পরে প্রস্তুতি নিয়ে এসে দেখা যায়, তার হার্টের পাম্পিং রেট কম। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। এটা ঠিক করার জন্য ওষুধ দিয়েছেন চিকিৎসক। ঠিক হলে রিং পরানো হবে। সেখানে তার খরচ প্রায় চার লাখ টাকা। তিনিও অর্থের জোগাড় করতে গিয়ে দিশাহারা।
প্রতিরোধে নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও মাদক থেকে দূরে থাকা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকেও এ বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।- ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ
১৫ অক্টোবর হৃদরোগ হাসপাতালের এক রুমে ১৫ মিনিট বসেই নাজমুন নাহার আর ইব্রাহীমের এ গল্প জানা যায়। প্রতিদিন এই হাসপাতালে এমন সংকট (হৃদরোগ) নিয়ে আসেন অন্তত ১৫ থেকে ১৬শ রোগী। কত হাহাকারের সাক্ষী এই হাসপাতাল!
একই চিত্র রাজধানীর ক্যানসার হাসপাতালের। ধুঁকে ধুঁকে মরছেন মানুষ। দিনের পর দিন থেরাপি আর টেস্ট করতে করতে ব্যয় হয়ে যায় জীবনের সব সঞ্চয়। বহু মানুষের ভিটামাটিও বিক্রি করতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট বলছে, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসসহ অসংক্রামক রোগগুলো বর্তমানে বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ। ২০২১ সালে এসব রোগে অন্তত চার কোটি ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে এক কোটি ৮০ লাখের বয়স ছিল ৭০ বছরের নিচে। এই অকাল মৃত্যুর ৮২ শতাংশ ঘটেছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। একই সঙ্গে, বিশ্বব্যাপী এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
সমাধানে প্রথমত প্রতিরোধে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যয় সরবরাহ স্বাভাবিক করতে স্বাস্থ্য বিমা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন।
এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা এসেছে, কিন্তু সেগুলোর খরচ এত বেশি যে মানুষ ফতুর হয়ে যায়। সরকার যদি আধুনিক ও কার্যকর চিকিৎসাসেবা সরকারি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে জনগণ বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয় থেকে রক্ষা পাবে।- ডা. বেনজির আহমেদ
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অসংক্রামক ব্যাধি (Non-communicable Diseases - NCDs) এমন রোগ, যা সংক্রমণ ছাড়াই হয় এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না। এর মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ, মানসিক রোগ অন্যতম। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে দায়ী এই অসংক্রামক ব্যাধিগুলো, বিশেষত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে এর প্রকোপ ভয়াবহভাবে বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই রোগগুলোর মূল কারণ— অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান-মাদক সেবন, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি গ্রহণ, বায়ুদূষণ, প্রযুক্তির অপব্যবহার, মানসিক চাপ ও সচেতনতার ঘাটতি। এছাড়া জেনেটিক বা পারিবারিক ইতিহাসও একটি বড় কারণ।’
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘প্রতিরোধে করণীয় হলো—নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ও মাদক থেকে দূরে থাকা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকেও এ বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ, একবার আক্রান্ত হলে এসব রোগ আজীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে—প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। এসব রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা করতে গিয়ে বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। বিশেষ করে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নিঃস্ব হয়ে যায়। অন্তত স্বাস্থ্য বিমা করলে কিছুটা সহায় হতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই রোগগুলো একবার হলে সারানো কঠিন, কিন্তু প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য রাষ্ট্রকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে।’
বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। আমরা এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে একাধিক সভা হয়েছে। আমরা অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে একটি কৌশলপত্র তৈরিতে কাজ করছি। আশা করি, আমরা ভালো কিছু করতে পারবো।- স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান
‘সারাদেশে শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামকে উৎসাহিত করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। যদি প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ফিজিক্যাল ট্রেনার নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে জনগণ নিয়মিত ব্যায়ামে অভ্যস্ত হবে— নতুন ডায়াবেটিস বা হৃদরোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।’ বলেন তিনি।
ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে একটি ক্যানসার হাসপাতাল দিয়ে চলবে না। প্রতিটি বিভাগে একটি করে ক্যানসার হাসপাতাল থাকা জরুরি।’
তিনি চিকিৎসার মানোন্নয়ন ও সহজলভ্যতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘এখন অনেক আধুনিক চিকিৎসা এসেছে, কিন্তু সেগুলোর খরচ এত বেশি যে মানুষ ফতুর হয়ে যায়। সরকার যদি আধুনিক ও কার্যকর চিকিৎসাসেবা সরকারি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে জনগণ বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয় থেকে রক্ষা পাবে।’
রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের দিকটি স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে যেমন সচেতনতা ও জীবনধারা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি চিকিৎসার সুযোগও বাড়াতে হবে। প্রতিটি জেলায় উন্নত হৃদরোগ চিকিৎসা যেমন রিং স্থাপনের সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে, মানুষ অক্ষম না হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তাই প্রতিরোধ ও চিকিৎসা— এই দুই দিকেই রাষ্ট্রকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, যাতে মানুষ সুস্থও থাকে, সম্পদও টিকে থাকে।’
এ বিষয়ে সরকারের স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। আমরা এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে একাধিক সভা হয়েছে। আমরা অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে একটি কৌশলপত্র তৈরিতে কাজ করছি। আশা করি, আমরা ভালো কিছু করতে পারবো।’
সরকারি উদ্যোগে অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে ‘রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২০২৫’ বাস্তবায়ন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডি কর্নার স্থাপন করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রোগ শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য ও সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর নানান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।