Image description

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে যুদ্ধবিরতি চলার মধ্যেও গত কয়েক দিনে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় প্রায় ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ২৩০ জন।

যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ নিয়ে উত্তেজনা চলার মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা একাধিকবার নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছেন এবং গাজায় বোমা বর্ষণ করেছেন। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাফা এলাকায় হামাস যোদ্ধারা তাদের সেনাদের ওপর হামলা করেছেন। আর এ অভিযোগ তুলে তারা গাজায় হামলা চালিয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং প্রায় ২০০ জনকে বন্দী করে গাজায় নিয়ে আসা হয়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় নির্বিচার ও নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মোট ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মানুষ আহত হয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলের চালানো হত্যাযজ্ঞকে জাতিসংঘ–সমর্থিত একটি কমিশন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিগত নিধন হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এখন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠছে। তা হলো যুদ্ধবিরতি আসলে কে ভেঙেছে? এখনো কি যুদ্ধবিরতি চলছে? ফিলিস্তিনি জনগণ কি শেষ পর্যন্ত শান্তি ও সহায়তা পাচ্ছেন?

এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আমরা যা জানি—

কেন বলা হচ্ছে যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন হয়েছে

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত রোববার বলেছে, হামাস চুক্তি লঙ্ঘন করেছে এবং রাফায় সংগঠনটির দুই যোদ্ধা দুই ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করেছেন।

এরপর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ‘ব্যাপক ও বিস্তৃত’ হামলা চালায়।

হামাসের সশস্ত্র শাখা কাসেম ব্রিগেডস বলেছে, তারা কোনো সংঘর্ষের খবর জানে না। তাদের দাবি, রাফা এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ওই এলাকায় কোনো ফিলিস্তিনি যোদ্ধার সঙ্গে ব্রিগেডসের যোগাযোগ হয়নি।

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের যে এই একটি অভিযোগই তোলা হয়েছে, তা নয়।

ইসরায়েল বলেছে, হামাস ২৮ জিম্মির মরদেহ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে দেরি করছে। এই জিম্মিরা গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলার সময় নিহত হয়েছিলেন।

হামাস শুরু থেকেই বলে আসছে, যুদ্ধে বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে সব জিম্মির মরদেহ এবং প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনির মরদেহ খুঁজে বের করতে ভারী খননযন্ত্রের প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ২০ দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই যুদ্ধবিরতি হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে এবং কাতার, মিসর ও তুরস্কের সহায়তায় যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করা হয়।

যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো কী ছিল

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ২০ দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই যুদ্ধবিরতি হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে এবং কাতার, মিসর ও তুরস্কের সহায়তায় যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করা হয়।

হামাস বলছে, তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার এবং একটি ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রশাসনের’ হাতে গাজার শাসনভার তুলে দেওয়ার শর্তও গ্রহণ করেছে।

বাকি দাবিগুলোর বিষয়ে হামাস বলেছে, এগুলোকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ফিলিস্তিনি জাতীয় কাঠামোর মধ্যে রেখে সমাধান করতে হবে। তারা ওই জাতীয় কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে এবং এতে তারা সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখবে।

ইসরায়েল কি চুক্তির শর্ত মানছে

গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় বলেছে, ইসরায়েল ৮০ বার যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে এবং অন্তত ৯৭ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

গত শুক্রবার ইসরায়েলি সেনারা একটি বেসামরিক যানে গুলি চালান। এতে জেইতুন এলাকার আবু শাবান পরিবারের ১১ সদস্য নিহত হন। এর মধ্যে সাত শিশু এবং তিন নারী ছিলেন। পরিবারটি তাদের বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।

গত রোববার গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলা ও অন্যান্য হামলায় বেশ কয়েকজন নিহত হন।

গতকাল ইসরায়েল আবার চুক্তি মেনে চলবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পরও তারা গাজার উত্তরাঞ্চলীয় শুজাইয়া এলাকায় কয়েকজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের দাবি, ওই ফিলিস্তিনিরা ‘ইসরায়েলি সেনাদের জন্য হুমকি’ তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ‘হলুদ সীমারেখা’ অতিক্রম করেছেন।

যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজায় যে সীমা বরাবর ইসরায়েলি বাহিনী সরে এসেছে, তাকে ‘হলুদ সীমা’ বলা হয়। এই সীমানা পেরোনোর ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রেখেছে এবং রাফা ক্রসিং বন্ধ রেখেছে। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘকে ইসরায়েল বলেছে, তারা কেবল ৩০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেবে—যা চুক্তিতে উল্লিখিত সংখ্যার অর্ধেক।

গাজার মধ্যাঞ্চলীয় বুরেইজ শিবিরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের একটি ভবন লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলার পর ফিলিস্তিনিরা ছোটাছুটি করছেন। ১৯ অক্টোবর
গাজার মধ্যাঞ্চলীয় বুরেইজ শিবিরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের একটি ভবন লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলার পর ফিলিস্তিনিরা ছোটাছুটি করছেন। ১৯ অক্টোবরছবি: এএফপি

হামাস কি চুক্তির শর্ত মানছে

হামাস ২০ জীবিত জিম্মির সবাইকে মুক্তি দিয়েছে এবং বারবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। ২৮ জন মৃত জিম্মির মধ্যে ১২ জনের মরদেহ উদ্ধার করে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

গত শুক্রবার হামাস আবারও বলেছে, তারা যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে ইসরায়েলি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার করা খুবই কঠিন।

হামাস বলছে, নতুন সরঞ্জাম ও বাইরের সহায়তা ছাড়া এই তৎপরতা ধীর হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত তা শেষ করা যাবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।

হামাস যখন জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন গাজার উদ্ধারকারী সংস্থা সিভিল ডিফেন্স বলেছে, অঞ্চলজুড়ে ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।

গত শুক্রবার হামাস আবারও বলেছে, তারা যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে ইসরায়েলি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার করা খুবই কঠিন।

মানুষ কি বাড়ি ফিরতে পারছেন

সত্যিকার অর্থে, না।

ইসরায়েলের বোমা হামলায় পুরো এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এতে সেখানকার বাসিন্দারা এলাকায় ফিরে তাঁদের বাড়ির ঠিকানা শনাক্ত করতে পারছেন না।

তা ছাড়া ইসরায়েল একটি ‘অদৃশ্য হলুদ রেখা’ টেনে রেখেছে। ওই রেখার বাইরে গেলে ফিলিস্তিনিরা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। বিষয়টি অনেকের মধ্যে ভয় তৈরি করেছে। বিশেষ করে যাঁরা জানেন না তাঁদের বাড়ি হলুদ রেখার ইসরায়েলি অংশে নাকি ফিলিস্তিনি অংশে। এ নিয়ে তাঁরা ভয়ে আছেন।

একটি খসড়া মানচিত্রে দেখা গেছে, হলুদ রেখা টেনে দেওয়ার মধ্য দিয়ে গাজার প্রায় ৫৮ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।

মানবিক সাহায্য অবরুদ্ধ রাখায় গাজায় খাদ্য ও অন্যান্য অপরিহার্য সম্পদ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ইসরায়েল সরকার পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তারা বলেছে, ‘নতুন করে সন্ত্রাসের ঝুঁকি দেখা না দিলে’ তারা একটি বাফার জোন মেনে চলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শর্তের এসব ফাঁকফোকর ইসরায়েলকে গাজায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান করার সুযোগ দেবে।

তাহলে যুদ্ধবিরতি চলছে নাকি ভেঙে গেছে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর আছে। তিনি আবারও বলেছেন, মার্কিন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি ‘খুব শান্তিপূর্ণ’ রাখার দিকে নজর দেবেন।

ইসরায়েলের হামলায় রোববার বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি আবারও শুরু হয়েছে এবং সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

হামাস বলেছে, তারা এখনো যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে চলতে এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।