
পিএলও বা প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অথরিটির প্রবাদপ্রতিম নেতা ইয়াসের আরাফাত ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সব সময় 'আমার বড় বোন' বলে সম্বোধন করতেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে দিল্লিতে যে নির্জোট আন্দোলনের (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, তাতে তিনি 'রাষ্ট্রনেতা' হিসেবে উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ পর্যন্ত দিয়েছেন।
সমকালীন ইতিহাসের পর্যবেক্ষকরা সবাই মানেন ইন্দিরা ও আরাফাতের মধ্যে অসম্ভব পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল, বিরাট ভরসার সম্পর্ক ছিল। আর সেই আস্থা ও বন্ধুত্ব শুধু ব্যক্তিগত পরিসরেই নয়, ভারতীয় ও ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়েছিল।
আসলে ভারতের জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত মোহনদাস গান্ধী থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু বা তার কন্যা ইন্দিরা – প্রত্যেকেই চিরকাল ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে জোরালো সমর্থন জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে যে ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে সেই জমিতে মর্যাদার সঙ্গে তাদের বাঁচার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর থেকেই শত শত ফিলিস্তিনি ছাত্র প্রতি বছর বৃত্তি নিয়ে ভারতে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসত, ভারতের নিজের আর্থিক অবস্থা যাই হোক, ফিলিস্তিনে ত্রাণ, রসদ ও সহায়তা পাঠানো হতো প্রতি বছরই। এই ধারা পুরো মাত্রায় বজায় ছিল ১৯৮০র দশক পর্যন্ত।
বস্তুত এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই স্বাধীন ভারতের আটাত্তর বছরের ইতিহাসে অধিকাংশ সময় জুড়েই ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সারা বিশ্বের নির্যাতিতদের পাশে থেকেছে।
আর এই অবস্থানের পক্ষে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ছিল প্যালেস্টাইনের প্রতি ভারতের অব্যাহত সংহতি – দিল্লি শুধু ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকেই স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারেও বরাবর সক্রিয় সমর্থন জানিয়ে এসেছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের বয়স যখন মাত্রই মাসতিনেক, তখনই তারা জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে টুকরো করার 'পার্টিশন প্ল্যানে' আপত্তি জানায় এবং জাতিসংঘে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্তিরও বিরোধিতা করে।
ফিলিস্তিন ও ভারত, উভয়েরই যে উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের অভিন্ন ইতিহাস - দিল্লির এই নীতিগত অবস্থানের বীজ সম্ভবত নিহিত ছিল সেই বাস্তবতাতেই।
আর এ কারণেই আরব বিশ্বের বাইরে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে সবচেয়ে জোরালো আন্তর্জাতিক কন্ঠস্বর হয়ে উঠতেও ভারতের দেরি হয়নি।
১৯৭৪ সালে বিশ্বের প্রথম নন-আরব রাষ্ট্র হিসেবেও ভারত পিএলও-কে ফিলিস্তিনি জনতার একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, পরের বছরই দিল্লিতে চালু হয় পিএলও-র কার্যালয়।
এমন কী ১৯৮৮ সালের ১৮ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে 'রাষ্ট্র' হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় ভারত, যার কয়েক বছর পর পশ্চিম তীরের রামাল্লায় চালু হয় ভারতীয় দূতাবাসও। টেকনিক্যাল কারণে সেটিকে অবশ্য দূতাবাস না বলে ভারতের 'প্রতিনিধি কার্যালয়' বলাটাই রেওয়াজ।
ফিলিস্তিনের বন্ধু থেকে ইসরাইলের বন্ধু
আর ঠিক এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা আছে বলেই গত দুবছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল – রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভারতের নীরবতা এবং ইসরাইলের নিন্দা জানানোর ব্যর্থতা দেশ-বিদেশের বহু পর্যবেক্ষককে স্তম্ভিত করেছে।
এমন কী, ২০২৩র অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির ডাক দিয়ে জাতিসংঘে আনা চারটি বড় প্রস্তাবেও ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে। কারণ দেখানো হয়েছে, সহিংসতার সূচনা যে হামাসের হাতে, সেটা কেন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
নিজেদের 'গ্লোবাল সাউথে'র নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় দেখতে চাইলেও এই প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ছিল স্পষ্টতই অন্য সতীর্থদের চেয়ে ভিন্ন!
ঐতিহাসিক জোয়া হাসানের মতে, "ভারতের এই নীরবতা শুধু চরম নৈতিক ব্যর্থতাই নয়, নিজেদেরই রাষ্ট্রীয় লিগ্যাসির সঙ্গে এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতার সামিল!"
যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন এক সময় ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ ছিল, ইসরাইলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে সেই স্তম্ভকেই ধূলিসাত করে দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
ভারতের সুপরিচিত লেখক অরুন্ধতী রায় আবার তার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নয় – ভারতের আমজনতা বা সাধারণ মানুষও আজ ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেছেন, যে কারণে দেশের কোনও প্রান্তে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনও টুঁ শব্দটিও হয়নি বললেই চলে!
কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে এই নাটকীয় পটপরিবর্তনটা কীভাবে সম্পন্ন হলো?
একদা বহির্বিশ্বে ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারত কীভাবে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ইসরাইলের সঙ্গে নির্দ্বিধায় হাত মেলাল?
এই প্রতিবেদনে সংক্ষেপে উত্তর খোঁজা হয়েছে সে সব জটিল প্রশ্নেরই।
ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট
ভারতের ফিলিস্তিন নীতিতে এই পরিবর্তনের সূত্রপাত ১৯৯০র দশকের গোড়ার দিকেই, যখন ভারত ইসরাইলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ ও আমেরিকাতে নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেন এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন।
বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে রণেন সেন জানাচ্ছেন, ইসরাইলকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার এই পদক্ষেপের সূচনা হয়েছিল নিউ ইয়র্কে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষেদের অধিবেশনের সাইডলাইনে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের বৈঠকের মধ্যে দিয়ে।
রণেন সনের কথায়, "বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রর প্রতি শিমন পেরেজের অঙ্গীকার রাজীব গান্ধীকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল।"
"শিমন পেরেজ তাকে এটাও বোঝাতে পেরেছিলেন, ভারত যেমন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে 'গণতন্ত্রের একমাত্র দ্বীপ', কিংবা জাপান পূর্ব এশিয়াতে – তেমনি ইসরাইলও পশ্চিম এশিয়াতে ঠিক তাই!"
ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে উভয় দেশই যে উপকৃত হবে, দুই নেতাই সে ব্যাপারটায় একমত হয়েছিলেন।
এরপরই রণেন সেনকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন, পরবর্তী চার বছরের মধ্যে যাতে এই লক্ষ্য (ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান) অর্জন করা যায় , সেই লক্ষ্যে একটি 'রোডম্যাপ' তৈরি করে সেই অনুযায়ী কাজকর্ম শুরু করতে।
এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল ডেভিস কাপ টেনিসের ম্যাচগুলোতে ইসরাইলের জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা, ভারতের মাটিতে যে সব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাগুলো হতো তাতে ইসরাইলি প্যাভিলিয়নে তাদের পতাকা রাখা, বোম্বে শহরে ইসরাইলি কনস্যুলেটকে আপগ্রেড করে তাদের কাজের পরিধি বাড়ানো – ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে রাজীব গান্ধী ১৯৮৯র নির্বাচনে হারার পর ভিপি সিং ও চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে যে দুটি স্বল্পমেয়াদি সরকার দেশের ক্ষমতায় এসেছিল, তারা কেউই এই উদ্যোগ নিয়ে এগোনোর বিশেষ গরজ দেখাননি।
ইসরাইল অবশেষ ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতি পায় পরবর্তী কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাওয়ের আমলে। রাজীব গান্ধী তার কয়েক মাস আগেই এলটিটিই-র তামিল সুইসাইড স্কোয়াডের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
আরাফাতকে পাশে বসিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতির ঘোষণা
ভারত যখন অবশেষে ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়, তার ঠিক আগে পিএলও-র অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসের আরাফাতকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার তখন লোকসভায় দলের এমপি, ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে তার কিছুকাল আগেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন।
সেই আইয়ার সম্প্রতি একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, আরাফতের সেই সফরে তার সঙ্গে ফিলিস্তিনি নেতার একান্তে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল।
"বাতাসে তখন খুব জোর জল্পনা নরসিমহা রাও ইসরাইলকে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে চলেছেন। আমি আরাফাতকে বললাম, একমাত্র আপনিই পারেন ভারতকে এই বিপর্যয়ের পথে যাওয়া থেকে ঠেকাতে!"
"আরাফাত আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন, কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না", লিখেছেন মণিশঙ্কর আইয়ার।
"পরদিন আমি অসহায় হয়ে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আপগ্রেড করার কথা ঘোষণা করছেন – আর ঠিক তার পাশে বসা ইয়াসের আরাফাত সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন!"
আসলে তখন বিশ্বে খুব কম লোকই জানতেন, নরওয়ের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বর মধ্যে গোপন আলোচনা চলছে এবং বিখ্যাত 'অসলো চুক্তি'ও ততদিনে চূড়ান্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
১৯৯৩ সালের সেই অসলো চুক্তিই তিউনিশিয়াতে নির্বাসিত জীবন থেকে আরাফতের নেতৃত্বাধীন পিএলও-র গাজা ও পশ্চিম তীরে ফেরার পথ প্রশস্ত করে।
তবে চুক্তিতে ইসরাইল আরও যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার অনেকগুলোই পরে রক্ষিত হয়নি।
মণিশঙ্কর আইয়ার মনে করেন, ইয়াসের আরাফাত হয়তো তখন ভেবেছিলেন ভারত যদি ইসরাইলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে সম্ভবত ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের প্রতিশ্রুত 'টু স্টেট সলিউশন' (দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান) অর্জনে ফিলিস্তিনের সুবিধা হবে।
কিন্তু বাস্তবে সেটা তো হয়ইনি – বরং ইসরাইলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ভারতের কাছ থেকে ফিলিস্তিনিদের দূরত্বই শুধু বাড়িয়েছে।
ভারতের 'নৈতিকতার কম্পাসই দিকভ্রষ্ট'
দিল্লির জেএনইউ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমেরিটাস অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ জোয়া হাসানের পর্যবেক্ষণ, ১৯৯২-র পর থেকেই ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের সমর্থনে ভাঁটা পড়তে শুরু করে, তবে তা মারাত্মক মোড় নেয় ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর।
"জাতীয় স্বার্থ, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক বাস্তববাদের দোহাই দিয়ে ভারতে একটার পর একটা সরকার ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে।"
"বিশেষ করে ১৯৯৯-র কার্গিল যুদ্ধর পর থেকেই ভারত যখন তাদের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বাড়াতে ইসরাইল থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি শুরু করে, এই ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায়। এখন ক্রমে ক্রমে ভারত ইসরাইলের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ক্রেতায় পরিণত হয়েছে", জানাচ্ছেন জোয়া হাসান।
আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে ভারত ও ফিলিস্তিনের বহু বছরের আস্থার সম্পর্ক।
জোয়া হাসানের কথায়, "মোদীর বিজেপি সরকারের আমলে ভারত-ইসরাইলের এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ একটা ভিন্ন মাত্রা নিতে থাকে। ইসরাইলি ব্র্যান্ডের 'হার্ডলাইন জাতীয়তাবাদ' ও 'সিকিওরিটি-ফার্স্ট ডকট্রিন'কে ভারতও ক্রমশ আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে শুরু করে।"
"বিগত বহু দশক ধরে ভারত যে নৈতিকতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে অবস্থান নেওয়ায় বিশ্বাসী ছিল, সেখান থেকেই তারা ধীরে ধরে সরে আসে।"
এই পরিবর্তনটাকেই তিনি 'নৈতিকতার স্পষ্টতা' থেকে 'সুচিন্তিত অস্পষ্টতা' (ক্যালকুলেটেড অ্যামবিগুইটি) বলে বর্ণনা করছেন, বলছেন এর মাধ্যমে ভারতের নৈতিকতার কম্পাসের কাঁটাটাই আসলে সরে গেছে।
জোয়া হাসানের মতে, আর এরই পরিণতিতে বিশেষত গত দু'বছর ধরে গাজার ওপরে যখন প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয় নেমে এসেছে – ৫৫ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়েছেন, শরণার্থী শিবির বা হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে কিংবা খাদ্য-পানীয় জল বা ওষুধের সরবরাহ পর্যন্ত ছিন্ন করা হয়েছে – ভারত ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি।
আরও লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ভারত যাতে তাদের ফিলিস্তিন-পন্থী পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরে আসে, তার জন্যও কিন্তু দেশের জনমতে বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যে তেমন কোনও জোরালো দাবি নেই।
জোয়া হাসানের কথায়, "ভারতের রাজনীতি যেমন দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকেছে, তেমনি ইসরাইলকে নিয়ে ভারতের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীও যথারীতি বিবর্তিত হয়েছে।"
প্রসঙ্গত, ঠিক দু'বছর আগেই আহমেদাবাদে বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সময় ভারতীয় দর্শকরা মাঠে ইসরাইলের সমর্থনে স্লোগান দিয়েছিলেন, পোস্টার ও ব্যানার নিয়ে এসেছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে সঙ্গে সঙ্গে সে ছবি পোস্ট করে উল্লাস জানিয়েছিলেন দিল্লিতে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত।
সাম্প্রতিক এক পিউ রিসার্চ জরিপেও দেখা গেছে, অন্তত ৩৪% ভারতীয় গাজাতে ইসরাইলের হামলাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাচ্ছেন – যেখানে ইসরাইলের ভূমিকায় আপত্তি আছে ২৯% ভারতীয়ের।
ওই সার্ভে আরও দেখিয়েছে, ভারতে ইসরাইলের সমর্থকের সংখ্যা আসলে বহু পশ্চিমা দেশের চেয়েও অনেক অনেক বেশি।
'ভারতীয়রা আর ফিলিস্তিনিদের ভালোবাসেন না'
ভারতের বুকার পুরস্কার জয়ী লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে দাবি করেছেন, বছরকয়েক আগেও ফিলিস্তিনি জনতার সংগ্রামে ভারতের সাধারণ মানুষের যে সমর্থন আর ভালবাসা ছিল তা এখন পুরোপুরি অন্তর্হিত।
জিটিও-র মেহদি হাসানের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি তার কিছুদিন আগের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন।
অরুন্ধতী রায় জানান, "আমি বেইরুটে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, ফিলিস্তিন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান পাল্টে গেছে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল।"
"ওরা অনেকেই তখন বললেন, তোমাদের দেশে সরকার বদলেছে, তাদের অবস্থান হয়তো বদলেছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই এখনও আমাদের ভালোবাসেন।"
"তখন তাদের ভুলটা ভাঙাতেই হলো, বলতেই হলো কুড়ি বছর আগে হয়তো বাসতেন – কিন্তু এখন আর বাসেন না!"
অরুন্ধতী রায় আসলে বিশ্বাস করেন, আগে ফিলিস্তিনের বন্ধু রাষ্ট্র হলেও ভারত এখন আর তাদের বন্ধু নয় – নিপীড়িত মানুষের সঙ্গী হিসেবে ভারতের যে মর্যাদার জায়গাটা ছিল, সেটাও তারা খুইয়েছে।
মেহদি হাসানকে তিনি উদাহরণ দিয়ে আরও বলেন, গাজায় ইসরাইলের এমন বিধ্বংসী হামলার পর ভারতে তার কোনও প্রতিবাদ হয়নি বললেই চলে।
"আর যদি ধরি মাত্র জনাকুড়ি লোকও ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে একজোট হয়, তাহলে পুলিশ বা প্রশাসনকে এসে ওটা ভাঙতে হবে না – তার আগে রাস্তার সাধারণ মানুষই এসে ওটা ছত্রভঙ্গ করে দেবে।"
"এই ধরুন দোকানদাররাই এসে ওগুলো ভেঙে দেবে, দেশে যে রাইট উইং ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে তারাই এসব প্রতিবাদ করতে দেবে না", বলেন তিনি।
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও ইসরাইলের ইহুদীবাদী জাওনিজমের মধ্যে যে আদর্শগত সাদৃশ্য, সেই মিলটাই এই দুই শক্তিকে ক্রমশ কাছাকাছি এনেছে – এ কথা বলতেও অরুন্ধতী রায়ের কোনো দ্বিধা নেই।
প্রায় আশি শতাংশ হিন্দুর দেশ ভারতের প্রায় একশো শতাংশ মুসলিম-অধ্যুষিত ফিলিস্তিনকে সমর্থন করতে স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চাশ বছর অন্তত কোনও সমস্যা হয়নি।
রাষ্ট্রীয় নীতিতেও তখন আপাতদৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা, নৈতিকতা বা মানবিকতারই প্রাধান্য ছিল।
কিন্তু অরুন্ধতী রায়ের মতো ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই এখন মানেন, ধর্মের সেই ব্যবধান আজ ফিলিস্তিনি ও ভারতীয়দের মধ্যে দূরত্ব তৈরিতে বিরাট একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে, ভারতের আমজনতার একটা খুব বড় অংশ ফিলিস্তিনকেও ইসরাইলের চোখ দিয়েই দেখতে শুরু করেছে!
সূত্র: বিবিসি বাংলা