Image description

ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ অক্টোবর। মিশরে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলনের ঠিক আগের দিন। লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বির হাসান এলাকায় সেদিন সমবেত হলো সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর ইমাম মাহদি স্কাউটসের ৭০ হাজারের বেশি সদস্য।

সেদিন ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমাম মাহদি স্কাউটসের ৪০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে—'সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহর উত্তরাধিকার' শিরোনামের এই সমাবেশে হিজবুল্লাহ মহাসচিব শেখ নাঈম কাশেম বক্তব্য রাখেন। তিনি মাহদি স্কাউটসের সদস্যদের বলেন, 'তোমরা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সততা ও ন্যায়বিচারের পথিকৃৎ। তোমরা সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহর উত্তরাধিকার। তোমরা ইমাম খামেনির নেতৃত্বে বিলায়েত-আল-ফাকিহর পথে চলবে।'

তার বক্তব্যে দুই ব্যক্তির কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে। একজন সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহ ও অপরজন ইমাম খামেনি। প্রথমজন ছিলেন হিজবুল্লাহর সাবেক মহাসচিব বা প্রধান এবং অপরজন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। গাজা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে। এরপর, গত জুনে ইসরায়েল তেহরানে অপ্রত্যাশিত হামলা চালিয়ে ইরানের প্রধান নেতা আলি খামেনিকে 'আত্মগোপনে' পাঠায়।

কিন্তু, বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবার হিজবুল্লাহকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।

বৈরুতে সেদিনের সেই বক্তব্যে হিজবুল্লাহ প্রধান শেখ নাঈম কাশেম প্রয়াত নেতা সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহকে তাদের জাতির সব 'শহিদদের নেতা' বলে আখ্যা দেন। তিনি সমবেতদের স্মরণ করিয়ে দেন, 'তোমরা প্রতিরোধের পথে আছো। প্রতিরোধ সংগ্রাম একদিকে নিজের স্বার্থপরতা অন্যদিকে শত্রুর বিরুদ্ধে।'

তার মতে, এই প্রতিরোধ সংগ্রাম দেশের জন্য, পরিবার ও প্রিয়জনের জন্য।

সেই বিশাল অনুষ্ঠানে ইমাম মাহদি স্কাউটসের প্রধান কমান্ডার নাজিহ ফায়াদ বলেন, 'আমরা রেকর্ড গড়ার জন্য এত বড় সমাবেশ করিনি। আমরা আমাদের শত্রুদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার জন্য সমবেত হয়েছি। তাদেরকে এটাই দেখাতে চাই যে সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহর উত্তরসূরিরা তার পথ অনুসরণ করে চলছে।'

অনুষ্ঠানে তরুণরা দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পাশাপাশি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হিজবুল্লাহ নেতাদের পথ অনুসরণের প্রতিজ্ঞা করেন।

সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরানের জাতীয় সংগীত 'সালাম ফারমারদেহ'র আরবি সংস্করণ 'সালাম ইয়া মাহদি' পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

এই সংবাদ প্রকাশের দুইদিন আগে একই সংবাদমাধ্যমে ইমাম মাহদি স্কাউটস সম্পর্কে এক বিশ্লেষণে বলা হয়, এটি পুনর্গঠন ও প্রতিরোধের মডেল। এর রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, প্রয়াত হিজবুল্লাহ প্রধান সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ও হাশেম সাফি আল-দিনের মৃত্যুবার্ষিকীর পটভূমিতে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হলো। এটি আয়োজনে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ ও কী পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে তাও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফিরে দেখা হিজবুল্লাহ

নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক-সম্পর্ক ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) দৃষ্টিতে হিজবুল্লাহ হচ্ছে লেবাননের এমন একটি শিয়া সশস্ত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন যা দেশটির ভেতরে 'আরেকটি দেশ' সৃষ্টি করেছে।

ইরান-সমর্থিত সংগঠনটি ইসরায়েলের চরম বিরোধী। এটি মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমের দেশগুলোর প্রভাবকে প্রতিরোধে কাজ করে।

হিজবুল্লাহকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে।

ইমাম মাহদি স্কাউটসের সদস্য। ছবি: তেহরান টাইমসের সৌজন্যে
ইমাম মাহদি স্কাউটসের সদস্য। ছবি: তেহরান টাইমসের সৌজন্যে

সিএফআরের 'হিজবুল্লাহ কী' শিরোনামের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি সংগঠনটির রাজনৈতিক কাঠামোয় আছেন শীর্ষ আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে। এর সামরিক কাঠামোয় শীর্ষ পরামর্শক হিসেবে আছেন ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কুদস ফোর্সের কমান্ডার।

১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে হিজবুল্লাহর জন্ম। এরপর, সংগঠনটি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের মাধ্যমে ইসরায়েলকে লেবানন ছাড়তে বাধ্য করে। লেবাননসহ সারাবিশ্বে আলোচিত হয় হিজবুল্লাহর বীরত্বগাঁথা। এর প্রায় ১০ বছর পর ১৯৯২ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হলে হিজবুল্লাহ পার্লামেন্টারি রাজনীতি শুরু করে।

১৯৯৩ সালে ইসরায়েল আবার লেবাননে হামলা চালালে হিজবুল্লাহ প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইসরায়েলের সেই আগ্রাসন সাত দিন ধরে চলেছিল। এর তিন বছর পর ইসরায়েল আবার লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থানে হামলা চালালেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।

বৈরুতের এক জনসভায় বক্তব্য রাখছেন হাসান নাসরাল্লাহ। ফাইল ছবি: রয়টার্স
বৈরুতের এক জনসভায় বক্তব্য রাখছেন হাসান নাসরাল্লাহ। ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০০৬ সালে ইসরায়েলের ভেতরে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহ বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোচনায় আসে। সেই ৩৪ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১২ শ লেবাননি নিহত হন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে, হিজবুল্লাহর হামলায় ১৫৮ ইসরায়েলি নিহত হন। তাদের বেশিরভাগই সামরিক বাহিনীর সদস্য।

এই হামলার পর হিজবুল্লাহ ইসরায়েল সরকারের মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দেয় যা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত জিইয়ে ছিল। সম্প্রতি, এক প্রভাবশালী ইসরায়েলি মন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার সংবাদ পাওয়ার পরও তারা উত্তর ইসরায়েলে হিজবুল্লাহ হামলার ভয়ে ছিলেন। যখন গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে ঢুকবে না তখন ইসরায়েলি সেনারা হামাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

যা হোক, ২০০৯ সালে হিজবুল্লাহ দলীয় ইশতিহারে পরিবর্তন আনে। সংগঠনটি লেবাননের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক সংঘাতকে কম গুরুত্ব দিতে শুরু করে।

প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ বছর হিজবুল্লাহর সামরিক কার্যক্রম লেবাননের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে, আরব বসন্তের ডামাডোলে ২০১১ সালে সিরিয়ায় স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হলে ইরান-সমর্থিত এই শিয়া রাজনীতিককে রক্ষায় এগিয়ে আসে সংগঠনটি। সেসময় হিজবুল্লাহ সিরিয়ার গণতন্ত্রপন্থি ও বাশারবিরোধীদের ওপর হামলা চালায়। অনেক বিশ্লেষকের মতে, মোটা দাগে তখন থেকেই লেবাননে হিজবুল্লাহর জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। এটি 'ভাড়াটে' সংগঠন হিসেবে কুখ্যাতি পায়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে হামাস গাজা থেকে দক্ষিণ ইসরায়েলে রক্তক্ষয়ী হামলা চালালে তেল আবিব পাল্টা হামলা শুরু করে। গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবি জানিয়ে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তজুড়ে হামলা চালাতে থাকে। সেখানে হিজবুল্লাহর হামলা এত প্রবল ছিল যে লেবানন সীমান্তবর্তী লাখো ইসরায়েলি বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হন।

হিজবুল্লাহর পতাকা। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
হিজবুল্লাহর পতাকা। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

এরপর, ইসরায়েলের ক্রমাগত পাল্টা হামলায় শক্তি হারাতে শুরু করে হিজবুল্লাহ। গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর হিজবুল্লাহ নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা পেজার যন্ত্রে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সংগঠনটির ব্যাপক ক্ষতি করে ইসরায়েল। এমন অভাবনীয় হামলায় হিজবুল্লাহ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে এর দিন দশেক পর ইসরায়েল হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। আর ক্রমাগত দলীয় প্রধানকে হারিয়ে সংগঠনটি লেবানন তথা মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

কিন্তু, বছর না ঘুরতেই হিজবুল্লাহকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা গেল বৈরুতের মাটিতেই। গত জুনে হিজবুল্লাহর এমপি ইব্রাহিম মুসাভি লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে বলেছিলেন, 'সবাই জানেন আমরা কঠিন সময় পার করছি। আমরা তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলেছিলাম। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ার অনেকটাই শেষ হয়েছে।'

তিনি জানান, গত এক বছরে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য হিজবুল্লাহ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছে।

হিজবুল্লাহর নির্বাহী কাউন্সিলের প্রধান হাশেম সাফিএদ্দিন। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
হিজবুল্লাহর নির্বাহী কাউন্সিলের প্রধান হাশেম সাফিএদ্দিন। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, এক বছর লড়াই করার পর হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়লেও অর্থনৈতিকভাবে সংগঠনটি বেশ শক্তিশালী। এমন সংবাদে ইব্রাহিম মুসাভির কথার প্রতিফলন পাওয়া যায়।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবভিত্তিক সংবাদমাধ্যম অ্যারাব নিউজ জানায়, দীর্ঘদিনের নেতাকে হারানোর এক বছর পর হিজবুল্লাহ আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

ফিরে আসা যাক ইমাম মাহদি স্কাউটসের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে। সেই অনুষ্ঠানে ৭০ হাজারের বেশি সদস্যের অংশগ্রহণ দেখে মনে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ যেন রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত হয়ে ফিরে আসছে জনসম্মুখে।

ইমাম মাহদি স্কাউটস কারা

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে ইমাম মাহদি স্কাউটস অনেকটাই অজানা। মোটা দাগে, এটি লেবাননে হিজবুল্লাহ পরিচালিত একটি যুব আন্দোলন। মুসলমানদের শেষ ইমাম মাহদির (আ) নামে এই সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছে ১৯৮৫ সালের ৫ মে। এর আরবি নাম কাশফ আল ইমাম আল মাহদি। পরিচিত ইমাম মাহদি স্কাউটস নামে।

সংগঠনটির সদস্যদের শিয়া ধর্মীয় ভাবধারায় গড়ে তোলা হয়। সাধারণত ৮ বছর বয়স থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা এই সংগঠনের সদস্য হয়ে থাকেন। সংগঠনটির সদস্যদের সপ্তাহান্তে লেখাপড়া, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিধান ও সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে হয়।

তুরস্কের সাফির টেলিভিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লেবাননজুড়ে এই সংগঠনটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর সদস্য সংখ্যা ৮০ হাজারের মতো। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইমাম মাহদি স্কাউটসের মাধ্যমে হিজবুল্লাহর সামরিক শাখার সদস্য সংগ্রহ করা হয় ।