
বিতর্ক যেন ভারতের পিছুই ছাড়ছে না। বিশ্ব রাজনীতিতে 'নিষিদ্ধ' তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তাতে নতুন করে 'জ্বালানি' পড়লো দিল্লিতে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনায়। ঘটনাটি ঘটলো দিল্লিতে কিন্তু, দায় নিলো না ভারত সরকার। এমন দায়-এড়ানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের অক্ষমতাকেই কি প্রমাণ করলো দিল্লির সাউথ ব্লক?
ডুবন্ত মানুষ নাকি খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে। 'ডুবন্ত' মোদি সরকারের যেন সেই দশা। কাছে-দূরের বন্ধুদের হারিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত যেন 'ডুবতে' বসেছে। প্রতিবেশীদের কাছে 'প্রত্যাখ্যাত' ও বন্ধুদের কাছে 'প্রতারিত' ভারতকে এখন আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে বিশ্বের অজনপ্রিয় সরকারগুলোর হাত।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। দেশটির নেতারা কথায় কথায় সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার প্রাচীনভূমি হওয়ার সুখ্যাতি আছে এই ভূখণ্ডের। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেন দেশটির সব খ্যাতিই দিল্লির যমুনায় বিসর্জন দিয়ে চলেছেন। এবার দেখা গেল এর নতুন নমুনা।
বিজেপি সরকার নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিকে 'চৌকস' বলে দাবি করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক এখন তলানিতে। এখন নয়াদিল্লিকে হাত বাড়াতে হচ্ছে কাবুলের তালেবান সরকারের দিকে। যে সরকারের বিরুদ্ধে আছে নারী-অধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ; এমনকি, যে সরকারকে কোনো দেশই স্বীকৃতি দেয়নি সেই সরকারই হলো গণতান্ত্রিক ভারতের আপনজন। সব আন্তর্জাতিক ভব্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোয় নয়াদিল্লির এমন আচরণ বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে।
এখন জানা যাক, কী কী কথা হলো সফররত তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের।
যে কথা হলো তালেবানের সঙ্গে
গত ১০ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে 'ভারত-আফগানিস্তান যৌথ বিবৃতি' প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিকের আনুষ্ঠানিক আলোচনাই তুলে ধরা হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়—ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগান জনগণের সঙ্গে ভারতীয়দের বহু পুরোনো বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরেছেন। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গভীর সম্পর্কের কথাও তুলে ধরা হয়। আফগান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ ও সামগ্রিক উন্নয়নের প্রসঙ্গও টানেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত ২৫ এপ্রিল কাশ্মীরের পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় তালেবান নিন্দা করায় তিনি এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সব পক্ষই সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। শান্তি, স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে।
উভয় পক্ষই একে অন্যের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে। আফগান সরকার কোনো সংগঠন বা ব্যক্তিকে ভারতবিরোধী কাজে তাদের দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না।
ভারত সরকার আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে প্রাণহানিতে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুর্যোগের সময় ভারত সরকারের ভূমিকা ও ত্রাণ পাঠানোয় নয়াদিল্লির প্রশংসা করেছে।

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও উন্নয়নে ভারত সরকার সহযোগিতা প্রকল্প বাড়াবে। এগুলোর মধ্যে থাকবে স্বাস্থ্যসেবা, সরকারি অবকাঠামো ও সক্ষমতা বাড়ানো সংক্রান্ত প্রকল্প। আফগানিস্তানে থ্যালাসেমিয়া কেন্দ্র ও আধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরির চলমান প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভারত সরকার কাবুলের ইন্দিরা গান্ধী ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের অবকাঠামোগত সংস্কার ও কাবুলে ৩০ শয্যার হাসপাতাল তৈরি করবে।
ভারত উপহার হিসেবে আফগানদের ২০টি অ্যাম্বুল্যান্স দেবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে সেগুলোর প্রতীকী হস্তান্তর হয়।
ভারত সরকার আফগান শিক্ষার্থীদের ই-আইসিসিআর বৃত্তি দেওয়া চালিয়ে যাবে। অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে আফগান শিক্ষার্থীদের ভারতে পড়ালেখার সুযোগ দেওয়া হবে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পুনর্নির্মাণে ভারত সরকার সহায়তা দেবে।
দুই পক্ষই আফগানিস্তানে ভারতের মানবিক সহায়তা কর্মসূচির অগ্রগতি দেখেছে। ভারত এমন সহযোগিতা চালিয়ে যাবে।
সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানকে এগিয়ে নিতে ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলাধুলার উন্নয়ন নিয়ে দুই পক্ষই আলোচনা করেছে।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে উভয় পক্ষই ইন্ডিয়া-আফগানিস্তান এয়ার ফ্রেইট করিডর শুরু করার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে।
আফগানিস্তান সে দেশে খনিজসম্পদ খাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে চায়।
আফগানিস্তানের হেরাতে ইন্ডিয়া-আফগানিস্তান ফ্রেন্ডশিপ ড্যাম (সালমা ড্যাম) তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে ভারত সরকারের সহায়তার প্রশংসা করা হয়েছে। ড্যামের পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আফগানিস্তানের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কৃষি খাতে উন্নয়ন করা হবে।
এ ছাড়াও, দুই পক্ষই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলবে বলেও ভারত-আফগানিস্তান যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
'শত্রুর শত্রু মিত্র হয়'
এ কথা সবাই জানেন যে, একসময় আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল 'সাপে নেউলে'। উল্টো, তালেবানের সঙ্গে ভারতের 'প্রধান শত্রু' পাকিস্তানের সম্পর্ক মধুর ছিল। ইতিহাস বলে, পাকিস্তানের মাটিতেই তালেবানের জন্ম। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিকাশও ঘটেছে পাকিস্তানের মাটি থেকে। ইসলামাবাদের সার্বিক সহযোগিতায় তালেবান আফগানিস্তানের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরে, সেসব ইতিহাস চাপা পড়ে যায় ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায়। এক সময়ের বন্ধু হয়ে যায় অস্বস্তির কারণ। মোটা দাগে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ঘিরে ধীরে ধীরে দূরত্ব বেড়ে যায় কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে। ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে তালেবানরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুর চড়ায়। এমনকি, এ কথাও বলে বসে যে ইসলামাবাদের সঙ্গে শত সখ্যতা সত্ত্বেও তালেবানরা পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্তকে 'বিতর্কিত' বলেই মনে করে।
সেই সুযোগকেই যেন কাজে লাগিয়েছে নয়াদিল্লি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন—কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়লে বহুদূরে থাকা দিল্লির সঙ্গে আকস্মিকভাবেই কাবুলের দূরত্ব কমে যায়।
কিন্তু, শত্রুর শত্রুকে নিজের বন্ধু বলে কাছে ডেকে নিলে তা নিজের জন্য সবসময় সুখকর নাও হতে পারে। অনেকের মতে, মূলত পাকিস্তানকে চাপে রাখার জন্য ভারত যদি তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করে তাহলে তা ভারতের জন্য 'হিতে বিপরীত' হতে পারে। এটি হয়ত শুরুও হয়ে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনায় সুর চড়িয়েছে ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সব পুরুষ সাংবাদিকের অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসা উচিত ছিল বলে মনে করেন কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম।
ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাকর্মীদের অনেককে নিজ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের 'তালেবান' বলে গালি দিতে শোনা যায়। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে তালেবান কর্মকর্তাকে নিয়ে যখন বৈঠক করা হয় তখন তা নয়াদিল্লির দৈন্যদশাকেই কি তুলে ধরে না?