
ভারত সফররত আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারতে ইসলামি চর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ পরিদর্শন করবেন। দিল্লি থেকে প্রায় দুইশো কিলোমিটার দূরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে শনিবার (১১ অক্টোবর) বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানোর কথা রয়েছে তার।
তালেবান সরকারকে রাশিয়ার মতো বিশ্বের হাতে গোনা দু-একটি দেশ ছাড়া কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। তাই ভারতে সেই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আটদিনের দীর্ঘ সফরকে ঘিরে আন্তর্জাতিক স্তরে রীতিমতো আলোড়ন পড়ে গেছে। তা ছাড়া মুত্তাকি জাতিসংঘের চোখে একজন অভিযুক্ত এবং তার আন্তর্জাতিক ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে জাতিসংঘের বিশেষ অনুমতি নিয়েই এই সফর আয়োজন করা হয়েছে বলে ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।
১৮৬৬ সালে সাহারানপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ ভারতে সুন্নি ইসলামি ভাবধারার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। আজও দেশে-বিদেশের হাজার হাজার মুসলিম ছাত্র এখানে পড়াশোনা করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে যাচ্ছেন কেন?
দিল্লিতে শুক্রবার যখন আমির খান মুত্তাকিকে সাংবাদিকরা ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিলেন, তিনি জবাব দেন ‘দেওবন্দে মানুষ কেন যায়? প্রার্থনা করতে যায় ... ওখানকার শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আমিও তাই যাব।’
তারপরেই তিনি যোগ করেন, ‘দারুল উলুম দেওবন্দ হলো ইসলামি চর্চার এক প্রাচীন ও সুবৃহৎ কেন্দ্র। দেওবন্দের আকবরিন উলামার সঙ্গে আফগানিস্তানের সম্পর্ক খুব গভীর! এটা একটা রুহানি মরকজ-ও (আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র), এর সঙ্গে আফগানিস্তানের সুগভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ককে পুনরুদ্ধার করতেই আমি সেখানে যাচ্ছি!’
দেওবন্দের উলেমাদের যে তালেবানের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ধর্মীয় গুরু বলে মানেন, বিভিন্ন আফগান সংবাদপত্রে সে কথাও জানানো হয়েছে।
এটা ঠিক যে উনিশ শতকের শেষের দিক থেকেই বহু আফগান ছাত্র দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশোনা করতে আসতেন। বর্তমানে ভিসা সমস্যার কারণে আফগান ছাত্রদের আসা-যাওয়া অনেক কমে গেছে। মুত্তাকি চাইছেন সেই রীতি আবার চালু হোক।
ভারতের নামী থিংকট্যাংক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) গবেষক সৌম্যা অবস্থী জানিয়েছেন, ‘দেওবন্দে প্রথম যে বিদেশি ছাত্ররা আসা শুরু করেছিলেন তারা ছিলেন আফগানিস্তানের। এই আফগান ছাত্ররা দেশে ফিরে গিয়ে কাবুল, কান্দাহার বা খোস্ত প্রদেশে ঠিক দেওবন্দের ধাঁচে একই ধরনের মাদ্রাসা খোলেন। সেখানেও অবিকল সেই পাঠক্রম ও শিক্ষারীতি চালু করেন। এভাবেই আফগানিস্তানে দেওবন্দী ভাবধারার শিকড় ছড়িয়ে পড়ে!’
তবে ১৯৭৯ সালের আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির পর দেওবন্দে আফগান ছাত্রদের আসায় ভাঁটা পড়ে। লাখ লাখ আফগান তখন শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশী পাকিস্তানের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আর তখন থেকেই তাদের কাছে ভারতের দেওবন্দের বিকল্প হয়ে দেখা দেয় পাকিস্তানের দেওবন্দী মাদ্রাসাগুলো, বিশেষ করে আকোরা খাট্টাকে অবস্থিত দারুল উলুম হাক্কানিয়া।
দিল্লিতে কূটনৈতিক বিশ্লেষক মনোজ গুপ্তা জানিয়েছেন, ‘বিগত বহু বছর ধরে পাকিস্তানই নিজেদের দেওবন্দী ইসলামের মূল অভিভাবক হিসেবে তুলে ধরেছে – কারণ তারাই ছিল তালেবানের প্রধান সমর্থক। মুত্তাকির দেওবন্দ সফর সেই ন্যারেটিভটাকেই চ্যালেঞ্জ জানাবে। কারণ তালেবানের বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য যে ভারত থেকে আহরিত, পাকিস্তান থেকে নয়, সেটাই এতে প্রমাণিত হবে।’
আমির খান মুত্তাকি শুক্রবার দিল্লিতে যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, তাতেও তিনি ইঙ্গিত দেন আফগানিস্তান থেকে দেওবন্দে পড়তে আসতে ইচ্ছুক ছাত্রদের ভারত সরকার যাতে বেশি সংখ্যায় স্টুডেন্ট ভিসা দেয়, দিল্লিকে তিনি সেই মর্মে অনুরোধ জানাবেন।
ভারতের স্বাধীনতা লাভের এক দশক পরেই আফগানিস্তানের তখনকার রাজা জাহির শাহ প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে ভারত সফরে এসেছিলেন। ১৮৫৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেই সফরে তিনিও দেওবন্দে এসেছিলেন।
আমির খান মুত্তাকির সফর দেওবন্দের প্রাচীন মানুষদের অনেককেই রাজা জাহির শাহ্-র সেই সফরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তারাও আশা করছেন, কাবুল-কান্দাহার বা হীরাট-জালালাবাদ থেকে আবারও শত শত আফগান ছাত্র দেওবন্দে পাঠ নিতে আসবেন।