
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে এক ঐতিহাসিক নিরাপত্তা চুক্তি সই করা হয়েছে বুধবার। এ চুক্তি অনুযায়ী যদি দুটি দেশের মধ্যে একটি হামলার শিকার হয় তবে তা উভয় দেশের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে। দুই দেশ একত্রে সেই হামলা প্রতিহত করবে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের দোহায় ইসরাইলি হামলার পরপরই দুই দেশের মধ্যে এ চুক্তি সই করা হয়েছে। ইসরাইলের ওই হামলায় পুরো আরব বিশ্বে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছে।
চুক্তির জেরে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান এখন সৌদি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত সমীকরণসমূহ নতুনভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে দেশটির যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ চুক্তি সই করেন। চুক্তি সইয়ের এ অনুষ্ঠানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির উপস্থিত ছিলেন, যার মাধ্যমে চুক্তির বিষয়ে দেশটির সামরিক বাহিনীর সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে।
এ চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে দেওয়া আমেরিকার নিরাপত্তা কাঠামোর সমাপ্তির শুরু হতে পারে। রাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা দানকারী দেশ হিসেবে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা এর মাধ্যমে ক্ষয়ের দিকে যাবে। এছাড়া আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের জন্য পরমাণু শক্তিধর এক প্রতিদ্বন্দ্বীর মাধ্যমে প্রবেশ ঘটেছে। অপরদিকে ভারতের বিপরীতে পাকিস্তান আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, যা পরবর্তীকালে যেকোনো সংঘাতে নয়াদিল্লির বিপরীতে ইসলামাবাদকে এগিয়ে রাখবে। এসব কিছু ছাড়াও চীনের জন্য এটি কৌশলগত একটি সুযোগ হতে পারে, যার মাধ্যমে বেইজিং ওয়াশিংটনকে পাশে ঠেলে এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে হটাবে চীন।
যদিও সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্য করে এ চুক্তি করা হয়নি, তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হঠাৎ করেই এ চুক্তি করা হয়নি। আমেরিকার বিশাল সামরিক ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও যখন কাতার ইসরাইলের হামলার শিকার হয়েছে, তখন ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা কাঠামোকে রাজতান্ত্রিক দেশগুলো সন্দেহের চোখে দেখছে। ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে আমেরিকার নীরব থাকাকে সহযোগিতা হিসেবে দেখছে দেশগুলো।
এর আগে থেকেই অবশ্য সৌদি আরব আমেরিকার নিরাপত্তা কাঠামোর বিকল্পের সন্ধানে ছিল। কাতার হামলার পরপরই তাই ইসলামাবাদের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে দেশটি।
সৌদি আরব ও পাকিস্তানের এ চুক্তির মাধ্যমে নতুন করে আমেরিকার নেতৃত্বের ন্যাটোর মতোই মুসলিম দেশগুলোর সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে একটি মুসলিম প্রতিরক্ষা জোট সৃষ্টির ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষক সৌদি আরব একমাত্র পরমাণু শক্তিধর মুসলিম দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। ইসরাইলি হামলার শিকার হওয়া কাতারও হয়তো এ চুক্তিতে আসতে পারে। ন্যাটোর সদস্য মুসলিম দেশ তুরস্ক অবশ্য বহু আগে থেকেই এ ধরনের জোট গঠনের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তবে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরান, কাতারের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়ার সঙ্গে মরক্কো ইত্যাদি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার বিরোধের জেরে এ জোট গঠন সম্ভব হয়নি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা চালিয়ে আসছিল সৌদি আরব। কিন্তু গাজাসহ বিভিন্ন আরব দেশে ইসরাইলের আগ্রাসনের জেরে এতে ভাটা পড়েছে। ইসরাইলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখা এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে দীর্ঘদিনের সমর্থন দানকারী পাকিস্তানের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে সৌদি প্রশাসন বার্তা দিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে আব্রাহাম অ্যাকোর্ডের বাইরে গিয়ে পদক্ষেপ নেবে তারা। এখন মধ্যপ্রাচ্যে কোনো দেশে হামলা করলে ইসরাইলকে পরমাণু শক্তিরও মোকাবিলা করতে হতে পারে।
এদিকে চুক্তির জেরে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতও কৌশলগত চাপের মুখে পড়েছে। যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপের ভয় দিল্লি করছে না, তবে রিয়াদের সমর্থন নিয়ে ইসলামাবাদ আরো শক্তিশালী হওয়ার শঙ্কা করছে তারা।