Image description

মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার উত্তেজনা গত কয়েক মাস ধরেই চরমে। গাজায় চলমান যুদ্ধ, ইরান-ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব এবং কাতারের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনা অঞ্চলটির ভূরাজনীতি নতুন করে গড়ে তুলছে। এই অস্থিরতার মধ্যে, দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান ও ভারত নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করলো মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশের সঙ্গে। কূটনৈতিক সুরে বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে এসব দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় যাবে। 

প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে হওয়া এসব চুক্তি অর্থনৈতিক ও সামরিক খাত সংশ্লিষ্ট। অর্থ ও রাজনৈতিক বন্ধন শক্ত করতে ৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের সঙ্গে বিনিয়োগ চুক্তি করে ভারত। আর নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে গত বুধবার প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাকিস্তান-সৌদি আরব। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা এই চুক্তির নিরাপত্তার দিকগুলো খতিয়ে দেখছে। 

সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশের সঙ্গে ভারত পাকিস্তানের করা চুক্তি শুধুই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়। বরং এগুলো বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করতে পারে।

ভারত-ইসরায়েলের চুক্তি
টাইমস অব ইসরায়েল ও মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নয়াদিল্লি ও তেল আবিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির নাম ‘বাইল্যাটেরাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট’। চুক্তির মূল উদ্দেশ্য দুই দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো এবং ব্যবসায়িক লেনদেনকে সহজ করা।

ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছেন, এটি দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন দুয়ার খুলবে। ইসরায়েলের রপ্তানি বাড়াবে এবং বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল বাজারে উন্নয়নের সুযোগ দেবে। আর ভারতীয় সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়িয়ে একটি শক্তিশালী বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করবে। সহজ কথায়, এটি দুই দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধনে আবদ্ধ করবে। 

মিডল ইস্ট আইয়ের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আসাদ এশা বলছেন, বৃহত্তর দৃষ্টিতে দেখলে ভারতের এই চুক্তিটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) একটি সদস্য দেশের (ইসরায়েল) সঙ্গে। ফলে এর আলাদা গুরুত্ব আছে।

ওইসিডি হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর (এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। তারা অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বিশ্ব বাণিজ্যের নীতি বা মানদণ্ড তৈরি এবং পরস্পরের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করে। আসাদ এশা বলছেন, এমন একটি সংস্থার সদস্যের সঙ্গে ভারতের চুক্তিটি ভবিষ্যতে ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ এর পথও প্রশস্ত করতে পারে। 

ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডর

এ ছাড়া, চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো হাইফা বন্দরে ভারতের আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ রক্ষা করা। এবং ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডর (আইএমইসি) সচল রাখা। আটলান্টিক কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, আইএমইসি হলো একটি বাণিজ্যিক রুট। সমুদ্র পথে যেটি ভারতের মুম্বাই থেকে শুরু হয়ে সৌদি আরবের রস আল-খাইর বন্দর পর্যন্ত। এরপর রেলপথে যুক্ত হয়েছে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের সঙ্গে। সেখান থেকে আবার সমুদ্র রুট গেছে ইউরোপের দেশগুলোতে। এর একটি হলো ফ্রান্স। যারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আসাদ এশা লিখেছেন, আইএমইসি করিডরটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত। এটিকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর পাল্টা বাণিজ্য পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ভারত-ইসরায়েলের চুক্তিটি কেবল বাণিজ্য নয়, বরং রাজনীতি, কূটনীতি এবং শক্তি ও আস্থা প্রদর্শনের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত।

এই চুক্তিতে কার কী লাভ
নয়াদিল্লিতে চুক্তি স্বাক্ষর করতে এসেছিলেন ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ। পশ্চিম তীরে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য স্মোট্রিচের ওপর যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা পাঁচটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপীয় কমিশনও ইসরায়েলের ওপর শুল্ক সুবিধা স্থগিতের প্রস্তাব দিয়েছে। যা ইসরায়েলের জন্য ইউরোপ থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা তৈরি করে। আসাদ এশা বলছেন, এ অবস্থায় আইএমইসি সচল রাখার চুক্তি করে ভারত যেন ইসরায়েলকে অর্থনৈতিক বাফার বা স্থিতিশীলতা দিলো।  

অপরদিকে ভারত ইসরায়েলের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। বিপরীতে তারা ইসরায়েলে রত্ন, গয়না, রাসায়নিক ও প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি করে। ইসরায়েল ভারতকে সার ও যন্ত্রপাতি দেয়। ভারতীয় কোম্পানিগুলোও ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে জল প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। নতুন বিনিয়োগ ও আস্থা বাড়ানোর চুক্তি এসব খাতে সহযোগিতা আরও বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

পাকিস্তান-সৌদি আরব চুক্তি
সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তিকে মাইলফলক বলছেন পর্যবেক্ষকরা। এর আওতায় যেকোনো এক দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে।

‘মিউচুয়াল ডিফেন্স প্যাক্ট’ নামের চুক্তিটি সৌদি আরবের রিয়াদে স্বাক্ষর হয়েছে গত বুধবার। আল জাজিরা বলছে, এই চুক্তি একটি সংবেদনশীল সময়ে স্বাক্ষরিত হলো। গত দুই বছরে ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে আঞ্চলিক রাজনীতির ভারসাম্য ওলটপালট হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে সৌদির প্রতিবেশী দেশ কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

’৯৮-এ সাহায্য, ’২৫-এ চুক্তি

সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান প্রথম পরমাণু পরীক্ষা চালালে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে। এরপর দেশটির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ান সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ। তিনি পাকিস্তানকে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় পরমাণু পরীক্ষা চালায় ইসলামাবাদ।

প্রতিবেশী কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর সৌদি যখন শঙ্কা অনুভব করছে, ঠিক তখনই পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলো। যেটি ইঙ্গিত দেয়, সৌদি আরব পাকিস্তানের থেকে পারমাণবিক সুবিধা পেতে যাচ্ছে।


সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতেরও সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু তাদের পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে সৌদির চুক্তির পর প্রশ্ন উঠছে রিয়াদ কি দিল্লিকে পাশ কাটাচ্ছে। সৌদি সরকার বলেছে, এই চুক্তি ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। সার্বিকভাবে, এটি আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করার একটি পদক্ষেপ।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসে। সেটি হলো- সৌদি আরবে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে। এ কারণে রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনকে তাদের প্রধান নিরাপত্তা ‘গ্যারান্টর’ হিসেবে দেখে আসছে। কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর সেই ভরসায় কি চিড় ধরেছে? 

সৌদি যে কারণে পাকিস্তানমুখী
সিএনএন তাদের এক বিশ্লেষণে লিখেছে, ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা হয়। যেটির জন্য ইরানকে দায়ী করা হয়। ওই হামলায় সৌদি আরবের অর্ধেক তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং অপরিশোধিত তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়। তখন ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিষয়ে নীরব ও সীমিত পরিসরে নিন্দা জানিয়েছিল। যা আরব উপসাগরীয় দেশগুলোকে হতাশ করে।

তবে পরের বছরই ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে হত্যা করা হয় ইরানের প্রভাবশালী নেতা কাসেম সোলাইমানিকে। কিন্তু তখনও ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি আরবের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো নিরাপত্তা চুক্তি করেনি।

সবশেষ গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। জবাবে ইরান হামলা করে কাতারে অবস্থিত (মধ্যেপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড়) মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে। চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ইসরায়েলও কাতারের দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। মধ্যেপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও কয়েক মাসের ব্যবধানে বড় দুটি হামলার ঘটনা আরব দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়িয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর রাখা আস্থায় চিড় ধরেছে। 

সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ২০২৩ সালে বলেছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা কমিয়ে নতুন অংশীদার খুঁজবেন। সম্প্রতি হামলার ঘটনাগুলোই যেন সেই চেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছে। সিএনএন বলছে, সৌদি এ কারণেই পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের দিকে ঝুঁকেছে। এটিকে বৈশ্বিক ক্ষমতা পরিবর্তনের সংকেত বলা যায়। এটি আরও ইঙ্গিত দিচ্ছে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো একক কোনো দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) ওপর আর নির্ভরশীল থাকতে চাচ্ছে না।