Image description

গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে ইসরায়েল। আর এই অস্ত্রগুলো যৌথভাবে তৈরি করেছে ইসরায়েলের ইসরায়েল ওয়েপনস ইন্ডাস্ট্রিজ ও ভারতের আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এক বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর।

ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে চালানো ভয়াবহ অভিযানে ইসরায়েলি সেনারা ব্যবহার করছে আরবেল নামের নতুন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই চালিত অস্ত্র ব্যবস্থা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, এই অস্ত্রকে বলা হচ্ছে ‘অপারেটরের প্রাণঘাতী ক্ষমতা ব্যবহারের পরও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়ায় এমন বিপ্লবী প্রযুক্তি।’

এই প্রযুক্তি এটি টাভোর, কারমেল ও নেগেভের মতো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রকে এমন এক সিস্টেমে রূপ দেয়, যেখানে অ্যালগরিদমের সাহায্যে লক্ষ্যভেদ আরও নির্ভুল ও কার্যকর হয়।

গত ১৩ মাসে গাজায় স্কুল, শরণার্থীশিবির ও হাসপাতাল বোমা হামলা থেকে শুরু করে রাস্তায় সরাসরি ফাঁসি পর্যন্ত নানা ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে নারী ও শিশুদের। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যাচ্ছে, নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা অন্তত ৬৬ হাজার।

তবে প্রায় ১০০ মার্কিন চিকিৎসকের এক চিঠিতে গত বছর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে জানানো হয়েছিল, মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে। আর ব্রিটিশ জার্নাল দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত আরেকটি চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি হতে পারে। জাতিসংঘও জানিয়েছে, গাজায় অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যুর সংখ্যা ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এআই ব্যবহারের কারণে হতে পারে।

আরবেল নামটি বাইবেল থেকে নেওয়া হলেও এটি সেই শহরের নামও, যা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি গ্রাম হিত্তিন দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই অস্ত্রের প্রথম ঘোষণা দেওয়া হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে গুজরাটের গান্ধীনগরের এক প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে। সেখানে এটিকে উপস্থাপন করা হয়েছিল ইসরায়েল ওয়েপনস ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ভারতের আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেসের যৌথ উদ্যোগ হিসেবে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তখন একে বলেছিল ভারতের প্রথম এআই-ভিত্তিক ফায়ারিং সিস্টেম। কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিলে গাজার যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল আবার অস্ত্রটি প্রদর্শন করে এবং তখন একে বলা হয় প্রথম কম্পিউটারাইজড অস্ত্র ব্যবস্থা। সেখানে আর আদানির নাম উল্লেখ করা হয়নি। ধারণা করা হয়, যন্ত্রাংশ উভয় পক্ষ মিলেই তৈরি করেছে, তবে সংযোজন হয়েছে ইসরায়েলে। আদানির নাম বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে যুদ্ধকালীন জনরোষ এড়ানো বা ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞা এলে দায় এড়ানো।

ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক গিরিশ লিঙ্গান্না বলেছেন, আরবেল আধুনিক যুদ্ধে এআই-এর ক্রমবর্ধমান ভূমিকা দেখায়, তবে এর প্রাণঘাতী ক্ষমতা ও অপব্যবহারের ঝুঁকি নৈতিক দিক থেকে ভয়াবহ। ফিলিস্তিনকে কীভাবে ইসরায়েল প্রকৃত অস্ত্র পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহার করছেন তা নিয়ে ‘দ্য প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরি’ বই লেখা সাংবাদিক অ্যান্টনি লোয়েনস্টাইন বলেন, গাজায় সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করাই ছিল উদ্দেশ্য, হামাসকে নয়। তিনি বলেন, “আমি সরাসরি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছি। এটি ভয়াবহ।’

লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) গবেষক নোয়া সিলভিয়া মনে করেন, দক্ষতার নামে এসব অস্ত্র আসলে ধ্বংসযজ্ঞ আরও বাড়ায়। তাঁর মতে, ইসরায়েলি সেনারা যেভাবে শিশুদের টার্গেট করছে, তাতে আর্বেল শিশু হত্যার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করছে।

ভারত-ইসরায়েল অস্ত্র বাণিজ্য এর আগেও আলোচনায় এসেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের তৈরি ২০টি হার্মিস–৯০০ ড্রোন ইসরায়েলে পাঠানো হয়। এগুলো আদানি ও ইসরায়েলি অস্ত্র উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমের যৌথ উদ্যোগে তৈরি। গত বছরের এপ্রিলে ভারত থেকে রকেট ইঞ্জিন, বিস্ফোরক ও কামানের প্রপেল্যান্ট ইসরায়েলে পাঠানো হয়। মে মাসে আরেকটি ভারতীয় অস্ত্রবাহী জাহাজ স্পেনে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। সেপ্টেম্বরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সামরিক রপ্তানি বন্ধের আবেদন খারিজ করে দেয়।

আরবেলের বিষয়টি প্রথম ঘোষণা করার সময় আদানি ডিফেন্সের সিইও আশীষ রাজবংশী বলেছিলেন, এটি সেনাদের চাপ ও ক্লান্তির মুহূর্তেও টিকে থাকতে সাহায্য করে। ২০২৪ সালের জুনে ইসরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা রোনেন হামুদত বলেন, এতে ইলেকট্রনিক ট্রিগার ও নতুন ফায়ারিং মোড আছে, যা চাপের মুহূর্তে নির্ভুলতা বাড়ায়।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যাকসেস নাও সংস্থার মারওয়া ফাতাফতা বলেছেন, গাজাকে ইসরায়েল পরিণত করেছে নতুন এআই যুদ্ধ প্রযুক্তির পরীক্ষাগারে এবং এবার তা ভারত-ইসরায়েল প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব হয়েছে। এই বিষয়ে মিডল ইস্ট আই জানতে চাইলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য না তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু তারাও কোনো জবাব দেয়নি। ইসরায়েল ওয়েপন ইন্ডাস্ট্রিজের ও আদানিও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

ভারতের এআই খাতে বিনিয়োগ ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ। ২০২৭ সালের মধ্যে বাজার দাঁড়াতে পারে ১৭ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারে। দেশটিতে দ্রুত তৈরি হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এআই-দক্ষ কর্মীশক্তি। গাজার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারত-ইসরায়েলের মধ্যে রোবোটিকস, এআই ও প্রতিরক্ষা গবেষণায় অন্তত ২৪টি চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। ভারতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রেউভেন আজার বলেছেন, ভারত তাদের জন্য দেশীয় বাজার, পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পৌঁছানোর পথ।

ভারতের শান্তিকামী সংগঠনগুলো বলছে, গণহত্যা চলার মাঝেই ভারত-ইসরায়েল অস্ত্র সহযোগিতা লজ্জাজনক। এবার তা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে এআই অস্ত্র ব্যবহারে। সাংবাদিক লোয়েনস্টাইন সতর্ক করে বলেছেন, যত দিন পর্যন্ত গণহত্যার জন্য আইনি শাস্তি না আসবে, এসব এআই অস্ত্র আরও ছড়িয়ে পড়বে।

তিনি বলেন, ‘ভারত যেহেতু ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা, এ ধরনের অস্ত্র ভারত নিজ দেশে বা বিশ্বে অন্যত্রও ব্যবহার করতে পারে। তার মতে, গণতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী যেকোনো সরকারই এমন প্রযুক্তি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে।’