
বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে বৈশ্বিক নেতাদের সমাবেশ মানেই ওয়াশিংটন বা জাতিসংঘ সদর দপ্তর—এমন ধারণা ভেঙে দিচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলন এবং ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে সামরিক কুচকাওয়াজ ঘিরে ২০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে আতিথ্য দিচ্ছেন তিনি।
শি জিনপিংয়ের কাছে এই আয়োজন কেবল আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়, বরং এটি বিশ্বে চীনের নেতৃত্ব ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। তার বক্তব্যে স্পষ্ট—আজকের অনিশ্চয়তার উৎস হলো যুক্তরাষ্ট্র, যারা বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছে এবং নিজেদের নিরাপত্তা জোটকে দুর্বল করছে।
এই সমাবেশে অংশ নিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। এমনকি পশ্চিমাপন্থি ভাবধারার দেশগুলোর মধ্য থেকেও কয়েকজন নেতা উপস্থিত হয়েছেন—যেমন তুরস্ক, মিশর ও ভিয়েতনাম।
তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি, যা দেশটির যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর শুল্কনীতি এবং পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থন।
আমেরিকাবিরোধী জোট
বিশ্লেষকদের মতে, শি জিনপিংয়ের আমেরিকাবিরোধী জোট গঠনের প্রচেষ্টা একেবারেই অবাস্তব নয়। চীন এরই মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, বিশেষ করে এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলোর। যুক্তরাষ্ট্র যখন শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে চাপ বাড়াচ্ছে, তখন চীনের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি তুলনামূলক স্থিতিশীল বলেই মনে করছেন অনেকে।
ডলারনির্ভর বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার বিকল্প গড়ার প্রচেষ্টাও এ সম্মেলনে গুরুত্ব পাচ্ছে। রাশিয়া ও চীন এরই মধ্যে ডলার এড়িয়ে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনে আগ্রহী। ইউরোপও ‘গ্লোবাল ইউরো’ ধারণা তুলছে। ফলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগে আগ্রহী দেশগুলোর সংখ্যা ক্রমেই কমছে।
বিভেদ ও সমালোচনা
তবে সামরিক ক্ষেত্রে ঐক্য ততটা দৃঢ় নয়। ভারত কুচকাওয়াজে যোগ দিচ্ছে না, বরং সীমান্ত সংঘর্ষের কারণে চীনের সামরিক সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া মহাকাশ ও সামরিক প্রযুক্তিতে সহযোগিতা করছে, আর ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের সমর্থনের বিনিময়ে রাশিয়া তাকে উন্নত প্রযুক্তি দিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও শি জিনপিংয়ের ভাবনা সমালোচিত হচ্ছে। ‘ন্যায্য ও সমতাপূর্ণ বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা’ গড়ার নামে চীন এমন একটি কাঠামো চাইছে, যেখানে বড় শক্তিগুলো নিজেদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাবে। তবে এশিয়ার বহু দেশ চীনের কর্তৃত্বে পরিচালিত অঞ্চল চায় না।
যদিও এসব দেশ নীতি ও স্বার্থে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে, তবে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব তাদের এক করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, নানা মতভেদের মাঝেও একসঙ্গে এত নেতাকে এক জায়গায় আনা প্রমাণ করে, চীন এখন বৈশ্বিক পরাশক্তির ভূমিকায় নিজের অবস্থান শক্ত করছে। এটি এখনো নতুন বিশ্বব্যবস্থা নয়, তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বড় ক্ষতি ডেকে আনছে—এ কথা স্পষ্ট।