
"হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে। আমাদের তাঁবু দরকার। আমাদের ওষুধ দরকার। রেড ক্রস সহায়তা দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের আরও সাহায্যের প্রয়োজন," বিবিসির নিউজআওয়ারকে এভাবেই বলছিলেন আফগানিস্তানের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কুনারের আসাদাবাদ এলাকার প্রাদেশিক হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক।
ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার এই বাসিন্দা জানান, তার ছোট হাসপাতালেই ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কিছু দেশ এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, "এখনও পর্যন্ত আমরা কিছুই পাইনি," বলেন তিনি।
"আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তালেবানের সাথে তাদের যেকোনো মতপার্থক্য দূরে সরিয়ে আফগানদের সাহায্য করা এবং সাহায্য পাঠানো," বলেন ওই চিকিৎসক।
জাতিসংঘ মানবিক সংস্থার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রবিবার গভীর রাতে পূর্ব আফগানিস্তানে আঘাত হানা ছয় মাত্রার এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাটি দুর্গম এবং পাহাড়ি হওয়ায় মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বেশিরভাগ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের সবচেয়ে কাছেই অবস্থিত পাহাড়ি কুনার প্রদেশে। দুর্গম এবং পাহাড়ি এলাকাটিতে উদ্ধারকাজ কঠিন হয়ে পড়েছে।
হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এসব এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে উদ্ধারকারীরা।
এদিকে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কুনার প্রদেশ খুবই রক্ষণশীল হওয়ায় ওই এলাকার নারীদের চিকিৎসা সাংস্কৃতিক কারণে বিলম্বিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
আফগানিস্তানে, কঠোর তালেবান নিয়ম এবং পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কারণে নারীদের ভ্রমণ, কাজ, এমনকি অনেক পরিষেবা পাওয়ার জন্য আইনত এবং সামাজিকভাবে একজন পুরুষ অভিভাবক থাকা বাধ্যতামূলক।
একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক বিবিসি আফগান সার্ভিসকে জানিয়েছেন, জালালাবাদের প্রধান হাসপাতালে কিছু নারীকে আনা হলেও, হাসপাতালে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
মানবিক সংস্থা কেয়ারের দীপমালা মাহলা বিবিসিকে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, "নারী ও মেয়েরা এই সংকটের সবচেয়ে বেশি চাপের সম্মুখীন হচ্ছে, যেমনটি সবসময় ঘটে।"
তিনি বলেন "আমাদের নারী মানবিক সহায়তা কর্মীদের প্রয়োজন যারা নারী ও মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারবেন ও তাদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন।"

ছবির উৎস,Getty Images
এদিকে, আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ। চীন, ভারত এবং সুইজারল্যান্ড সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এছাড়া সংগঠনটির বৈশ্বিক জরুরি তহবিল থেকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার অর্থছাড় করেছে জাতিসংঘ।
আফগানিস্তানের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এক মিলিয়ন পাউন্ডের জরুরি তহবিল সহায়তা নির্ধারণ করেছে যুক্তরাজ্য।
তবে দেশেটির পররাষ্ট্র দপ্তর জোর দিয়ে বলেছে যে তারা এই সহায়তা তাদের অংশীদারদের মাধ্যমেই বিতরণ করবে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে সাহায্যটি আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান প্রশাসনের কাছে না যায়।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলছেন, এক মিলিয়ন পাউন্ডের জরুরি তহবিল দিয়ে "আমাদের অংশীদাররা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করবে।"
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের আফগানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি সরবরাহের জন্য যুক্তরাজ্যের তহবিল, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল, ইউএনএফপিএ এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস, আইআরএফসি-এর মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে।
এদিকে, আফগানিস্তানের কাবুলে এক হাজার তাঁবু এবং কুনারে ১৫ টন খাদ্য সহায়তা এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর। ভারত থেকে আরও ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া, জাতিসংঘের বৈশ্বিক জরুরি তহবিল থেকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ মিলিয়ন ডলার অর্থ ছাড় করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

ছবির উৎস,AFP via Getty Images
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিসের (ওসিএইচএ) প্রধান অ্যামি মার্টিন এর আগে বিবিসিকে বলেছিলেন যে ভূমিকম্প-কবলিত এলাকায় আবাসন, আশ্রয় এবং কম্বলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হতে পারে।
তারা গরম খাবার এবং উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন বিস্কুট তৈরি করছে এবং "যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছানোর" জন্য কাজ করছে, তিনি কয়েক ঘণ্টা আগে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।
মিজ মার্টিন মনে করেন, সম্প্রতি মানবিক সহায়তায় "আর্থিক কাটছাঁটের" প্রভাব আফগানিস্তানে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ভূমিকম্প-কবলিত অঞ্চলে ৮০ টিরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক বন্ধ হওয়ায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে গেছে।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর বেশ কয়েকটি সাহায্য সংস্থা আফগানিস্তানে তাদের কাজ বন্ধ করে দেয়।
"আফগান জনগণের সমর্থনে আমরা কী অবস্থায় রয়েছি তা মূল্যায়ন করার জন্য" কাবুলে তালেবান কর্মকর্তাদের সাথে নিজের দেখা করার পরিকল্পনার কথাও জানান মিজ মার্টিন।
আফগানিস্তানে এই ভূমিকম্পটি আট কিলোমিটার বা পাঁচ মাইল গভীরতায় আঘাত হানে - যা আরও ধ্বংসাত্মক হতে পারে - এবং কাবুল থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পর্যন্ত ভবনগুলোতেও এর কম্পন অনুভূত হয়।
এই দুর্ঘটনার পরই আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সহায়তার বার্তা পাঠায় আফগানিস্তানের তালেবান সরকার।