
চলতি সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা ব্যানার্জীকে একই মঞ্চে দেখা যাবে কিনা- এই প্রশ্ন ঘিরে সরগরম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দান।
আগামী ২২শে অগাস্ট থেকে কলকাতায় নতুন মেট্রো রুট চালু হওয়ার কথা, যার উদ্বোধন করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পাঠানো আমন্ত্রণপত্র নবান্নে এসে পৌঁছানোর পর থেকেই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি নিয়ে জল্পনা শুরু হয় যার নেপথ্যে রয়েছে কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সংঘাত’।
অতীতে বিভিন্ন ইস্যুতে কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে রাজ্যের ‘সংঘাত’ দেখা গেছে। জনকল্যাণমূলক কেন্দ্রীয় সুযোগ সুবিধা থেকে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে বারবার অভিযোগ করেছেন মমতা ব্যানার্জী।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্তা, ভোটার তালিকার স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন (এসআইআর)-সহ একাধিক ইস্যুকে নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বিজেপি সরকারকে বাঙালি-বিরোধী বলেও কটাক্ষও করতে ছাড়েননি মমতা ব্যানার্জী।
এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্র সরকারের অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।
অনুষ্ঠানে উপস্থিতি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে অবশ্য এখনো কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘আমরা যতটুকু বুঝেছি, মুখ্যমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যাবেন না।’
এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরকারি অনুষ্ঠানকে দলের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করা থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রের ‘নীতিগত’ তফাতকেও তুলে ধরেছেন কুণাল ঘোষ।
এদিকে, রাজ্যের উন্নয়নের কথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রীকে এক্ষেত্রে ‘রাজনীতি’ দূরে সরিয়ে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। পাশাপাশি, সাংবিধানিক প্রথাকে সম্মান জানানোর কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তৃণমূলের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, সেই প্রথাকে সম্মান জানিয়েই কয়েক কেন্দ্র সরকারের আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তৃণমূলের অভিযোগ, সেখানে বিজেপি কর্মীরা ‘লাগামছাড়া’ আচরণ করেন যার ফলে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সম্মানহানি’হয়।
কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী
আগামী শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর একাধিক কর্মসূচি রয়েছে কলকাতায়। দমদমে একটা জনসভা রয়েছে তার। সেখান থেকে রাজনৈতিক বিরোধীদের উদ্দেশ্যে তিনি কি বার্তা দেন সেদিকে সকলের নজর রয়েছে।
তবে তার আগে রয়েছে সরকারি অনুষ্ঠান। ওইদিনই কলকাতা মেট্রোর তিনটে নতুন রুট শুরু হতে চলেছে। এই তালিকায় রয়েছে ইএম বাইপাস লাগোয়া রুবি মোড় থেকে বেলেঘাটা পর্যন্ত মেট্রোপথ, নোয়াপাড়া থেকে সরাসরি কলকাতা বিমানবন্দর পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা এবং শিয়ালদহ থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সম্পূর্ণ পরিষেবা।
এই রুটগুলোর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উপস্থিত থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু সেই আমন্ত্রণ তিনি 'রক্ষা' করবেন কি না সে নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে।
কারণ তৃণমূলের বক্তব্য, মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা এবং অর্থায়ন করেছিলেন। কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের গতি ধীর ছিল।
২০২৬ সালের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বিজেপি সেই প্রকল্পগুলোর এখন উদ্বোধন করছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে কেন্দ্র সরকারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে।
২০২১ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী কলকাতা এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেখানে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়াকে কেন্দ্র করে ‘রুষ্ট’ হন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
শুধু তাই নয়, মঞ্চে ভাষণ দিতেও অস্বীকার করেন তিনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই সময় ব্যাপক বিতর্কও হয়েছিল। ওয়াকিবহাল মহলের অনুমান, এইবার ওই একই পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতেই চাইবেন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্র-রাজ্য ‘সংঘাত’
শুরু থেকেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে একাধিক ইস্যুকে ঘিরে রাজ্যের সংঘাত বেঁধেছে। কেন্দ্র থেকে দীর্ঘ দিন ধরে ১০০ দিনের কাজের টাকা, আবাস যোজনা, পানীয় জল প্রকল্পের টাকা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছে তৃণমূল কংগ্রেস। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে ‘অপব্যবহার’ করা হচ্ছে বলেও সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাংলা বিরোধী হওয়ার অভিযোগ তুলেছে রাজ্য সরকার।
দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে হেনস্তা এবং জোর করে সীমান্তের অপর প্রান্তে পাঠিয়ে দিচ্ছে এই অভিযোগ তুলে রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিলেও সামিল হয়েছেন মমতা ব্যানার্জী। এনআরসি, ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী বা এসআইআর-এর মতো ইস্যুর তীব্র বিরোধিতা করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া অ্যাল্যায়েন্সের’ অন্যতম প্রধান নেতৃত্বের মধ্যে তিনি একজন।
তৃণমূল কী বলেছে?
আসন্ন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর না যাওয়ার বিষয়ে কুণাল ঘোষ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এর প্রথম কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন এই প্রকল্পগুলো শুধু চূড়ান্তই করেননি, এর জন্য অর্থও বরাদ্দ করেছিলেন। তবে সেই প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর ধরে বিলম্বিত হয়েছে। এখন নির্বাচন এগিয়ে আসায় ওরা নিজেদের নামের ফলক বসাতে চায়। এটা সংকীর্ণ রাজনীতি। প্রথম কথা তো বিলম্ব হওয়াই উচিত ছিল না।’
অতীতের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তিনি। তার কথায়,‘আরেকটা কারণ হলো, এই ধরনের অনুষ্ঠান প্রায়শই রাজনৈতিক দিকে মোড় নেয়। এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া কর্মীদের উপর বিজেপির কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলে এবং এমন কথা বলে বা কাজ করে যা উচিত নয়।’
‘অতীতে নেতাজিকে নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানকেও বিজেপি কর্মীরা তাদের দলের নেতাদের উপস্থিতিতে রাজনীতির জন্য ব্যবহার করেছেন।’
বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্তার অভিযোগও সামনে এনেছেন মি. ঘোষ।
তার কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তা ও বাংলা ভাষাকে আক্রমণের বিরুদ্ধে কেন্দ্র ও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
‘মানুষকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। শুধুমাত্র বাংলা বলার জন্য বাংলাদেশি তকমা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী তাদের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেবেন বলে মনে হয় না।’
বিজেপি কী বলেছে?
সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি ‘বাঞ্ছনীয়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। একই কথা বলেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, আমি আশা করব উনি যাবেন। কিন্তু বিগত দু’বার আমি দেখেছি বিরোধী নেতা উপস্থিত থাকলে ওর অস্বস্তি হয়।’
‘আমি মনে করি রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে প্রত্যেকদিন রাজনীতি না করাই ভালো। অন্তত উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে সবার এক জায়গায় থাকা উচিত।’
মুখ্যমন্ত্রীকে সাংবিধানিক প্রথার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তিনি। বলেছেন, ‘তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিজেপির নেতা বলে মনে করেন। বিরোধী নেতাকে মনে করেন বিজেপির এমএলএ। এর বাইরে তিনি বেরোতে পারেননি এটাই দুর্ভাগ্য।’
অন্যদিকে, মেট্রো প্রকল্পে বিলম্বের অভিযোগ খারিজ করে পাল্টা রাজ্য সরকারকেই দায়ী করেছেন শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা এবং রাজ্য সরকারের সহযোগিতার অভাবের ফলে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো সহ বাংলায় ৪৩টা রেল প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে।’
‘ইমেজ’ ও ‘অবস্থান রক্ষার’ তাগিদ
পুরো বিষয়টার নেপথ্যেই রাজনৈতিক সমীকরণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক ড. বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ব্যাখ্যা করেছেন, ‘মমতা ব্যানার্জীর পক্ষে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকাটা সমস্যার। বাংলা ও বাঙালি, এসআইআর, রাজ্যকে বঞ্চনার মতো ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে তিনি যে মোদি-বিরোধী ইমেজ তৈরি করেছেন তাতে এই জাতীয় সরকারি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে সেটা বিস্ময়কর হবে।’
‘উনি মোদির বিরুদ্ধে যে ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন সেটা অন্তত তিনি ২০২৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত জারি রাখবেন বলেই মনে হয় যাতে মুসলিম ভোট নিশ্চিত করা যায়।’
পাশাপাশি, অবস্থান রক্ষার তাগিদও রয়েছে।
ড. চক্রবর্তী বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী ওই সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেলে জনসমক্ষে এটা স্বীকার করে নেওয়া হবে যে কেন্দ্র সরকার এই রাজ্যে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। সেক্ষেত্রে তার কেন্দ্র বিরোধী অবস্থান ধাক্কা খাবে।’
বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গির কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন,‘বিজেপিও কী এটা খুব একটা চাইছে? কারণ মমতা ব্যানার্জী যেমন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন, বিজেপিও তার বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ তৈরি করেছে।’
‘তাই মোদি ও মমতা একই মঞ্চে থাকলে বিজেপিরও ক্ষতি। এতে বাম ও কংগ্রেস এটা বলা সুযোগ পাবে যে বিজেপি ও তৃণমূলের গোপন আঁতাত রয়েছে।’