
কিছুদিন আগেও মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসায় যা অকল্পনীয় মনে হতো তা এখন বাস্তাবে হচ্ছে। সেখানে ইহুদিরা দলবদ্ধভাবে প্রার্থনা, গান, নাচ, পতাকা ওড়ানো, এমনকি মাটিতে সেজদা পর্যন্ত দিচ্ছেন। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।
ইসলামিক ওয়াকফ-এর আন্তর্জাতিক বিষয়ক পরিচালক আউনি বাজবাজের অভিযোগ, ‘যেসব ইহুদি সেখানে প্রবেশ করছে, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রভাবশালী ব্যক্তি। এর মাধ্যমে আল-আকসায় জোরপূর্বক ইহুদিদের সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ তার মতে, মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিদেরও প্রার্থনার অনুমতি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
জেরুজালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি দখলদারিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। মুসলিমদের কাছে এটি স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক, আর ইসরায়েলিদের বিশ্বাস—এখানেই নির্মিত হবে তাদের ‘থার্ড টেম্পল’ বা তৃতীয় মন্দির।
ভাঙছে ‘স্ট্যাটাস কো’
উনিশ শতকের শেষদিকে অটোমান সাম্রাজ্য জেরুজালেমের ধর্মীয় স্থানগুলো পরিচালনার জন্য একটি চুক্তি করে। এটি ‘স্ট্যাটাস কো’ নামে পরিচিত। এ চুক্তিটি বিশ্বের বেশিরভাগ সম্প্রদায় মেনে চলে।
চুক্তি অনুযায়ী, ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গমিটারের আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্স—যার মধ্যে রয়েছে ডোম অব দ্য রক, কিবলা মসজিদ এবং অন্যান্য ভবন ও গেট—সম্পূর্ণভাবে মুসলিম প্রশাসনের অধীনে থাকবে।
এই প্রশাসনকে ইসলামিক ওয়াকফ বা ধর্মীয় ওয়াকফ বলা হয়, যা জর্ডানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। নিয়ম অনুযায়ী, মসজিদের ভেতরে শুধু মুসলিমরাই নামাজ পড়তে পারবে। অমুসলিমরা এখানে যেতে পারবে, তবে কখন এবং কীভাবে, তা ওয়াকফ নির্ধারণ করবে। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং খনন কাজের দায়িত্বও সম্পূর্ণভাবে ওয়াকফের হাতে।
১৯৯৪ সালে জর্ডানের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তি চুক্তিতে আল-আকসায় ইসলামিক ওয়াকফর নিয়ন্ত্রণকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত এই চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কারণ ইসরাইল আল-আকসায় যেকোনো হামলার ফলে বিশ্ব মুসলিমদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার ভয় করত।
তবে, ২০০২ সালে ইসরাইলি কুখ্যাত বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন শতশত সশস্ত্র প্রহরী নিয়ে মসজিদে হামলার পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। এই হামলার পর ফিলিস্তিনিরা বিদ্রোহ শুরু করে। যা দ্বিতীয় ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহের পর থেকে ইসরাইলি দখলদাররা আরও বেশি করে আল-আকসায় যাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে থাকে।
প্রথমত, ইসরাইল তাদের সেনাাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের নিয়মিতভাবে মসজিদের প্রাঙ্গণ ও গেটগুলোতে মোতায়েন শুরু করে এবং ফিলিস্তিনিদের মসজিদে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করে। একই সময়ে, ইসরাইলি ওয়াকফ থেকে আল-আকসার নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয় তারা। এরপর দখলদাররা ব্যাপক আকারে সেখানে যাওয়া শুরু করে।
আল-আকসায় এ ধরনের অনুপ্রবেশের আয়োজন করে ‘টেম্পল মাউন্ট অ্যাক্টিভিস্ট’ নামে পরিচিত বিভিন্ন সংগঠন, যারা আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে তৃতীয় মন্দির নির্মাণের দাবি জানায়। ২০০০ সালের পর থেকে ইসরায়েল প্রকাশ্যে আল-আকসা মসজিদের নিচে খনন কাজ শুরু করে, যা চুক্তির আরেকটি গুরুতর লঙ্ঘন।
ইহুদিদের অনুপ্রবেশের স্বাভাবিকীকরণ
২০০০ সালের পর থেকে আল-আকসার নিচে খনন কাজ শুরু করে ইসরাইল। এরপর ধাপে ধাপে ইহুদিদের প্রবেশ নিয়মিত করা হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে এটি প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে। এখন প্রতিদিন সকাল ও দুপুরে আলাদা আলাদা দল প্রবেশ করে প্রার্থনা করে। ফিলিস্তিনিদের অভিযোগ—এভাবে আল-আকসাকে মুসলিম-ইহুদি যৌথ প্রার্থনার জায়গা বানানোর পরিকল্পনা চলছে।
২০২১ সালের রমজানে ইসরাইলি বাহিনী মসজিদে অনুপ্রবেশ করে নামাজে বিঘ্ন ঘটায়। এর জেরে ফিলিস্তিনজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরু হয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ চালায়, সেটিকে ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়া বলেই দাবি করে তারা।
মুসলিমদের প্রবেশাধিকার সংকোচন
৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরাইল আল-আকসার নিয়ন্ত্রণ আরও কড়াকড়ি করে। প্রথম শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ৬০ বছরের নিচে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অনেক তরুণকে দমন করে রাস্তায় নামাজ পড়তে বাধ্য করা হয়। একইসঙ্গে পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে আগত মুসলিমদের প্রবেশও প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন যেখানে একসময় লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ পড়তেন, সেখানে শুক্রবার কয়েক হাজার এবং প্রতিদিন মাত্র কয়েকশো মুসল্লি উপস্থিত থাকতে পারছেন।
প্রকাশ্যে ইহুদিদের প্রার্থনা
একসময় গোপনে প্রার্থনা করা ইহুদিরা এখন প্রকাশ্যে তা করছে। ২০২৪ সালে ৫৬ হাজারেরও বেশি ইহুদি আল-আকসায় প্রবেশ করে প্রার্থনা করেছে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির প্রকাশ্যে প্রার্থনার অনুমতি দেন, নিজেও সেখানে প্রার্থনা করেন। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, এর মাধ্যমে ইসরাইল দেখাতে চাইছে—আল-আকসার ‘সার্বভৌমত্ব’ তাদের হাতেই।
তৃতীয় মন্দিরের পরিকল্পনা
২০২৩ সালে ইসরাইলি এমপি অমিত হালেভি আল-আকসাকে মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করার প্রস্তাব দেন। তার মতে, ডোম অব দ্য রকসহ প্রায় ৭০ শতাংশ জায়গা ইহুদিদের হাতে দেওয়া উচিত। পরে বেন গভিরও এর পক্ষে অবস্থান নেন এবং কমপ্লেক্সে সিনাগগ নির্মাণের ধারণা দেন।
দীর্ঘদিন ধরে চরমপন্থী ইহুদি সংগঠনগুলো আল-আকসা ধ্বংস করে সেখানে তৃতীয় মন্দির নির্মাণের দাবি জানাচ্ছে। ইসরাইলের শীর্ষ নেতারাও এখন প্রকাশ্যে সেই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী বেজায়েল স্মোরিচ প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আল-আকসায় তৃতীয় মন্দির পুনর্নির্মাণ করা হবে।’
ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা, আল-আকসা দখলের লক্ষ্য নিয়ে প্রথমে এটির ভেতর একটি সিনাগগ তৈরি করবে। এরপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। হেবরনের ইব্রাহিমি মসজিদের ক্ষেত্রেও তারা একই কাজ করেছে।
ইসলামি ওয়াকফের একটি সূত্র বলেছেন, ‘আল-আকসা মসজিদে যা ঘটছে তা শুধু কিছু সাময়িক লঙ্ঘনের ঘটনা নয়। এটি একটি ব্যাপক ইহুদিকরণ প্রকল্প, যার লক্ষ্য হলো মসজিদের ওপর পূর্ণ ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া। ফিলিস্তিনি এবং মুসলিম বিশ্বকে এই চ্যালেঞ্জের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে এবং এমন একটি পরিকল্পনার মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে, যা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে, কারণ একবার চাপানো বাস্তবতা অপরিবর্তনীয় হয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকবে না।’