Image description

শেষ পর্যন্ত আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ চলেই গেলেন। গাজায় আল-শিফা হসপিটালের বাইরে সাংবাদিকদের জন্য স্থাপিত তাঁবুতে গত রাতে ইসরায়েল হামলা করে এবং আনাসসহ ৭ সাংবাদিক শহিদ হন। তার মধ্যে ৫ জন আলজাজিরার। এ নিয়ে এক দিনে আলজাজিরার ৬ সাংবাদিক শহিদ হলেন। গত ২২ মাসের যুদ্ধ মোট ২০০+ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন গাজায়, যার মধ্যে আলজাজিরার ১০ জন।
মাঝেমধ্যে মনে হয় এই হৃদয়বিদীর্ণ করা যুদ্ধটা বুঝি আলজাজিরা একাই লড়ছে। 


অথচ নেতানিয়াহু গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তিনি কিছু বিদেশি সাংবাদিককে ঢুকতে দিতে চান। তার কয়েক ঘন্টা পরই আনাসকে তার ৪ সঙ্গীসহ হত্যা করা হয়। তারা তার বিরুদ্ধে হামাস সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছে, যা তারা করেই থাকে।
গতমাসে ইসরায়েলি আর্মির এক মুখপাত্র আনাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর জাতিসংঘের ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের র‍্যাপোর্টার আইরিন খান উদ্বেগ জানিয়েছিলেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি সৈন্যরা কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করল না।
আনাসের বয়স মাত্র ২৮ বছর, আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। হাসানের চেয়ে একটু বড়। পৃথিবী কেমন ছিল আনাসের কাছে? রঙিন? আলজাজিরার মতো বিশ্বকাঁপানো মিডিয়ার আরবি সংবাদদাতা। কত বড় জগৎ পড়ে ছিল তার সামনে।


শহিদ হওয়ার মাত্র কিছুক্ষণ আগে আনাস  এক্স-এ (টুইটার) লিখেছেন যে ইসরায়েল গাজা শহরের পূর্ব ও দক্ষিণে তীব্র বোমাবর্ষণ শুরু করেছে, যাকে বলে ‘ফায়ার বেল্ট‘। একটা শর্ট ভিডিওও দিয়েছেন, যাতে লাগাতার ক্ষেপণাস্ত্র নিনিক্ষেপের আওয়াজ শোনা যায়।
আনাস অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন, তার মৃত্যু আসন্ন। গাজার সংবাদের বিবরণ দেওয়া যে কতটা বেদনার, তা প্রায়ই বলতেন। একাধিকবার দেখেছি, উত্তেজনায় তার বাক্য জড়িয়ে যাচ্ছে। একবার দেখি, পিছনে বোমা পড়ছে, শব্দে তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন, তখনও বলে যাচ্ছেন।
গত জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতির সময় বন্দিদের মুক্তি অনুষ্ঠানে তিনি একেবারে স্টেজের সামনে চলে গেছেন কয়েকবার। তার আরবিতে লোকাল টোন স্পষ্ট বোঝা যেত। যেন একটা গাঁয়ের ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেছে।
গত ৬ এপ্রিল আনাস লিখেছেন বারবার তার দুঃখে ও সংকটের মধ্যে পড়ার কথা। লিখেছেন, “তবুও, কখনও সত্যকে যেমন আছে ঠিক তেমনভাবে প্রকাশ করতে আমি দ্বিধা করি নাই, বিকৃতি বা ভুল উপস্থাপনা করি নাই। আশা করেছি, আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী থাকবেন যারা এখনও চুপ করে আছে, যারা আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছে এবং যারা আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে।


“এমনকি আমাদের শিশু ও নারীদের ক্ষতবিক্ষত দেহও তাদের হৃদয়কে নাড়া দেয় নাই, আমাদের জনগণের ওপর গত দেড় বছর ধরে চলা গণহত্যা বন্ধে তারা উদ্যোগ নেয় নাই।”
তার দুঃখ শুধু ছিল, প্রিয়তমা স্ত্রী বায়ানকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে এবং ছেলে সালাহ আর মেয়ে শামের বেড়ে ওঠা দেখে যেতে পারছেন না।
আনাসের সংবাদ উপস্থাপন দেখতে দেখতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, গত রাতে আনাস চলে গেছেন, এখনও ঠিক অনুভব করতে পারছি না। একবার দেখলাম, যোদ্ধারা যেদিক দিয়ে ইসরায়েলি সৈন্যদের হামলা করছেন, সেদিকে চলে গেছেন তিনি, তারপর ভেস্ট পরে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলছেন, আর কথা বলছেন, কোনও যোদ্ধার মন্তব্য নিচ্ছেন, গুলির সময় মাথা নিচু করে ফেলেছেন, কোমর বাঁকিয়ে হাঁটছেন, যেনবা তিনি নিজেই যুদ্ধটার নেতৃত্বে।
আল্লাহ তাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ সম্মান দিন।