
মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সেই ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি ও কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে গত ২৪ জুলাই মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কিছু ব্যক্তি ও কোম্পানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়। এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বিষয়টি জানায় ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।
আরও নির্দিষ্ট করে বললে, মোট তিনটি কোম্পানি ও চার ব্যক্তির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—কেটি সার্ভিসেস অ্যান্ড লজিস্টিক ও এর প্রধান নির্বাহী জোনাথন মায়ো কিয়া থং। জান্তা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন এই প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি করছিল।
এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে মিয়ানমার কেমিক্যাল অ্যান্ড মেশিনারি কোম্পানি ও সানটাক টেকনোলজিসের ওপর থেকেও। এই কোম্পানিগুলো সাধারণত অস্ত্র তৈরি করে। এই দুই কোম্পানির মালিকদের ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের ভাষায় ‘জান্তা রেজিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা একাধিক কোম্পানির মালিক’ তিন লাত মিনের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিও বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকের নির্বাহী পরিচালক আনা রবার্টস বলেন, এটি লজ্জাজনক বিষয়। এই প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সাল থেকে তাতমাদাও নামে পরিচিত মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ব্যক্তিদের তালিকা করে আসছে। তাদের লক্ষ্য, এসব ব্যক্তি ও কোম্পানির ওপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত করা।
আনা রবার্টস বলেন, সাধারণ জনগণের ওপর যতক্ষণ নিপীড়ন-নির্যাতন চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জান্তা ও এর সমর্থকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা শক্তিশালী করা উচিত। অথচ হচ্ছে এর উল্টো। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা দেখছি, জান্তা বাহিনীকে সমরাস্ত্র সরবরাহ করে এমন কোম্পানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এটা আরও বেশি জঘন্য বিষয়।’
এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে সেনাবাহিনী ও গণতন্ত্রপন্থীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে কয়েকটি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও যুক্ত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লড়াই চলতে থাকায় নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর দিচ্ছে বিভিন্ন এনজিও।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাত আরও বেড়েছে। সংস্থাটি জানায়, সামরিক বাহিনীর বিমান হামলার সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি স্কুল, হাসপাতাল ও বেসামরিক অবকাঠামোতেও হামলা বেড়েছে। এতে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) কৌঁসুলি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক দেশান্তর ও নিপীড়নের অভিযোগে মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক অ্যাডভোকেসি পরিচালক জন সিফটন বলেন, এই পদক্ষেপে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে বড়ধরনের পরিবর্তন আসছে, যা এত দিন মূলত মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করেছিল।
সিফটন আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য এবং যাঁরা গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই ও প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা আসার পর থেকে এ সিদ্ধান্তের পেছনে কী প্রেরণা কাজ করেছে, তা নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, এর পেছনে মূলত অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। আবার কারও মতে, এটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অহমিকা পূরণের বিষয়ও হতে পারে।
জুলাইয়ের শুরুর দিকে ট্রাম্প মিন অং হ্লাইংকে এক চিঠি পাঠান। তাতে তিনি জানান, তাঁর নতুন বাণিজ্যনীতির অংশ হিসেবে ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমারের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হবে। জবাবে ১১ জুলাই সেনাপ্রধান এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেন এবং ট্রাম্পের প্রশংসা করে লেখেন, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের ভাষায়, ‘সিনিয়র জেনারেল (মিন অং হ্লাইং) স্বীকার করেছেন যে, প্রেসিডেন্টের (ট্রাম্প) দৃঢ় নেতৃত্ব তাঁর দেশকে সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের চেতনায় জাতীয় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিচ্ছে।’
তবে এই প্রশংসা সত্ত্বেও এটি দুই দেশের নতুন সম্পর্কের সূচনা নয় বলে মনে করেন আনা রবার্টস। তিনি বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই চিঠি আসলে একটি কপিপেস্ট—যেমন তিনি অন্যান্য দেশকেও পাঠান। সেনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছার কোনো প্রমাণ নেই। তবে জান্তার জন্য এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার আশা জাগাতে পারে।
মিয়ানমার বিশ্বের অন্যতম প্রধান রেয়ার আর্থ মিনারেলস বা বিরল মৃত্তিকা খনিজের উৎস। এসব খনিজ ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য কৌশলগত প্রতিযোগিতায় বিশেষ গুরুত্বের। কারণ, এর ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা চীনের হাতে। এই ধাতুগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি থেকে শুরু করে নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা ধরনের দৈনন্দিন ও উচ্চপ্রযুক্তির পণ্যে ব্যবহৃত হয়।
উন্নয়নশীল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন ঠেকাতে কাজ করা এনজিও গ্লোবাল উইটনেসের ২০২৪ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২১ সালের পর থেকে মিয়ানমার প্রতিবেশী চীনে রেয়ার আর্থ বা বিরল খনিজ রপ্তানি দ্বিগুণ করেছে। বিরল মৃত্তিকা ধাতু উত্তোলনের খনিগুলো অবস্থিত কাচিন রাজ্যে, যা চীন-মিয়ানমার সীমান্তে। সেখানে খনির সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। ২০২১ সালে যেখানে খনি ছিল ১৮০টি, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ শতাধিকে।
এই খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার পেতেই যুক্তরাষ্ট্র কি কৌশলগতভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে? এ বিষয়ে আনা রবার্টস বলেন, যদি তা-ই হয়, তবে এটি হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথমত, চীন সব সময়ই জান্তার সবচেয়ে বড় সমর্থক এবং মিয়ানমারের ওপর তাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এই খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিলেও সেগুলো থেকে বাস্তবে খুব বেশি কিছু করার সম্ভাবনা কম। লজিস্টিকস চ্যালেঞ্জ হবে বিশাল। কিছু খনি বর্তমানে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তারা জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত এক জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী। রবার্টসের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের প্রকল্পে যুক্ত হয়ে নিজের সুনাম ঝুঁকিতে ফেলা বা আইনি জটিলতায় জড়ানোর সম্ভাবনা থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি এমন ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো গোপন উদ্দেশ্য ছিল না বলে দাবি করেছেন মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি মাইকেল ফকল্যান্ডার। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, যাঁরা বলছেন—এই নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাঁরা অজ্ঞ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঘৃণা করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়াচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়মিতভাবেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যোগ ও বাদ দেওয়া হয়।
রবার্টসের মতে, যা-ই হোক, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বার্তা দিচ্ছেন, তা ভয়াবহ। তাঁর নীতিগুলো মিয়ানমারের জনগণের জন্য আগেও ক্ষতিকর ছিল, বিশেষত ইউএসএআইডির বাজেট কাটছাঁটের কারণে, যা অনেক মানুষকে জরুরি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করেছে। তিনি এমন এক সময়ে জান্তার পক্ষে খেলছেন, যখন তাঁরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈধতা পাওয়ার বড় প্রচেষ্টায় নেমেছেন।
গত ৩১ জুলাই সামরিক জান্তা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এই জরুরি অবস্থা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর ছিল। তাদের লক্ষ্য হলো—২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা। সামরিক সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ও নিজেদের বৈধ রূপ দিতে চাইছে, যদিও দেশের বড় একটি অংশ এখনো গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী গোষ্ঠীগুলো আগেই ঘোষণা দিয়েছে যে তারা এই নির্বাচন বর্জন করবে।
আনা রবার্টস বলেন, ‘২০১০ সালের আগের অভ্যুত্থানেও সামরিক জান্তা একই কাজ করেছিল। তারা নির্বাচন আয়োজন করেছিল এবং কয়েদিদের মুক্তি দিয়েছিল, যাতে স্থিতিশীলতার ভান তৈরি হয়। এতে আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা কমেও গিয়েছিল। আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং যেন আবার সেই ফাঁদে না পড়ি। এখন আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ শিথিল করার সময় নয়। বরং নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখা—প্রয়োজনে আরও কড়া করা জরুরি।’
ফ্রেঞ্চ-২৪ এর প্রতিবেদন থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান