Image description

বিশ্বের তিনটি প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশ- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডা সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে ১৪০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই নতুন অবস্থান বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আশার সঞ্চার করলেও বাস্তবতা হলো, এখনো এই রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা অনেক দূরের পথ। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা সিএনএনে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার প্রকাশিত বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের এই উদ্যোগের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে- ইসরায়েলের প্রতি হতাশা, ফিলিস্তিনের পক্ষে নিজ নিজ দেশের জনগণের চাপ এবং গাজায় না খেয়ে থাকা শিশুদের হৃদয়বিদারক চিত্রের প্রতি আন্তর্জাতিক উদ্বেগ। তবে ইসরায়েল এই দাবিগুলোকে সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত করার শামিল বলে নাকচ করে দিয়েছে।

ট্রাম্পের অবস্থান ও মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছেন, বিশেষ করে গাজার দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে। বিষয়টি নেতানিয়াহু অস্বীকার করলেও ট্রাম্পকে নাড়া দিয়েছে। এরই মধ্যে সেখানে ক্ষুধায় মারা যেতে শুরু করেছে মানুষ। শিশুরাই বেশি মারা যাচ্ছে। আবার ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গত শুক্রবারও খান ইউনিসে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুই ফিলিস্তিনি।

ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সেই সঙ্গে একটি নোবেল পুরস্কার লাভ করতে চান। তিনি চান সৌদি আরব যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, ঠিক যেমন তার মেয়াদে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে অন্যান্য আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। কিন্তু সৌদি আরব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অপ্রতিরোধ্য পথ ছাড়া এ ধরনের কোনো সমঝোতা হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ একা হয়ে পড়ছে
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডার সাম্প্রতিক অবস্থান গ্রহণ মূলত প্রতীকী হলেও এতে ওয়াশিংটন ক্রমেই ইসরায়েলের একমাত্র বড় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এখন আন্তর্জাতিক মহলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। গাজার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে যখন বিশ্বনেতারা নতুন কূটনৈতিক পথ খুঁজছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একেবারে ভিন্ন পথে হাঁটছেন। কানাডা, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে- তারা নির্দিষ্ট শর্তে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কেও বড় ফাটল ধরেছে।

এদিকে ফিলিস্তিনকে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ‘ইসরায়েল যদি এতে সম্মত না হয় তবে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হতে পারে না।’ গত বৃহস্পতিবার ফক্স রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুবিও বলেন, ‘এই দেশগুলোর কোনোটিরই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ক্ষমতা নেই।’ তিনি বলেন, ‘তারা আপনাকে বলতেও পারবে না, এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটি কোথায়। তারা আপনাকে বলতে পারবে না, এটি কে পরিচালনা করবে। আমার মনে হয়, এটি বিপরীতমুখী।’

দুই দশকের পুরোনো শান্তি পরিকল্পনা এখন অকেজো
১৯৯০-এর দশকে ওসলো চুক্তির মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরি হয়েছিল। তখন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুই পক্ষই ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সম্মত হয়।

চুক্তির অংশ হিসেবে কিছু জমি অদল-বদল করে ইসরায়েলি বসতি সরানোর পরিকল্পনাও ছিল। তবে সেই চুক্তির মূল স্থপতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ১৯৯৫ সালে এক উগ্র ডানপন্থির হাতে নিহত হন। এর পর থেকে ওসলো চুক্তি কার্যত থেমে গেছে। আর এখনকার বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ব্যাপক হারে নতুন বসতি গড়ে তুলেছে, যা একটি সংহত ও কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে দিন দিন ক্ষীণ করে দিচ্ছে।

ফিলিস্তিন নেতৃত্বের সংকট ও ইসরায়েলের কঠোর অবস্থান
ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে শাসন করবে- এটিও একটি বড় প্রশ্ন। বর্তমানে পশ্চিম তীরের কিছু অংশে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ শাসন করছে, তবে ফিলিস্তিনের বহু নাগরিকই তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর হিসেবে দেখেন।

অন্যদিকে নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণাকে মানেন না। সম্প্রতি তিনি বলেন, এই রাষ্ট্র গঠন ‘ইসরায়েলকে ধ্বংসের জন্য একটি লঞ্চপ্যাড’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তার সরকারে কয়েকজন কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রী তো আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, তারা গাজার মানুষকে খাওয়াতে রাজি নন এবং নেতানিয়াহু যদি আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন, তবে তারা সরকার ভেঙে দেবেন।

নেতানিয়াহু আপাতত তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর চাপকেও তিনি সামলানোর চেষ্টা করছেন।

এই পরিস্থিতিতে যদি ইসরায়েল কোনো সমঝোতায় না আসে, তাহলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতির আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে। তবে পাশাপাশি এটাও সত্য যে আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় ইসরায়েল ভবিষ্যতে কূটনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ যদি তাদের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়, তাহলে ইসরায়েল মারাত্মক চাপের মধ্যে পড়বে। সূত্র: সিএনএন