
গত সপ্তাহে নেট দুনিয়ায় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে ১৮ মাস বয়সী এক ফিলিস্তিনি শিশুর ছবি। গাজার ওই শিশুটির শরীর ছিল কঙ্কালের মতো, পাঁজর ও মেরুদণ্ড স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিবিসি, সিএনএন এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ছবি বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। তবে ছবিটি নিয়ে ইসরায়েল ও তাদের সমর্থকরা দাবি করেছে, শিশুর আগেই ‘স্বাস্থ্যগত জটিলতা’ ছিল। এই দাবির ভিত্তিতেই গাজায় ইচ্ছাকৃত দুর্ভিক্ষ চালানো হচ্ছে এমন অভিযোগকে ‘মিথ্যা’ বলে দাবি করে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা। খবর মিডল ইস্ট আইয়ের।
মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা নগরীর পশ্চিমাংশে এক অস্থায়ী তাঁবুতে শিশুটির মা ও তাকে খুঁজে পায় তাদের প্রতিবেদক। শিশুটির মা হিদায়া বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম।’ সেই সময় শিশু মুহাম্মদ আল-মুতাওয়াক তার গর্ভে ছিল। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারে রাখার কৌশলের প্রতীক হয়ে উঠেছে মুহাম্মদ আল-মুতাওয়াকের ছবিটি।
হিদায়া বলেন, ‘ছেলের শরীর আর মুখে পরিবর্তন লক্ষ্য করার পর আমি তাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাই। তারা বললো, এখন একমাত্র চিকিৎসা হলো খাবার। তারা বলেছিল, তার প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুষ্টি। এমন শিশুদের দুধ, ডিম, চিজ, সবজি, ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সে পৃথিবীতে আসার পর থেকে একটাও ফল মুখে তোলেনি। অনাহার আর অভাব-অনটনের মধ্যেই তার জন্ম।’
‘সে জন্ম নেয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধের চরম পর্যায়ে, যখন দুর্ভিক্ষের প্রথম ধাপ চলছিল।’ হিদায়া জানান, জন্মের সময় অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মুহাম্মদের কিছুটা পেশি দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পরে ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছিল। ‘ডাক্তাররা পর্যন্ত তার উন্নতিতে বিস্মিত হয়েছিল’ বলেন তিনি।
তবে দুই মাস বয়সে এসে হিদায়া নিজেই অপুষ্টিতে ভুগতে শুরু করেন। আর তার সন্তান মুহাম্মদ দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন থেকেই শুরু হয় দুধ ও বেবি ফরমুলা সংগ্রহের লড়াই।
হিদায়া বলেন, ‘প্রথম দিকে হাসপাতালে গিয়ে দুধ জোগাড় করতাম। তখন ওর বাবা বেঁচে ছিলেন, তিনি দুধ নিয়ে আসতেন। এরপর ইসরায়েলি হামলায় তিনি নিহত হন। তবুও মুহাম্মদের স্বাস্থ্যে কিছুটা অগ্রগতি হচ্ছিল। সে হামাগুড়ি দিত, দাঁড়াতে শেখে এবং ‘আম্মা’, ‘আব্বা’ বলতে শিখেছিল।’
২০২৫ সালের শুরুর দিকে মুহাম্মদ হাঁটা শেখে। কিন্তু এরপর আবার জাবালিয়া এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পরিবারটি। তখন থেকেই মুহাম্মদের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হতে থাকে। তার ওজন ৯ কেজি থেকে কমে ৬ কেজির নিচে নেমে আসে। পেশি ও চলাফেরার ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছিল, তা পুরোপুরি উল্টে যায়।
শিশুটির মা বলেন, ‘ছেলের শরীর আর মুখে পরিবর্তন লক্ষ্য করার পর আমি তাকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাই। তারা বললো, এখন একমাত্র চিকিৎসা হলো খাবার। তারা বলেছিল, তার প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুষ্টি। এমন শিশুদের দুধ, ডিম, চিজ, সবজি, ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সে পৃথিবীতে আসার পর থেকে একটাও ফল মুখে তোলেনি। অনাহার আর অভাব-অনটনের মধ্যেই তার জন্ম।’
‘আমি ভেবেছিলাম, সে মারা গেছে। আমি বুকের কাছে কান রাখতাম, তার হৃৎস্পন্দন শোনার জন্য। সে নড়াচড়া করত না, তীব্র ডায়রিয়ায় ভুগছিল। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যে রান্নাঘরের খাবারের ওপর নির্ভর করছিলাম, তা থেকেই সে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।’
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মুহাম্মদ বর্তমানে তীব্র অপুষ্টি জনিত রোগে ভুগছে, যা অপুষ্টির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ। উপযুক্ত পুষ্টি ও চিকিৎসা অব্যাহতভাবে না পেলে তার জীবন হুমকির মুখে থাকবে বলেও তারা হুঁশিয়ার করেছেন। জুলাইয়ের শুরুতে মুহাম্মদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে দেখা যায়, সে মারাত্মক পানিশূন্যতায় ভুগছে।
হিদায়া বলেন,‘ আমি ভেবেছিলাম, সে মারা গেছে। আমি বুকের কাছে কান রাখতাম, তার হৃৎস্পন্দন শোনার জন্য। সে নড়াচড়া করত না, তীব্র ডায়রিয়ায় ভুগছিল। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যে রান্নাঘরের খাবারের ওপর নির্ভর করছিলাম, তা থেকেই সে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।’
চিকিৎসায় সামান্য উন্নতি হলেও চিকিৎসকরা জানান, পুষ্টিকর খাবার ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী উন্নতি সম্ভব নয়। তবুও হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, কারণ আরও শিশুদের চিকিৎসার জন্য শয্যার প্রয়োজন। মুহাম্মদের মতো শত শত শিশু এখন গাজার হাসপাতালগুলোতে অনাহারে শুয়ে আছে।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ১১২টি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে। শুধু জুন মাসেই ৬ হাজার ৫ শত শিশু এবং জুলাইয়ের প্রথম দুই সপ্তাহে আরও ৫ হাজার শিশু একই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
ইউনিসেফ সতর্ক করে বলেছে, গাজা উপত্যকার পুরো জনগোষ্ঠী এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং পাঁচ বছরের নিচের প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে।
হিদায়া বলেন, ‘মুহাম্মদ একসময় হাঁটতে শিখেছিল, এখন সে নিজে বসে পর্যন্ত থাকতে পারে না। সে মাথা ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারে না, পা নাড়ায় না বললেই চলে। হাতও খুব একটা নড়াচড়া করে না। আমি যদি তাকে হামাগুড়ি দিতে না দেখতাম, তাহলে ভাবতাম এ অবস্থার পেছনে অন্য কোনও রোগ আছে। ওর অবস্থা ছিল সামান্য, আর উন্নতির পথে ছিল। আমরা যখন ওকে দুধ ও খাবার দিতে পারলাম না, তখন থেকেই সে এই অবস্থায় নেমে এলো।’
তিনি আরও জানান, রাতে মুহাম্মদ যখন দুধের জন্য কাঁদে, তখন তিনি তাকে শুধু পানি খাইয়ে শান্ত করেন। অনেক সময় খালি পেটে ঘুমাতে হয়। কখনও কখনও টানা চারদিন পর্যন্ত না খেয়েও থাকতে হয়। শিশুদের খাবার, দুধ, নিউট্রিশন সাপ্লিমেন্ট কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। আর যা মেলে, তার দাম এত বেশি যে কিনে আনা অসম্ভব। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি দুই সন্তানের একমাত্র আশ্রয়। এত দামে খাবার কিনে আনা অসম্ভব।
হিদায়া বলেন, ‘আমার ছেলে এখন হাড়ে পরিণত হয়েছে। তার পাঁজর, মেরুদণ্ড সব দেখা যায়। কেবল খাবারের অভাবে। খাবারের পাশাপাশি এখন ডায়াপারের জন্যও আমার সংগ্রাম চলমান। কারণ ইসরায়েল ওই পণ্যগুলোও গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে না।’
হিদায়া আরও বলেন, ‘দুইটা প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়ে দেই যেন প্রস্রাব-পায়খানা বাইরে না যায়। কল্পনা করুন, এই প্রচণ্ড গরমে, তাঁবুতে বসবাস করে একটি শিশুর জন্য কী যন্ত্রণা? কীভাবে তার নরম ত্বকে র্যাশ ও চুলকানির সৃষ্টি হয়। আমি জানি না, কী ধরনের জীবনে সে পা রেখেছে। বাকি দুনিয়ার যেটুকু ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিস নিশ্চিত, সেটুকুও আমি দিতে পারছি না। দখলদার শক্তি আমাদের না খাইয়ে মারতে চাচ্ছে। ওরা আমাদের শিশুদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে।’