
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেছেন যে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখন ‘ব্রেকিং পয়েন্টে’ পৌঁছে গেছে এবং এটি একটি এক-রাষ্ট্র বাস্তবতায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে-যেখানে স্থায়ী দখলদারিত্ব ও কাঠামোগত বৈষম্য বিদ্যমান থাকবে। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় টেকসই শান্তির একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ হচ্ছে দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান, এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উচিত অবিলম্বে ও অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি ও দুই-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন’ বিষয়ক তিন দিনব্যাপী উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে গতকাল গুতেরেস বলেন, “দশকের পর দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতি প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, কিন্তু শান্তি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। শব্দ, বক্তৃতা, ঘোষণার বাস্তব জীবনে কোনো অর্থ নেই- কারণ মানুষ এগুলো বহুবার শুনেছে, কিন্তু একইসঙ্গে দেখেছে ধ্বংস ও দখলদারিত্ব এগিয়ে চলছে।”
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, দুইটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র- ইসরাইল ও ফিলিস্তিন পারস্পরিক শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে পাশাপাশি অবস্থান করবে, যার রাজধানী হবে জেরুজালেম এবং যা ১৯৬৭-র আগের সীমানা ও আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।
দুই-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে গুতেরেস প্রশ্ন করেন, “বিকল্প কী? এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে ফিলিস্তিনিদের সমান অধিকার অস্বীকার করা হবে এবং তারা স্থায়ী দখলের অধীনে বাস করতে বাধ্য হবে? এটাই কি শান্তি? এটাই কি ন্যায়বিচার? এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনের শুরুতেই গুতেরেস বলেন, এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট কূটনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও অসংখ্য প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে টিকে আছে, তবে এটিকে নিরসন করা সম্ভব। এটি অনিবার্য নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে এটি সমাধানযোগ্য।
তিনি আহ্বান জানান, এই সম্মেলন যেন কেবল কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব পদক্ষেপের সূচনা করে, দখলদারিত্ব শেষ করে দুই-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত দুটি প্রস্তাব অনুযায়ী এই তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্র, পর্যবেক্ষক ও আঞ্চলিক অংশীদাররা অংশ নিচ্ছেন। এতে প্লিনারি অধিবেশন ও বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক গোলটেবিল বৈঠকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, মানবিক সহায়তা, পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
গাজায় মানবিক সংকট নিয়ে গুতেরেস বলেন, ৭ই অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলাকে তিনি তীব্রভাবে নিন্দা করলেও, ইসরাইলের প্রতিক্রিয়ায় যে ব্যাপক ধ্বংস ঘটেছে, তা নজিরবিহীন। “গাজা একের পর এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত, প্রায় পুরো জনসংখ্যা বারবার বাস্তুচ্যুত এবং অনাহারের ছায়া সকলের উপর ভর করে আছে।”
তিনি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, অবৈধভাবে আটক সকল ব্যক্তির নিঃশর্ত মুক্তি এবং মানবিক সহায়তার পূর্ণ প্রবেশাধিকার দাবি করেন। তিনি বলেন, “এসব শান্তির পূর্বশর্ত নয়-এসবই শান্তির ভিত্তি।”
শেষ বক্তব্যে গুতেরেস বলেন, “এই সংঘাত আর পরিচালনা করে রাখা যাবে না-এটি সমাধান করতে হবে। আমরা পারফেক্ট পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে পারি না, আমাদের সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। শান্তি স্বপ্ন নয়, বাস্তব হোক- ফিলিস্তিনিদের জন্য, ইসরাইলিদের জন্য, মধ্যপ্রাচ্যের জন্য, বিশ্বের জন্য।”
উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ফিলেমন ইয়াংও গাজা যুদ্ধ এবং বৃহত্তর সংকট নিয়ে উদ্বেগ জানান। তিনি বলেন, “এইভাবে আর চলতে পারে না। এখনই সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়, আর কোনো বিলম্ব বা অজুহাত চলবে না।”
এদিকে ফ্রান্স আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে, ফলে চীন ও রাশিয়ার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে তারা তৃতীয় দেশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরফলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হবে একমাত্র দুটি স্থায়ী সদস্য যারা এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, যা এই ইস্যুতে তাদের আরও একঘরে করে তুলবে।
যদিও এই সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না, তবে এটি বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভাজনকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের সিদ্ধান্তকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “ওর কথার কোনো গুরুত্ব নেই। এতে কিছুই বদলাবে না।”
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার গাজার মানবিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তবে তিনি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির বিষয়টি একটি যুদ্ধবিরতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রত্ব ফিলিস্তিনিদের একটি অখণ্ড অধিকার। একটি যুদ্ধবিরতি আমাদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”