Image description

বিশ্বের ইতিহাসে সব থেকে নিরাপদ ও দ্রুত ভ্রমণের বাহন হিসেবে বিমান একটি পরিচিত নাম। যদিও, পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ কোনো যানবাহন নেই কোথাও। তবে, সড়কে চলাচলকৃত বাহনের তুলনায় বিমানের দুর্ঘটনার হার কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অত্যধিক।

 

সম্প্রতি ভারতে একটি মেডিকেল কলেজে যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২৯৪ জন নিহত হন। বিমানটিতে থাকা মোট আরোহীর মধ্যে মাত্র একজন বেঁচে ফিরতে পেরেছেন। এছাড়া চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে মাঝ–আকাশে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ও সামরিক হেলিকপ্টারের মধ্যে সংঘর্ষের পর নদীতে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৬৭ আরোহীর সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

অর্থাৎ দুর্ঘটনাকবলিত বিমানে কেমন সদস্য রয়েছে এবং বিমানটি কোথায় বিধ্বস্ত হচ্ছে—এর ওপর নির্ভর করে কেমন ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানি ঘটতে পারে। এদিক থেকে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানির পরিমাণ অনেকটা সীমিত থাকে। যুদ্ধবিমানে পাইলট ছাড়া আর কেউ থাকেন না, আবার যুদ্ধবিমান যাত্রীবাহী বিমান থেকে অনেকটা ছোটো হওয়ায় এটি বিধ্বস্ত হলে খুব কম স্থানজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রাণহানির সংখ্যাও তুলনামূলক অনেক কম থাকে।

তবে, সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশের উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসের একটি ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ পর্যন্ত পাইলটসহ ৩১ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। মূলত শ্রেণিকক্ষে থাকা স্কুল শিক্ষার্থীদের উপর বিধ্বস্ত হওয়ায় এত সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

মাইলস্টোন কলেজে বিধ্বস্ত এফ-৭ যুদ্ধবিমান।

মাইলস্টোন কলেজে বিধ্বস্ত এফ-৭ যুদ্ধবিমান।

 

যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে এত ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও এ ধরনের হতাহতের ঘটনা বিরল। বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদেন—

 

বাংলাদেশে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের উল্লেখযোগ্য ঘটনা
২১ জুলাই, ২০২৫ (এফ-৭ বিজিআই): ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে প্রশিক্ষণের সময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলটসহ ৩১ জনের করুণ মৃত্যু হয়। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুল পড়ুয়া শিশু। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের কারণে সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা।

আরও এফ-৭ মডেলের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর টাঙ্গাইলে রকেট ফায়ারিং অনুশীলনের সময় বিধ্বস্ত হলে পাইলট নিহত হন। ২০১৫ সালের ২৯ জুন পতেঙ্গা উপকূলেও এ ধরনের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়, নিহত হন পাইলট। ২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের পাহাড়িয়া গ্রামে একটি এফ-৭ মডেলের যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে নিহত হন পাইলট। এছাড়া ২০০৫ সালের ৭ জুন উত্তরায় বহুতল ভবনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এ ধরনের একটি যুদ্ধবিমানের।

 

কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে বিধ্বস্ত হওয়া ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান।

কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে বিধ্বস্ত হওয়া ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান।

 

আরও যত যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: বাংলাদেশে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান হিসেবে মিগ ২৯ এবং এফ-৭ কেই ধরা হয়। তবে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ট্রেইনার এয়ারক্যাফ্টক। ১৯৯৩ সালের পর থেকে সব থেকে বেশি ১০-এর অধিক পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে ৪টি ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৯ মে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় এ ধরনের একটি বিমান বিধ্বস্ত হলে পাইলট নিহত হন।

যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে হতাহতে এগিয়ে যেসব দেশ
ইউক্রেনে এসইউ-২৭ বিধ্বস্ত: ২০০২ সালের ২৭ জুলাই ইউক্রেনের লভিভের স্কনিলিভ বিমানঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত এক এয়ার শোতে একটি রাশিয়ান নির্মিত (Sukhoi Su-27UB) যুদ্ধবিমান কসরত বা শক্তি প্রদর্শনের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জনতার ভিড়ের মধ্যে আছড়ে পড়ে।

 

দর্শকের উপর বিধ্বস্ত হয় এসইউ-২৭ যুদ্ধবিমান।

দর্শকের উপর বিধ্বস্ত হয় এসইউ-২৭ যুদ্ধবিমান।

 

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় অন্তত ৭৭ জন নিহত এবং ৫ শতাধিক মানুষ আহত হন। পরে এই সংখ্যা ৮৫ বলে উল্লেখ করা হয়। দুই পাইলট সফলভাবে ইজেক্ট করে বেঁচে গেলেও পরে তাদের বিচার করে একজনকে ১৪ বছরের এবং অপরজনকে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

জার্মানিতে যুদ্ধবিমানের সংঘর্ষ: ১৯৮৮ সালের ২৮ আগস্ট পশ্চিম জার্মানির রামস্টেইন বিমানঘাঁটিতে আয়োজিত এক এয়ারশোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে, যা ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী বিমান প্রদর্শনী বিপর্যয় হিসেবে পরিচিত। ইতালিয়ান বিমানবাহিনীর তিনটি (Aermacchi MB-339PAN) যুদ্ধ প্রশিক্ষণ বিমান একটি জটিল ফর্মেশনে উড়ন্ত অবস্থায় একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

 

জার্মানিতে ৩টি যুদ্ধবিমানের সংঘর্ষে একটি দর্শকের মাঝে আছড়ে পড়ে।

জার্মানিতে ৩টি যুদ্ধবিমানের সংঘর্ষে একটি দর্শকের মাঝে আছড়ে পড়ে।

 

 

এর মধ্যে একটি বিধ্বস্ত হয়ে সরাসরি দর্শকসারিতে আছড়ে পড়ে এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিস্ফোরণ ঘটে। এই ঘটনায় ২ পাইলটসহ অন্তত ৭০ জন দর্শক নিহত হন এবং আহত হন আরও তিন শতাধিক মানুষ।

যুক্তরাজ্যে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা: ১৯৫২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের ফার্নবোরো এয়ারশোতে (de Havilland DH.110) একটি জেট ফাইটার বিমান ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হয়। উচ্চগতির অ্যারোবেটিক প্রদর্শনের সময় মাঝ আকাশে বিমানটির কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং দর্শকদের ওপর ছিটকে পড়ে। দুর্ঘটনায় পাইলট ও ন্যাভিগেটরসহ মোট ৩১ জন প্রাণ হারান।

তুরস্কে বিমান বিধ্বস্ত: ১৯৮১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তুরস্কের প্যাঙ্কারকয় এলাকায় একটি তুর্কি এফ-৫এ ফাইটার জেট বিমান ভেঙে পড়ে। বিমানটি ন্যাটোর শরৎকালীন মহড়ার প্রস্তুতি হিসেবে একটি সামরিক শিবিরের উপর ডাইভিং রান অনুশীলন করছিল।

 

এফ সিরিজের একটি বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমান।

এফ সিরিজের একটি বিধ্বস্ত যুদ্ধবিমান।

 

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিমানটি সেনাদের  ওপর আছড়ে পড়ে এবং এতে পাইলটসহ অন্তত ৩০ জন সেনা নিহতের খবর পাওয়া যায়। যদিও, এ সংখ্যা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। ধারণা করা হয়, হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি, যা লোকচক্ষুর আড়াল করা হয়েছে।