
প্রচণ্ড রোদ এবং তপ্ত বাতাসের মধ্যেও, বারো বছর বয়সী দিমিত্রি, এটি তার আসল নাম নয়, কঙ্গোর গোমা অঞ্চলে একটি অনানুষ্ঠানিক বসতি বিরেরেতে তার মায়ের লোহার পাত দিয়ে তৈরি বাড়িটিতেই লুকিয়ে থাকে।
"তার কোঁকড়ানো চুল এবং অপেক্ষাকৃত হালকা রঙের ত্বকের জন্য অন্য শিশুরা তাকে যেভাবে উত্যক্ত করে, সেটার মুখোমুখি হতে চায় না সে," জানুয়ারিতে এম টুয়েন্টি থ্রি বিদ্রোহীদের হাতে গোমার পতনের আগে বিবিসির সাথে কথা বলছিলেন তার মা, কামাতে বিবিচে।
"সে (দিমিত্রি) রাশিয়ান, তবুও সে হয়তো তার আসল ঐতিহ্যের সাথে কখনও জীবনযাপন করবে না," কামাতে বলেন।
দিমিত্রি হচ্ছে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে জাতিসংঘের সংস্থা অর্গানাইজেশন স্ট্যাবিলাইজেশন মিশনের (এমওএনইউএসসিও) এক বেদনাদায়ক উত্তরাধিকারের স্মৃতিচিহ্ন।
কঙ্গোতে ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে শান্তিরক্ষী মোতায়েনের পর থেকেই মিশনটি নারীদের যৌন শোষণ এবং নির্যাতনের ব্যাপক অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে।
কামাতেকে তার বিছানার নীচে লুকানো একটি ধুলোমাখা বাক্স বের করে আনার আগে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়।
বাক্সটির ভিতরে তার কাছে থাকা ইউরি'র স্মৃতি-বিজরিত একমাত্র সম্বল - একটি জীর্ণ সামরিক টুপি এবং তাদের দুজনের একসাথে তোলা একটি পুরানো ছবি। ইউরি দিমিত্রির বাবা বলে উল্লেখ করেন কামাতে।
এক রাতে বাইরে বেরিয়ে ইউরির সাথে কামাতের দেখা হয় এবং ইউরির শান্ত স্বভাব কামাতেকে আকৃষ্ট করে। এরপর তিন মাস সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে।
"'সে অন্য পুরুষদের মতো ছিল না। সে আমাকে সত্যিই ভালোবাসতো এবং আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করতো। সময়টা ছিল আমার জীবনের সেরা তিন মাস," স্মৃতিচারণ করেন কামাতে।
স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা অনেক শান্তিরক্ষীর মতো ইউরিও তার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে খুব কম তথ্যই প্রকাশ করেছিল।
"সে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ছিল," কামাতে বলেন।
"সে যখন জানতে পারে যে আমি গর্ভবতী, আমার ও আমার সন্তানের যত্ন নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু তারপর সে কোনও কিছু না বলেই অদৃশ্য হয়ে যায়, যেন আমরা তার কেউ নই," কামাতে বলেন।
কামাতে আরও বলেন, ইউরির রাশিয়ান সঙ্গীর সাথে যোগাযোগ করার কোনও উপায় নেই তার, কারণ ইউরি যে ফোন নম্বরটি দিয়েছিল সেটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
ক্ষমতার অপব্যবহার
যদিও কামাতে স্বেচ্ছায় এই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন, ২০০৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত একটি প্রস্তাবের অধীনে, এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন শোষণমূলক বলেই বিবেচিত হয়।
এই নীতিটি জাতিসংঘের কর্মী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্নিহিত ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, যার আওতায় যৌন সম্পর্ককে শোষণমূলক মনে করা হয়, এমনকি যদি তা সম্মতিক্রমেও হয়ে থাকে।
এই প্রস্তাবে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে শান্তিরক্ষীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পর এ ধরনের অপরাধের দায়ে জবাবদিহিতার আওতায় এনে ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আহ্বান জানায়।
কামাতের প্রেমিকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে, এমওএনইউএসসিও মুখপাত্র এনডে লো বিবিসি রাশিয়াকে বলেন যে, তাদের মিশনে "শুধুমাত্র কয়েকজন পুলিশ অফিসার এবং স্টাফ অফিসার সদর দপ্তরে কাজ করেন"।
তিনি বলেন যে মিশন "আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে" ২০১২ সালে দায়িত্ব পালনকারী নির্দিষ্ট রাশিয়ান অফিসারদের রেকর্ড বা তাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে না।
বিবিসি রাশিয়ান ভাষার সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য মাধ্যমে ইউরিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাকে খুঁজে পায়নি।

ছবির উৎস,Getty Images
গুরুতর অভিযোগ
খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে নিতে চাওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সরকারি বাহিনীর লড়াই চলার কারণে পূর্ব কঙ্গো কয়েক দশক ধরেই সংঘাতের সম্মুখীন।
জানুয়ারিতে, রুয়ান্ডা-সমর্থিত এম টুয়েন্টি থ্রি বিদ্রোহীদের হাতে গোমার পতন ঘটে। কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, জঙ্গিরা শহরটি দখল করার সময় লড়াইয়ে প্রায় সাত হাজার মানুষ মারা যায়।
জাতিসংঘ ধারণা করছে যে, বর্তমানে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ সেখানে বাস্তুচ্যুত, যা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি সংকটগুলির একটি উদাহরণ।
বহু মানুষ চরম দারিদ্র্য এবং খাদ্য, পানীয় জল আর আশ্রয়ের মতো মৌলিক চাহিদার অভাবে রয়েছে, যার ফলে নারীরা নানা রকম শোষণের ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিবিসি যখন মারিয়া মাসিকা (এটি তার আসল নাম নয়) এর সাথে কথা বলেছিল, তখন তিনি সবেমাত্র শহরের উত্তরে অবস্থিত যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর সাকে থেকে গোমায় পৌঁছেছেন।
সেখানে সরকারি সৈন্যরা বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করলেও অবশেষে পরাজিত হয়েছিল। মারিয়া তখনও দৃশ্যত কেঁপে উঠছিলেন – কারণ তীব্র গুলির শব্দে তিনি তখনও বেশ হতবাক অবস্থায় ছিলেন।
'সে জানতো আমি প্রাপ্তবয়স্ক নই'
মাসিকা তার আট বছর বয়সী মেয়ে কুইনকে দেখতে গোমা এসেছিলেন, কুইন নিরাপত্তার জন্য তার নানির সাথে এই শহরে থাকে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে, মিনুগি ঘাঁটির কাছে নিযুক্ত একজন দক্ষিণ আফ্রিকান শান্তিরক্ষীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মাসিকা।
"সে জানতো আমি প্রাপ্তবয়স্ক নই," মাসিকা বলেন।
"সে ঘাঁটির কাছে একটি বাড়ি ভাড়া করেছিল এবং যখনই তার ডিউটি থাকতো না, সে আমার সাথে দেখা করতে আসতো।"
কুইনের জন্মের পর, সেই শান্তিরক্ষীর সাথে আর যোগাযোগ করা যায়নি, মাসিকাকে একলা রেখেই ছেড়ে চলে যায় সে।
মেয়ের ভরণপোষণের জন্য মরিয়া হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখন যৌনকর্মী হিসেবেই কাজ করেন মাসিকা।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী এবং স্থানীয়দের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে, দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় যে তারা অভিযোগগুলিকে গুরুত্ব সহকারে নেয়।
"মিশন এলাকায় সামরিক আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে যৌন শোষণ এবং নির্যাতনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, অন্যান্য শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে," বাহিনীর মুখপাত্র সিফিওয়ে লামিনি বলেন।

কঙ্গোলিজ ফ্যামিলি ফর জয়, যেটি পরিত্যক্ত এবং এতিম শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, সেখানে কমপক্ষে পাঁচটি শিশু রয়েছে যাদের বাবা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য। এই শিশুদেরকে তাদের মায়েরা পরিত্যাগ করেছে বলেও জানা গেছে।
কেন্দ্রটির পরিচালক নেলি কাইয়া বলেন, "আমাদের অংশীদারদের সাহায্যে, আমরা প্রায় ২০০ জন নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে সহায়তা প্রদান করে থাকি, যারা এমওএনইউএসসিও কর্মীদের যৌন শোষণের শিকার হয়েছে।"
"তাদের অনেকেই বেঁচে থাকার জন্য পতিতাবৃত্তি অবলম্বন করায় তাদের নিজ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তীব্র নিন্দার সম্মুখীন হয়। আর এটা প্রায়ই তাদের সন্তানদেরকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য করে," তিনি বলেন।
নারী অধিকার গোষ্ঠী সোফেপাডির জাতীয় সমন্বয়কারী স্যান্ড্রিন লুসামাবা বিবিসিকে বলেন, যৌন শোষণকারীদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের সরাসরি কর্তৃত্বের অভাবের অর্থ হচ্ছে, অনেকেই মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তিনি বলেন, অনেক সদস্য রাষ্ট্র তাদের সৈন্যদের বিচারের জন্য সহযোগিতা করে না।
কঙ্গোতে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শান্তিরক্ষা এবং বিশেষ রাজনৈতিক মিশনের সঙ্গে যৌন নির্যাতন ও শোষণের অভিযোগের সম্পৃক্ততা বাড়ছে।
দেখা গেছে, ২০২৩ সালে শান্তিরক্ষা এবং বিশেষ রাজনৈতিক মিশনে ১০০টি অভিযোগ করা হয়েছিল, ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৯টি। জাতিসংঘের মতে, এই ঘটনাগুলিতে ১৪৩ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে ১১৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ২৮ টি শিশু।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ দ্য কঙ্গোতে ১০০টি অভিযোগের মধ্যে ৬৬টির জন্য দায়ী করা হয় জাতিসংঘের মিশনকে, এতে মিশনের মধ্যে জবাবদিহিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
জিরো-টলারেন্স নীতি
"যখন যৌন শোষণ এবং নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়, তখন তথ্য মূল্যায়ন করা হয় এবং সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়," বলেন এমওএনইউএসসিও মুখপাত্র এনডে লো।
"যে কোনও কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তাকে আমাদের সিস্টেমে চাকরি (বেসামরিক) বা মোতায়েন করা থেকে নিষিদ্ধ করা হবে।"
মিশনটি বলছে যে তারা ভিকটিম অ্যাসিস্ট্যান্স ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ব্যবস্থা করে ভুক্তভোগী আর তাদের সন্তানদেরকে ক্ষমতায়িত করে।
কিন্তু কামাতে এবং মারিয়ার মতো অনেকেই বলেছেন যে, তারা এই সহায়তা সম্পর্কে জানতেন না; অন্যদিকে, অনেকেই মানসিকভাবে এতোটাই বিপর্যস্ত যে তারা এখনও ন্যায়বিচার চাইতে পারেননি।