Image description

আমি ১৯৯০-এর দশকের যুদ্ধে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ অবরুদ্ধ অবস্থায় বেঁচে ছিলাম। স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার ৩০ বছর পর, ফিলিস্তিনিদের বলা হচ্ছে সেই একই ভাঙা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস রাখতে।

২০০৩ সালের ১১ জুলাই, বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোর রাজপথে বিশাল পোস্টার ঝুলে পড়েছিল—এক তরুণী ক্যামেরার দিকে সোজা তাকিয়ে আছে।

যাতে ইংরেজিতে হাতে লেখা ছিল-

“No teeth…? A moustache…? Smell like shit…? Bosnian girl!”

(অর্থাৎ ‘দাঁত নেই...? গোঁফ...? মলের গন্ধ...? বসনিয়ান মেয়ে!’)

পোস্টারের নিচে ব্যাখ্যামূলক লেখা ছিল- ‘১৯৯৪/৯৫ সালে স্রেব্রেনিৎসার পোটোচারিতে ডাচ সেনাবাহিনীর ব্যারাকের দেয়ালে এক অজানা ডাচ সেনার লেখা গ্রাফিতি। এই সেনারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর (UNPROFOR) অংশ হিসেবে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় মোতায়েন ছিল। তারা ছিল স্রেব্রেনিৎসা ‘নিরাপদ এলাকার’ দায়িত্বপ্রাপ্ত’।

এই চিত্রকর্মটি শিল্পী সেইলা কামেরিচ তৈরি করেছিলেন স্থানীয় আলোকচিত্রী তারিক সামারাহ-র একটি ছবি ব্যবহার করে। পরে এটি বিশ্বজুড়ে প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

 

 

গাজায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা কী করবে?

এর তিন দশক পর যখন আমি শুনি যে, গাজা ও ফিলিস্তিনের অন্যান্য অংশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী পাঠানোর আহ্বান উঠছে, তখন আমার মনে হয়—এর কোনো বাস্তব ফল আসবে না।কেননা আমি জানি, অধিকার বঞ্চিত, অবরুদ্ধ এবং জীবনের মৌলিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত মানুষের জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী কখনোই আশার প্রতীক হতে পারে না।

স্রেব্রেনিৎসার স্মৃতি: জাতিসংঘের বিশ্বাসঘাতকতা 

১৯৯৫ সালের ৩ জুলাই সকালে যুদ্ধাপরাধী রাতকো ম্লাদিচ-এর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী স্রেব্রেনিৎসায় প্রবেশ করে। তিন বছরের অবরোধের পর হাজার হাজার মানুষ জাতিসংঘের ঘাঁটির (পোটোচারি) দিকে ছুটে আসে। তখন তাদের বিশ্বাস ছিল যে, ডাচ শান্তিরক্ষীরা তাদের রক্ষা করবে।

সেই ঘাঁটিতে ৬,০০০ জনেরও বেশি মানুষ গাদাগাদি করে ঢুকে পড়েছিল। আশেপাশে আরও ২০,০০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল।

৮ দিন পর, ১১ জুলাই, ম্লাদিচ-এর বাহিনী পুরুষদের নারীদের থেকে আলাদা করতে শুরু করে। পরে প্রায় ২৫,০০০ মানুষকে বাসে তুলে অন্যত্র পাঠানো হয়।

আর ৮,০০০-এর বেশি পুরুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের অনেকের দেহাবশেষ পরে কেবল এক টুকরো হাড় হিসেবে উদ্ধার হয়।

 

 

জাতিসংঘ শুধু নিজ সেনাদেরই বাঁচাতে চেয়েছিল

পোটোচারিতে জাতিসংঘ ঘাঁটির মধ্যে গণহত্যা সংঘটিত হলেও জাতিসংঘ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা নতুন সেনা পাঠানোর অনুরোধ করেনি, অস্ত্রও ব্যবহার করেনি, এমনকি মানুষ বাঁচানোর চেষ্টাও করেনি।

তাদের একমাত্র উদ্বেগ ছিল—ডাচ সেনা ও আন্তর্জাতিক কর্মীদের কীভাবে নিরাপদে সরানো যায়।

পরে যখন ২০০১ সালে সাধারণ মানুষ ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে পেরেছিল, তখন দেওয়ালে ডাচ সেনাদের লেখা অবমাননাকর গ্রাফিতি পাওয়া যায়—ঠিক সেই ‘Bosnian Girl’ আর্টে ব্যবহৃত লাইনটি।

‘নিরাপদ’ এলাকা, নাকি ‘জাতিগত নিধন’?

১৯৯৫ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক রিপোর্টে জানায়, ‘নিরাপদ এলাকা ঘোষণা ভালো উদ্দেশ্যে হলেও বাস্তবে তা পরিণত হয়েছিল জাতিসংঘ-প্রশাসিত জাতিগত নিধনে’।

এক পর্যায়ে স্রেব্রেনিৎসার নারীরা জাতিসংঘ ও ডাচ সেনাদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবি তোলে। তবে ২০০৮ সালে একটি ডাচ আদালত জাতিসংঘের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করে দেয়। কারণ জাতিসংঘের বিচার-অযোগ্যতা রয়েছে।

পরে ডাচ সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। তবে ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ডাচ রাষ্ট্র মাত্র ১০ শতাংশ দায়িত্ব স্বীকার করতে বাধ্য—৩৫০ জনের মধ্যে যাদের হত্যা রোধ করার ১০ শতাংশ সম্ভাবনা ছিল।

গাজার ভাগ্যেও ঘটবে একই ঘটনা!

চলমান পরিস্থিতিতে ইসরাইলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের মোতায়েন আসলে একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে—যেন যুদ্ধ দুই পক্ষের মধ্যে সমানভাবে চলছে। আসল ঘটনা তো সেটা নয়!

এটি মূলত দখলদারিত্ব, বর্ণবাদ, ভূমি দখল, বন্দিত্ব ও নিরবচ্ছিন্ন সহিংসতার ইতিহাসকেই আড়াল করে।

গাজায় এখন যা ঘটছে, তা নির্মম গণহত্যার চূড়ান্ত রূপ। আর এর জন্য যে ধরনের সমাধান দরকার, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী সেই সমাধান নয়।

‘প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে—পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’

গাজায় তথা ফিলিস্তিনে প্রকৃত সমাধান আসবে অভ্যন্তরীণ ভুক্তভোগী মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থেকে। বাইরের তথাকথিত ‘উন্নত বিশ্বের’ পক্ষ থেকে নয়।

কিন্তু যতক্ষণ না গাজায় সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ঘটে, শান্তিরক্ষী পাঠানো বা অন্য যে কোনো প্রস্তাবই আসলে সহিংসতাকে দীর্ঘায়িত করবে, বন্ধ করবে না।

আর এতে করে ইসরাইলকে আরও হত্যার ছাড়পত্র দেওয়া হবে, আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য।

(মিডল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত নিজারা আহমেতাসেভিচের লেখা অবলম্বনে)