
সম্প্রতি ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথি আনসারুল্লাহর হামলায় লোহিত সাগরে একটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। এ ঘটনায় ১০ জনকে উদ্ধার করা হলেও নিহত হয়েছেন অন্তত তিনজন।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৭০টি বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও ছোট নৌকা দিয়ে হামলা চালিয়েছে তারা। চারটি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, একটি জাহাজ দখল এবং অন্তত সাতজন ক্রুকে হত্যা করা হয়েছে।
হুথিরা মূলত ইরান-সমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা গাজার হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহর মতোই ইসরাইলবিরোধী ‘এক্সিস অব রেসিস্টেন্স’ বা ‘প্রতিরোধ অক্ষের’ অংশ।
হুথি আনসারুল্লাহ কারা?
ইয়েমেনের সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিম জায়েদিদের পক্ষে কথা বলা সশস্ত্র রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী হুথি আনসারুল্লাহ।
তাদের দাবি, ইরান-নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরোধ অক্ষ’-এর অংশ তারা। ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও বৃহত্তর পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এই অক্ষে হামাস ও হিজবুল্লাহর মতো মধ্যপ্রাচ্যের আরও সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে তারা আনসারুল্লাহ (আল্লাহর পক্ষ) নামে পরিচিত। নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া গোষ্ঠীটির নাম এসেছে তাদের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন আল-হুথির নাম থেকে। তার ভাই আবদুল মালিক আল-হুথি তাদের বর্তমান নেতা।
২০০০ সালের শুরুর দিকে হুথিরা ইয়েমেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ-এর বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহ করে। তারা দেশটির উত্তরাঞ্চলে নিজেদের এলাকায় সালেহর কর্তৃত্ববাদী শাসনের বাইরে আরও স্বায়ত্তশাসন চাইছিল।
২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় হওয়া গণবিক্ষোভ প্রেসিডেন্ট সালেহকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। সে সময় তার ডেপুটি আব্দরাব্বুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।
হাদির শাসনকালে হুথিরা ক্ষমতাচ্যুত সালেহ ও তার অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে জোট গঠন করে এবং উত্তরাঞ্চলের শাদা প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং রাজধানী সানা দখল করে। ২০১৫ সালে হুথিরা পশ্চিম ইয়েমেনের বড় একটি অংশ দখল করে এবং প্রেসিডেন্টকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে।
প্রতিবেশী সৌদি আরবের শঙ্কা ছিল যে, হুথিরা পুরো ইয়েমেন দখল করে একে ইরানের প্রভাবাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করবে।
এ কারণে আরব দেশগুলোর একটি জোট গঠন করে সৌদি আরব ইয়েমেন যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু বহু বছরের বিমান হামলা ও স্থলযুদ্ধ সত্ত্বেও অধিকৃত অধিকাংশ এলাকা থেকে হুথিদের সরানো যায়নি।
বর্তমানে সৌদি আরব হুথিদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তির চেষ্টা করছে। আর ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি অস্ত্রবিরতি কার্যকর রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৪০ লক্ষের বেশি মানুষ।
হুথিদের সাহায্য করে কারা? কীভাবে অস্ত্র পায় তারা?
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, জাহাজে হামলা চালাতে হুথিদের সহায়তা করেছে ইরান। তবে ইরান এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ইরান হুথিদের কাছে ড্রোন, ক্রুজ এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা ধরনের অস্ত্র পাচার করেছে।
তারা বলছে, সৌদি আরব ও দেশটির মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর হামলায় এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে।
হুথিদের কাছে অস্ত্র সরবরাহের কথা অস্বীকার করেছে ইরান। দেশটির দাবি, কেবল রাজনৈতিকভাবে তারা হুথিদের সমর্থন করে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. এলিজাবেথ কেন্ডাল বলছেন, ইরানি অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং গোয়েন্দা সহায়তা ছাড়া হুথিরা এই পর্যায়ের কাজ করতে পারতো না। তবে হুথিদের ওপর ইরানের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্পষ্ট নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইটালিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল স্টাডিজের মতে, ইরান ইয়েমেনে ড্রোন তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে হুথিদের সহায়তা করেছে।
হুথিরা লেবাননের ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কাছ থেকেও সামরিক পরামর্শ ও সহায়তা পেয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়েস্ট পয়েন্ট মিলিটারি একাডেমির যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমব্যাটিং টেরোরিজম সেন্টার।
২০২৫ সালের জুন মাসে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় অতর্কিত হামলা চালায় ইসরাইল। এর জবাবে ইরান ইসরাইলের ওপর বিমান হামলা চালায়।
মার্কিন মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে ১২ দিনের এই যুদ্ধ শেষ হয়। হামলার ফলে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সম্ভবত উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইসরাইল লেবাননের হিজবুল্লাহর উপর একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। ইরান এবং হিজবুল্লাহর ওপর ইসরাইলের আক্রমণ তাদের হুথি মিত্রদের যে কোনো সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ইসরাইলের উপর বারবার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার জবাবে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ইয়েমেনের হুথি-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী বিমান হামলা চালায়।
হুথিরা কী ধরনের হামলা চালিয়েছে?
গাজায় ইসরাইলি সামরিক অভিযানের পাল্টা জবাবে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুথিরা ইসরাইলের ওপর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো শুরু করে। এমনকি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলের প্রধান বিমানবন্দর লক্ষ্য করে তীব্র ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বেশিরভাগ হামলাই প্রতিহত করেছে ইসরাইল। তবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে একটি ড্রোন তেল আবিবে আঘাত করে। এতে একজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। এছাড়া নভেম্বর থেকে ইয়েমেন উপকূলের কাছে বাণিজ্যিক জাহাজেও হামলা চালাতে শুরু করে হুথিরা।
গত ১৯ নভেম্বর লোহিত সাগরে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনতাই করে তারা। এছাড়াও লোহিত সাগর ও অ্যাডেন উপসাগরে প্রায় ১০০টি জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা বহনকারী ড্রোন বোট দিয়ে হামলা চালিয়েছে হুথিরা।
২০২৪ সালের মার্চে হুথিদের এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বার্বাডোসের পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ ট্রু কনফিডেন্সের তিনজন ক্রু নিহত হন।
গোষ্ঠীটির দাবি, কেবল ইসরাইলি মালিকানাধীন, পতাকাবাহী বা পরিচালিত অথবা ইসরাইলের বন্দরের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করা জাহাজগুলোকেই তারা টার্গেট করে। তবে হামলা চালানো অনেক জাহাজের সঙ্গেই ইসরাইলের কোনো সম্পর্ক নেই।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই অঞ্চলের মার্কিন জাহাজের ওপর হুথিরা জটিল হামলা চালায় বলে জানায় দেশটির নৌবাহিনী। যদিও সব ক্ষেপণাস্ত্রই গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এর জবাবে ইয়েমেনে হুথি স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। পেন্টাগনের মতে, স্থাপনাগুলোতে জাহাজে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের যন্ত্রাংশ ছিল।
টানা সাত সপ্তাহের মার্কিন বিমান হামলার পর গত মে মাসে হুথিরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছায়। তবে এই চুক্তিতে ইসরাইলের ওপর হামলা বন্ধের বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না বলে জানায় হুথিরা। ইয়েমেনে একাধিক দফায় পাল্টা হামলা চালায় ইসরাইল।
ম্যাজিক সিস এবং ইটার্নিটি সি নামের জাহাজ দুটি ছিল লাইবেরিয়ান পতাকাবাহী ও গ্রিক পরিচালিত, যা কি না হুথিদের ভাষ্যমতে, ইসরাইলের দিকে যাচ্ছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হামলাগুলোর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, হামলাগুলো ‘ইরান-সমর্থিত হুথিরা সামুদ্রিক চলাচলের স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য কী ধরনের হুমকি তৈরি করছে, তার প্রমাণ’। আন্তর্জাতিকভাবে জাহাজে পরিবহন করা মোট পণ্যের প্রায় ১৫ শতাংশ লোহিত সাগর হয়ে যায়। ফলে এমন পরিস্থিতি বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে।
হুথিরা ইয়েমেনের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করে?
হুথিরা ইয়েমেনের রাজধানী সানা ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে লোহিত সাগরের উপকূলীয় এলাকাও রয়েছে।
এই অঞ্চলগুলোতেই ইয়েমেনের বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করে। কর আদায় করে ও মুদ্রা ছাপিয়ে সেখানে হুথিরা একটি ডি ফ্যাক্টো সরকার পরিচালনা করে। ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার দক্ষিণাঞ্চলের বন্দরনগরী এডেনে অবস্থান করছে।
২০২২ সালে রাষ্ট্রপতি হাদি যাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে, সেই প্রেসিডেন্সিয়াল লিডারশীপ কাউন্সিলের আট সদস্যই এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা