
প্রবল বৃষ্টিপাতে চারপাশে যখন পানির স্রোত আর ভূমিধসের ধ্বংসযজ্ঞ—তখন একটি ছোট্ট প্রাণ চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিল ঘরের এক কোণে। মাত্র ১১ মাস বয়স, বুঝতেও শেখেনি পৃথিবীর ভাষা। অথচ সে জেনে গেল জীবনের সবচেয়ে নির্মম সত্য—কেউ নেই আর পাশে। মা নেই, বাবা নেই, এমনকি দাদিও।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে হিমাচল প্রদেশের মান্ডি জেলার পাহাড়ি গ্রামে। ভারী বৃষ্টির রাত ছিল সেটা—আকাশ যেন ছিঁড়ে পড়ছিল। পাহাড় থেকে ধেয়ে আসছিল ধস।
তাণ্ডবের এক রাত
সেদিন রাত ১টা। বৃষ্টির পানি ঢুকছিল মান্ডি জেলার বাসিন্দা রমেশ কুমারের ঘরে। বাড়িতে তখন ছিলেন রমেশ, তার স্ত্রী রাধা দেবী, মা পুনম দেবী, আর তাদের একমাত্র সন্তান—মাত্র ১১ মাস বয়সি ছোট্ট কন্যা।
বাড়ির ভেতর পানি ঢুকছিল প্রবলভাবে। রমেশ, রাধা ও পুনম বের হলেন পানি ঠেকাতে, বৃষ্টির ধারা অন্যদিকে সরাতে। হয়তো তারা ভেবেছিলেন একটু কষ্ট করে আবার ফিরে আসবেন মেয়েটার কাছে।
তবে ফিরতে পারেননি। ঠিক তখনই পাহাড় ভেঙে নামে ধস। এক নিমিষে মাটি গিলে নেয় তিনজনকে। ঘরের ভেতরে তখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল শিশুটি।
রাত ২টার দিকে পাশের ঘরের প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। মাটি চাপা পড়া সেই বাড়ির সামনে গিয়ে শুনতে পান হালকা কান্নার শব্দ। ভেতরে গিয়ে দেখেন, শুধু শিশুটি বেঁচে আছে—মাটির ঘরের এক কোণে নিঃসঙ্গ অথচ নিরাপদই ছিল সে।
পরদিন ভোরে শিশুটির চাচা খবর পান। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে প্রায় ১২-১৩ জন মিলে যান ঘটনাস্থলে। কিন্তু তখনও নদীর পানি এত বেশি ছিল যে তারা সেতু পার হতে পারেননি। কিছুক্ষণ পর পানি কিছুটা কমলে শুরু হয় মরদেহ উদ্ধারের অভিযান।
রমেশ কুমারের দেহ পাওয়া যায় ধ্বংসস্তূপের নিচে। কিন্তু এখনও নিখোঁজ রাধা ও পুনম দেবী—শিশুটির মা ও দাদি। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এসআরডিএফ) এখনো তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে।
‘ও আমার ভাইয়ের শেষ চিহ্ন’
শিশুটির চাচা বলেন, ‘শিশুটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য এই ক’দিনে বহু ফোন পেয়েছি। সবাই ওকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা দেব না। ও আমার ভাইয়ের শেষ চিহ্ন। ওকে আমরাই বড় করব।’
হিমাচলের সাম্প্রতিক বিপর্জয়, হাহাকার, তাণ্ডব আর বিষাদের মাঝখানে সেই ১১ মাসের শিশুটি যেন জিজ্ঞেস করে—‘আমি বেঁচে আছি কেন?’ তার উত্তর দিতে পারেন না কেউ। শুধু শিশুটির চাচার প্রতিজ্ঞা—‘ওকে আমরা ভালোবাসায় বড় করব। মা-বাবাহীন হলেও ও কখনো একা হবে না।’
হিমাচলের সর্বশেষ পরিস্থিতি
হিমাচলের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মান্ডি জেলা। জুন মাসের ২০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বর্ষায় এখন রাজ্যজুড়ে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৫০ জনই প্রাণ হারিয়েছেন ভূমিধস, আকস্মিক বন্যা ও ক্লাউডবাস্টের মতো দুর্যোগে।
মান্ডি জেলাতেই মৃত্যু হয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষের। ১৫৬টি সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে শুধুমাত্র এই জেলাতেই। রাজ্যজুড়ে ২৩টি ফ্ল্যাশ ফ্লাড, ১৯টি ক্লাউডবাস্ট ও ১৬টি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে এখন পর্যন্ত।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর সোমবার আবারও সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছে, রাজ্যের ১০টি জেলায় আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।