Image description

গৌতম আদানির সম্পৃক্ততা ভারতের গুজরাট রাজ্যের শহর আহমেদাবাদের সঙ্গে। ভারতের বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী বহুবার লোকসভায় আদানি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, আদানি মোদি সরকারের মাধ্যমে তার ব্যবসায় অসাধারণ সম্প্রসারণ করেছেন এবং পৃথিবীর ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন। মোদিও গুজরাটের। যখন তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন আদানির বিমানটি দারুণভাবে ব্যবহার করতেন। ওই বিমানে চড়েই মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন এবং এরপর আদানির ব্যবসায় চার নয় বরং আট চাঁদ লেগে যায়।

মোদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর সাথে আদানির বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন এবং ২০২৩ সালে ইসরায়েল তাদের সবচেয়ে বড় বন্দর হাইফার ৭০% শেয়ার ১২০ কোটি ডলারের বিনিময়ে আদানি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে। আদানি গ্রুপকে হাইফা পোর্টের ৭০% শেয়ার বিক্রির গল্প ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল, যখন ইসরায়েলের একটি অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেমস আদানি গ্রুপের সাথে মিলিত হয়ে ভারতের শহর হায়দরাবাদে হারমেস ৯০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করে।

আদানি গ্রুপ মোদি সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা পায়। তাই দুই বছরের মধ্যেই ফ্যাক্টরি তৈরি হয়ে যায় এবং উৎপাদনও শুরু হয়। ২০২২ সালের মধ্যে এই ফ্যাক্টরিতে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলি বাহিনী পরীক্ষায় নেয় এবং ফ্যাক্টরির ৮৫% উৎপাদন কিনে নিতে প্রস্তুতি ঘোষণা করে।

হায়দরাবাদ থেকে আদানি গ্রুপ পৌঁছে হাইফায় এবং ইসরায়েলের এই গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের ৭০% শেয়ার কিনে গোটা বিশ্বকে অবাক করে দেয়। এটি শুধু আদানির সাফল্য নয়, ভারতেরও একটি বিশাল সাফল্য ছিল—একদিকে ইরানের শত্রু ইসরায়েলের সাথে ভারতের সেবাপ্রবাহ চালু হয়ে ওঠে, অন্যদিকে আদানি গ্রুপ হাইফা পোর্টের পরিচালনাও গ্রহণ করে।

যখনই হাইফা পোর্টের পরিচালনা আদানির কাছে চলে যায়, তখনই এক মার্কিন যৌথ প্রতিষ্ঠান হেন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে কোটি কোটি ডলারের জালিয়াতি ও কর ফাঁকির অভিযোগ তোলে। রাহুল গান্ধী লোকসভায় ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় এসব অভিযোগের জবাব দাবি করেন। কিন্তু কোথাও থেকে কোনো জবাব আসে না। কিছুদিন পর হাইফা পোর্টের পরিচালনা আদানি গ্রুপকে হস্তান্তরের একটি অনুষ্ঠান হয়, যেখানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বিশেষ অতিথি ছিলেন। সেখানে নেতানিয়াহু গৌতম আদানিকে হেন্ডেনবার্গ রিসার্চের অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আদানি সব অভিযোগই ভিত্তিহীন জানান। নেতানিয়াহু ও আদানির মধ্যে এই আলোচনা অনেকেই শুনে থাকেন। এ সংলাপের বিস্তারিত একটি রুশ পত্রিকা স্পুটনিক (SPUTNIK)-এর ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।

নেতানিয়াহু বলেছেন, আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে আক্রমণ অর্থাৎ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ। কারণ আদানি দুর্বল হলে ইসরায়েলের স্বার্থে প্রভাব পড়বে। তারপর নেতানিয়াহু ইসরায়েলের গোপন সংস্থা মোসাদকে নির্দেশ দেন যে, যারা আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে, তাদের শিক্ষা দেওয়া হবে।

কিছুদিন পর হেন্ডেনবার্গ রিসার্চের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আমেরিকান আদালতে মামলা দায়ের হয়। আদানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উত্তাপনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতারণার তদন্ত শুরু হয় এবং চাপের মুখে  জানুয়ারি ২০২৫-এ হেন্ডেনবার্গ রিসার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রুশ জার্নালের রিপোর্টের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, নেতানিয়াহুর আদেশে মোসাদ রাহুল গান্ধীসহ কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা ও যারা রাহুল গান্ধীকে আদানির বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে আসছিল তাদের ডিজিটাল নজরদারি শুরু করে এবং তাদের সব কারবার অনুসন্ধান করে। এতে আদানি নিশ্চিত ছিলেন যে, নেতানিয়াহু তার শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, এই নেতানিয়াহুই তার নিজের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবেন।

১৩ জুন ২০২৫-এ নেতানিয়াহু ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘোষণা দেন, তখন আদানি কল্পনাও করতে পারেননি যে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হাইফা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তিনি যেই হায়দরাবাদে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছিলেন, তা ইরানে ব্যাপক বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে।

যখন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব ও হাইফার ওপর ধসে পড়তে শুরু করে, আদানির হাত-পা তখন ফুলে উঠতে থাকে। নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন হায়দরাবাদে তৈরি আদানির ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র লেবানন থেকে গাজার মধ্যে যেমন কার্যকর ছিল, ঠিক তেমন ইরানেও হবে। কিন্তু ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়।

ইরানের ক্ষতি হলেও হাইফা পোর্ট ক্ষেপণাস্ত্রবিদ্ধ হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং যখন তার ছবি গাজার ধ্বংসস্তূপের সাথে তুলনা করা হয়, চোখে তফাৎ বোঝা যায় না। ইহুদিরা এমন হাহাকার অনুভব করে যে, হাজার হাজার মানুষ ইসরায়েল ছেড়ে পালাতে শুরু করে।

এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বন্ধু নেতানিয়াহুকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার বিরুদ্ধে হামলার ঘোষণা করেন এবং এরপর একটি সিজফায়ারও ঘোষণা করেন। এখন মার্কিন মিডিয়ায় এই বিতর্ক শুরু হয়েছে: ট্রাম্পের আদেশে হামলা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে কি না? ট্রাম্প প্রশ্ন তোলার জন্য সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি মিথ্যাকারী বলেন, যদিও তিনি ইসরায়েলকে আরও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন।

এখন আর কোনো সংশয় থাকা উচিত নয় যে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সাময়িকভাবে যুদ্ধ বন্ধ হলো, কিন্তু নেতানিয়াহু আরও আক্রমণ থেকে বিরত থাকবেন না। কারণ তিনি মনে করেন ইরান গ্রেটার ইসরায়েলের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

নেতানিয়াহু ও মোদি হায়দরাবাদে আদানির সাথে তৈরি ফ্যাক্টরিতে যে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়েছে, তার লক্ষ্য শুধু ইরান নয়, পাকিস্তানকেও হবে। গত দুই বছরে ভারত ইসরায়েল থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। এই অস্ত্র চীনের বিরুদ্ধে নয় বরং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রস্তুত, কারণ 'অখণ্ড ভারত'-এর পথে পাকিস্তান সবচেয়ে বড় বাধা।

জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওপলিটিক্স ডিরেক্টর মায়ের মাস্রি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছেন: ইরানের পর পরবর্তী লক্ষ্য হবে পাকিস্তান।
২৪ জুন ২০২৫-এ 'মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি' তে মায়ের মাস্রিকে উদ্ধৃত করে একটি বিশদ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের মাধ্যমে ইসরায়েল কেবল পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা শেষ করবে না, পাশাপাশি ভারতকে সহযোগিতা করে সিন্ধকে পাঞ্জাব থেকে আলাদা করবে এবং আজাদ কাশ্মীর অধিকার করে চীনকে গোয়াদার থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।

আহমেদাবাদের ব্যবসায়ী গৌতম আদানির হাইফার ব্যবসা একদিকে ধ্বংস হয়ে গেল, কিন্তু হায়দরাবাদের তার ফ্যাক্টরি এখনো বাঁচছে। যতক্ষণ এই ফ্যাক্টরি নিরাপদ, ততক্ষণ পাকিস্তান নিরাপদ নয়। এই ফ্যাক্টরি গাজার ধ্বংস থেকে ইরান পর্যন্ত ভারী ধ্বংস ছড়িয়েছে এবং এর পরবর্তী লক্ষ্য পাকিস্তান হবে।

[হামিদ মীর পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক। উর্দু দৈনিক জং থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]