Image description
 

গত কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরানে চালানো সামরিক হামলা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়েছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘ওয়াশিংটনের ভাবমূর্তি’ গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 
 
বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ চীন ও রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। ‘একঘরে হয়ে পড়বে’ যুক্তরাষ্ট্র, তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল ও ভারতের মতো দেশগুলো, যাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার নিয়মিত লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা সচিব, সাবেক সিনেটর ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ- নওয়াজের (পিএমএলএন) গুরুত্বপূর্ণ নেতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল কাইয়ুম ইরানের যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি এও বলেন, এ ধরনের কার্যক্রমের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল কাইয়ুম অভিযোগ করেন, ভারত দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে, বিশেষ করে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ ছড়াতে পৃষ্ঠপোষকতা করছে প্রক্সি উপাদান ব্যবহার করে।

প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রের ইরান আক্রমণের পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
উত্তর: যেহেতু কোনো আন্তর্জাতিক আইন এ ধরনের হামলার অনুমতি দেয় না, তাই এই আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পাকিস্তানসহ অনেক দেশই এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে। এটা একেবারেই স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র ‘ইসরায়েলের নির্দেশে’ কাজ করছে। এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে, বর্তমানে কার্যকর কোনো আন্তর্জাতিক আইন নেই। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকারিতা হারিয়েছে। এ অবস্থায় চীন-রাশিয়ার মতো শক্তিগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়বে ইসরায়েল, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারী রাষ্ট্রগুলো।

প্রশ্ন: আমরা কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছি?
উত্তর: আল্লাহ না করুন, এমন কিছু ঘটুক। কারণ, একটি নতুন বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির জন্য ধ্বংসাত্মক হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪–১৯১৮) প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এরপর গঠিত হয় লিগ অব নেশনস, যা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় (১৯৩৯–১৯৪৪), যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয় এবং ৬ থেকে ৭ কোটি মানুষ নিহত হন। এরপর গঠিত হয় জাতিসংঘ। রাষ্ট্রগুলো যদিও জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু বাস্তবে তারা তা মানছে না। সেকারণেই পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কেবল যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তিধর ছিল, এখন অন্তত ৯টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী।

প্রশ্ন: পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি কোথায় সবচেয়ে বেশি?
উত্তর: কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগর, এই অঞ্চলগুলো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধপূর্ণ এলাকা এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর।

প্রশ্ন: ইসরায়েলের ইরান আক্রমণের উদ্দেশ্য কী এবং তারা কি সফল হবে?
উত্তর: সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন, নেতানিয়াহুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখেন না। তার দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে টেনে আনা, যা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইহুদি লবির চাপে পড়ে করেছিলেন। তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো আরব রাষ্ট্রগুলোকে চেপে ধরে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠা করা।

প্রশ্ন: ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক শক্তির তুলনামূলক চিত্র কী?
উত্তর: ইসরায়েল কখনোই ইরানের সমতুল্য নয়। ইরান জনসংখ্যায় ৭ম বৃহত্তম এবং আয়তনে ইসরায়েলের চেয়ে ৭০ গুণ বড়। প্রকৃত তুলনা হওয়া উচিত ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে, কারণ ইসরায়েল মূলত যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রক্সি মাত্র।

প্রশ্ন: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
উত্তর: পাকিস্তান সবসময়ই বলে আসছে, আন্তর্জাতিক বিরোধ কূটনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া উচিত। ভারতের পাকিস্তানের ওপর আগ্রাসন, ইসরায়েলের ইরান আক্রমণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ত হওয়া, সবই নিন্দনীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একজন হিটলার আর একটি পারমাণবিক শক্তি ছিল। আজ আমাদের সামনে দুই হিটলার নেতানিয়াহু ও মোদি এবং ৯টি পারমাণবিক রাষ্ট্র আছে। পাকিস্তান ভারতের পর পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করেছে, তবে দেশটি সবসময়ই পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

প্রশ্ন: ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির যুক্তরাষ্ট্র সফরে এত উষ্ণ অভ্যর্থনা কেন?
উত্তর: জাতির দোয়া এবং তার অসাধারণ নেতৃত্বে তিনি ভারতের বড় সামরিক বাহিনীকে হারিয়েছেন। এতে পাকিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থান জোরদার হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমন্ত্রণ এসেছে। পাকিস্তান অঞ্চলিকভাবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র, যা যুক্তরাষ্ট্রও স্বীকার করে। পাকিস্তান বহু বছর ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে পারমাণবিক উত্তেজনার মধ্যেও পাকিস্তান সংযম দেখিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতে কাশ্মীর ইস্যু ছিল শীর্ষে, এর পাশাপাশি ভারতের পানি আগ্রাসন, সন্ত্রাসবাদ, বাণিজ্য এবং ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নেরও আলোচনা হয়।

প্রশ্ন: পাকিস্তান কি ইরান আক্রমণে কোনোভাবে সহায়তা করেছে?
উত্তর: না। এটা সম্পূর্ণ ভুয়া প্রচারণা। পাকিস্তান তার ভাইসুলভ প্রতিবেশী ইরানের পাশে রয়েছে। ইরান ন্যায়সঙ্গত অবস্থানে আছে এবং যুদ্ধ ওদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৫ হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতির দেশ ইরান দীর্ঘ ৮ বছর যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ করেও টিকে আছে। আজকের পরিস্থিতিতে ইরান সত্যিকারের বন্ধু ও শত্রুকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয় গুপ্তচরদের, যারা মোসাদের পক্ষে কাজ করেছে, বিচার করা হয়েছে এবং চাবাহার বন্দর থেকে ভারতীয় উপস্থিতি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: মুসলিম দেশগুলোর কি উচিৎ একসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানানো?
উত্তর: স্বল্পমেয়াদে মুসলিম দেশগুলো সঠিকভাবে ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করেছে এবং যুদ্ধ বন্ধের দাবি তুলেছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয় দরকার। বিগত কয়েক দশকের সব যুদ্ধই মুসলিম দেশগুলোর ওপরই হয়েছে; যেমন: বসনিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া এবং এখন ইরান। তাই গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জনে একটি সমন্বিত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাকে (ওআইসি) আরও কার্যকর করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন: এই সংঘাতের প্রভাবে জ্বালানি মূল্য ও অর্থনীতি কীভাবে প্রভাবিত হতে পারে?
উত্তর: পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় দেশই জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে ঘিরে সংঘাত হলে জ্বালানি মূল্য বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে পুরো অঞ্চল এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি মারাত্মক জ্বালানি সংকটে পড়বে, যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকেও প্রভাবিত করবে।

প্রশ্ন: যদি সংঘাত বাড়ে, চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা কী হতে পারে?
উত্তর: বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে যাচ্ছে। একক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব এখন বহু মেরুকেন্দ্রিকতার দিকে যাচ্ছে। চীন ও রাশিয়া একসঙ্গে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) এবং ব্রিকস গঠন করেছে। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের বিপুল সম্পদ এবং চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের (ওবোর) অর্থনৈতিক উদ্যোগ শিগগিরই একে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতিতে পরিণত করতে পারে। এই দুটি শক্তি একসঙ্গে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং একতরফা দখলনীতিকে প্রতিহত করতে পারে।

প্রশ্ন: যখন রাষ্ট্রীয় কূটনীতি ব্যর্থ হয়, তখন স্বাধীন মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কী হতে পারে?
উত্তর: নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কূটনীতি সর্বোত্তম শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। পাশাপাশি পেশাদার ও নৈতিকভাবে পরিচালিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশ্ব নাগরিক সমাজকে সঠিক তথ্য দিয়ে যুদ্ধবাদী দেশগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আরও কার্যকর, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক করে তোলা জরুরি যাতে তারা গৃহীত সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাব কার্যকর করতে পারে।

প্রশ্ন: ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে প্রক্সি যুদ্ধ বাড়ার ঝুঁকি আছে কি?
উত্তর: ভারত ইতিমধ্যে পাকিস্তানসহ আশপাশের দেশগুলোয় সন্ত্রাস ও বিদ্রোহ উসকে দিতে সম্পূর্ণভাবে জড়িত। ইসরায়েল পাকিস্তানকে ইরানের পর সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে এবং ভারতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সংঘাতে ইসরায়েল ভারতকে ড্রোনসহ সামরিক সহায়তা দিয়েছে। পাকিস্তান এই দুই যুদ্ধবাজ দেশের চক্রান্ত প্রতিহত করতে প্রস্তুত।

প্রশ্ন: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পাকিস্তান শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনি কী মনে করেন?
উত্তর: নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে হলে একটি নির্দিষ্ট যাচাই ও বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পাকিস্তান এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা কমাতে তার ভূমিকার প্রশংসা করে। তবে ইরানের ওপর সামরিক হামলা চালানো এবং গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতি তার সমর্থন, এই পুরস্কার পাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। শান্তি পুরস্কারের জন্য কেবল আংশিক সাফল্য নয়, প্রয়োজন বৃহৎ ও টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। যদি ট্রাম্প সত্যিই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন, ফিলিস্তিনে দুটি রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নিশ্চিত করেন, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতা আনতে পারেন, আর তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছান—তাহলে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য একজন প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।