
পেন্টাগনের মূল্যায়ন বলছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিমান হামলায় দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি। এই হামলা শুধুমাত্র দেশটির পারমাণবিক কার্যক্রম শুধুমাত্র কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে। এর আগে গত শনিবার অত্যাধুনিক বি-২ স্টিলথ বোমারু ব্যবহার করে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই হামলাকে অত্যন্ত সফল হামলা বলেও জানিয়েছিল। কিন্তু মাত্র তিনদিনের মাথায় পেন্টাগনের এই নতুন তথ্য জানাচ্ছে।
পেন্টাগনের গোয়েন্দা শাখা ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা ডিআইএ এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাদের প্রাথমিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ এই হামলায় ধ্বংস হয়নি। গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির সহযোগী সিবিএস নিউজকেও এ তথ্য জানিয়েছে। তবে হোয়াইট হাউস গোয়েন্দাদের এই মূল্যায়নকে ‘সম্পূর্ণ ভুল’ বলে আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হেয় করার চেষ্টা করার জন্যই এটি বলা হচ্ছে। এর আগে ট্রাম্প দাবি করেছেন, শনিবারে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে বিমান হামলায় ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো ‘সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস’ হয়েছে। পেন্টাগনের এই তথ্যের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট দিয়ে দাবি করেছেন, সিএনএন ও নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদন সত্যি নয়। তারা সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে সফল একটি অভিযানকে হেয় করার চেষ্টা করছে।
হামলার তিন দিনের মাথায় পেন্টাগনের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ ধ্বংস হয়নি। এতে বলা হচ্ছে, ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলো প্রায় অক্ষত রয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি মূলত স্থলভাগের অবকাঠামোতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এছাড়া ইরানের দুটি পারমাণবিক স্থাপনার প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু অবকাঠামো ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, ভূগর্ভস্থ মূল স্থাপনাগুলো অনেকটাই অক্ষত রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সূত্র মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে মাত্র, সর্বোচ্চ এইটুকুই।’ ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করার বিষয়টি নির্ভর করবে দেশটি খনন এবং মেরামত করতে কত সময় নেয় তার উপর। গোয়েন্দা সূত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসির সহযোগী সিবিএসকে নিশ্চিত করেছে যে, হামলার আগেই ইরান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদের কিছু অংশ স্থানান্তরিত করেছিল।
আইএইএ’র সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিতে সম্মতি ইরানি পার্লামেন্টের : ইরানি পার্লামেন্ট সদস্যরা ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার পরিকল্পনা’ অনুমোদন করেছেন। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো প্রতিনিধি ভোট দেননি। এর আগে, ইরানি পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি কমিশন একটি ‘খসড়া অনুমোদন করে যাতে সরকারকে আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে বলা হয়’। কমিশন সংস্থার প্রতিবেদনকে ইরানের ওপর হামলার অজুহাত বলে অভিহিত করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘নিরীক্ষণ ক্যামেরা স্থাপন, পরিদর্শন এবং সংস্থায় রিপোর্ট প্রদান’ এর মতো কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, যদি না ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ইসলামি পরামর্শদাতা পরিষদের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না, ‘আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি এবং একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।’
যুদ্ধবিরতিকে এখনো স্বীকৃতি দেননি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা : ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্টসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু এরপরেও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির দিক থেকে বিষয়টি স্বীকার করে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য আসেনি। দেশটির কোনো বিষয়ে তার বক্তব্যই শেষ কথা। সে কারণে দেশটির ভেতরে ও বাইরে থেকে এখন নজর দেয়া হচ্ছে যে তিনি এ বিষয়ে কখন কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা নিষ্পত্তিতে প্রস্তুত ইরান : সউদী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা নিষ্পত্তি করার জন্য কাজ করতে প্রস্তুত। পেজেশকিয়ানদের প্রেস সার্ভিস তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘আমরা আন্তর্জাতিক নিয়মের ভিত্তিতে আমাদের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যাগুলি নিষ্পত্তি করতে প্রস্তুত। এই প্রসঙ্গে, আমরা আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ দেশগুলির কোনও সহায়তা স্বাগত জানাই।’
ইরানের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিল রাশিয়া : ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলাই দেশটিকে জাতিসংঘের আনবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-এর সাথে সহযোগিতা স্থগিত করতে বাধ্য করেছে। ‘বিনা উসকানিতে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় নজিরবিহীন হামলার সরাসরি পরিণতি হলো এমন সিদ্ধান্ত,’ নিয়মিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলছিলেন তিনি। পেসকভ বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে আইএইএ-র সুনাম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্যই এ পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে’। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ক্ষতি সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী নানা মন্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু বলার মতো সময় এখনো আসেনি, ‘কেউ বাস্তব তথ্য উপাত্ত পেয়েছে বলে আমি মনে করি না’। মস্কো ইরানকে তার সহযোগী হিসেবে দেখে এবং সম্প্রতি ইরানের ওপর হামলার নিন্দা করেছে রাশিয়া। সূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমস।