Image description

যত গর্জে তত বর্ষে না। ‘অকালপক্ব’ মেঘের মতো ‘আকাশ কাঁপানো’ হাঁকডাক ছেড়ে দু-কদমেই দম ফুরিয়ে যায় যে ঘোড়ার- জাত বেদুইনরা তাকে ‘ভেড়া’ বলেই টিটকারি-মশকরা করে বলে শুনেছি! মার্কিন অক্সিজেনে হালুম-হুলুম গর্জন ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের রক্তখেকো দানব ইসরাইলের দশা এখন সেরকমই। হাওয়া তুলে নিজেই মুখথুবড়ে পড়েছে মরুর উত্তাল বালুঝড়ে। মাত্র ১২ দিনেই কুপোকাত। পায়ের দৌড় শেষ। নতজানু হয়ে ছুটে গিয়েছে ‘মুনিবের (যুক্তরাষ্ট্র) দরবারে’। ‘ত্রাহি ত্রাহি’ অবস্থা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ধামাকায়। পশ্চিমা তেজ-ধার করে শান্ত মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির বিষ ঢেলে নিরস্ত্র-নিরীহ জনপদের যমদূত হয়ে ওঠা ইসরাইলের এবার ভালো শিক্ষাই হয়েছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে গত ৬ দশকের দম্ভ। ১৯৬৭ সালে একা তিন আরব দেশের (মিসর, সিরিয়া, জর্ডান) সঙ্গে যুদ্ধজয়ী খলনায়ক এই প্রথম এমন লেজেগোবরে ধরাশায়ী হলো।

মধ্যপ্রাচ্যে আমিই রাজা-খামেনির ‘চোয়াল কাঁপা’ চপেটাঘাতে বেয়াড়া সেই ভূত এবার পালিয়েছে নেতানিয়াহুর। লম্ফঝম্প শেষ। এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ ধ্যানে বসেছে হোয়াইট হাউসের ‘বটতলায়’। প্রযুক্তির সূতিকাগার তেল আবিব, সর্বাধুনিক নৌশক্তিতে ঘেরা বাণিজ্যিক মেরুদণ্ড বন্দরনগরী হাইফা, বিশ্বসেরা গোয়েন্দার তকমাধারী মোসাদের সদর দপ্তর, নিশ্ছিদ্র সামরিক বেড়াজালে ঘেরা নেগেভ মরুভূমির গর্ব বীরসেবা শহরের নাক উঁচু আভিজাত্যও ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে ইরান। কয়েক দিনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাতেই এ কাহিল অবস্থা। গুদামের দরজা খুললে কি হতো সেই পরিণতিটাও এখন সহজেই অনুমেয়। 

কে হারল কে জিতল- সেই প্রশ্ন এখন নিতান্তই রসিকতা। খোলা চোখেই তার উত্তর দেখছে গোটা বিশ্ব। চলতি পথে সে জয়োল্লাস শুনেছে যুদ্ধের বারুদ হাওয়াও। বছরের পর বছর ধরে নানা অজুহাত-ওসিলায় পারস্য এই জাতিকে নিষেধাজ্ঞার লাগামে বেঁধে রাখলেও মনোবল দমাতে পারেনি একচুলও। তেহরানের বাসিন্দাদের মুখে শোনা, পূর্বপুরুষদের মতোই নিজেদের দুর্বার ‘মরু ঘোড়া’ মনে করেন ইরানিরা। ভয়ংকর বালুঝড়েও ক্ষিপ্রতা পড়ে না পায়ের। বীরের জাত। শেষপর্যন্ত ভয় পায় না। যুদ্ধ তাদের পৈতৃক অহংকার। এটাই তাদের ইতিহাস। ১৩ জুন থেকে শুরু হওয়া ১২ দিনের যুদ্ধে আরও একবার সেই ইতিহাসই লিখল ইরান। যুদ্ধের গোড়াতে ঠিক এই প্রতিধ্বনিই ছিল দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের। উত্তাল কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘শেষ ইতিহাস লিখবে ইরান।’ কী আশ্চর্য আত্মবিশ্বাস-অঙ্ক শেষে যোগফল সেটাই! শুধু ইসরাইল নয়, যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের তাবড় তাবড় সব পরাক্রমশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ঘেরা রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে কতটা সাহস থাকলে একটা নিঃসঙ্গ কণ্ঠ এতটা গর্জে উঠে তার সর্বশেষ প্রমাণও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ইরান। তিন পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলার ২৪ ঘণ্টাও পেরোতে দেয়নি। তার মধ্যেই প্রতিশোধ নিয়েছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য ঘাঁটিতে (ইরাক ও কাতার) হামলা চালিয়ে লিখল আরেক নতুন ইতিহাস। হামলাটি কিন্তু মোটেও জ্ঞানশূন্য ছিল না। ডানে-বামে, সামনে-পেছনের রণফাঁদ-প্রতিক্রিয়া-পরিণামের ষোলোআনা পরিণতি মাথায় রেখেই ‘তরবারির খাপ’ খুলেছিল ইরান। 

সবচেয়ে বড় যে প্রাপ্তিটা ইরানের ঘরে এসেছে তা হলো- ইসরাইলের মানচিত্রে ‘একখণ্ড গাজা’ এঁকে দেওয়া


১২ দিনের ওই রণ-মাণচিত্রে চোখ রাখলে দেখা যায়- ইসরাইলের জয়টা ছিল মাত্র দুই দিনের। সেটিও আবার পেছন থেকে। নোংরা কৌশলে অন্দরমহলের ‘ঘষেটি বেগম’ পথে। মীরজাফরদের লেজ ধরে এক বছর আগে থেকেই সেই ষড়যন্ত্রের জাল ফেলেছিল ইরানের চোরকুঠিতে। শুক্রবার মধ্যরাতের (১৩ জুন) ওতপাতা সেই বর্বর হামলাতেই যুদ্ধের শুরুর দিনেই সেনাপ্রধান, আইআরজিসি প্রধানসহ ৯ পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছিল ইসরাইল। সেটিও আবার ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যেই। আন্তর্জাতিক নীতি মানলে, সন্ধিকালীন হামলা কাপুরুষতা। রণনীতিতেও ঘৃণিত। অনেকটা সমঝোতার টেবিলে বসিয়ে পেছন থেকে ছুরি মারার মতো বিশ্বাসঘাতকতা। তার একদিন পরই ছিল ষষ্ঠ দফার (ওমানের রাজধানী মাস্কাটে) বৈঠক। আচমকা হামলায় খানিকটা ভড়কে গেলেও একদিন পরই পূর্ণমাত্রায় গর্জে ওঠে পারস্য সাম্রাজ্যের সিংহ। মার্কিন দুধ-কলাপুষ্ট প্রতিবেশী দেশগুলোর আকাশসীমা বন্ধ রাখার কারণে ইসরাইলের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে বিমান হামলা চালাতে পারেনি সত্যি- কিন্তু ছেড়ে কথা বলেনি। দুর্ধর্ষ সব ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তছনছ করে দিয়েছে ইসরাইলের আগ্রাসী দম্ভ। বহুমুখী ক্ষেপণাস্ত্রের ভেলকি তছনছ করে দিয়েছে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষার ‘বিশ্বখ্যাত আয়রন ডোম’ অহমিকা। কি বিধ্বংসী ক্যারিশমা ছিল ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর; খানিক উপরে উঠেই একটা মুখ থেকে ৭ কিলোমিটার উচ্চতায় উঠেই ছোট ছোট ১৫ থেকে ২০ মিউশনে ছড়িয়ে পড়ছিল ৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। কোনটা ছেড়ে কোনটা ঠেকাবে-খেই হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল পৃথিবীর প্রযুক্তি শিরোমণি ইসরাইলের সর্বাধুনিক আয়রন ডোম। নেতিয়ে পড়ে থাড-ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমও। শেষমেশ অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, সংঘাতের ৪-৫ দিনের মধ্যেই মার্কিন সংবাদ সংস্থা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে খবর বেরিয়ে পড়ল- আর মাত্র ১০-১২ দিনের ইন্টারসেপ্টর আছে ইসরাইলের কাছে; যার মোদ্দা কথা দাঁড়ায়- হাতেগোনা এই দিনগুলো পার হলেই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাবে ইসরাইলের। অর্থাৎ পরাজয় একেবারেই শিরদাঁড়ায়। এরপরই আমরা দেখলাম- ১৯ জুন ১৪ কার্গো সামরিক সরঞ্জাম পাঠাল জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র (৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে এমন মারণাস্ত্রবোঝাই এমন ৮০০ কার্গো-দানব পাঠিয়েছে দেশ দুটি)। কিন্তু তাতেও কি শেষ রক্ষা হলো? সেই তো যুদ্ধ বন্ধের জন্য ‘পায়ে পড়তে’ হলো যুক্তরাষ্ট্রের। মাঝখানের এ কয়েক দিনে সবচেয়ে বড় যে প্রাপ্তিটা ইরানের ঘরে এসেছে তা হলো- ইসরাইলের মানচিত্রে ‘একখণ্ড গাজা’ এঁকে দেওয়া। শুধু দুর্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ে বাঘের খোলস লাগালেই বাঘ হওয়া যায় না। সত্যিকারের সিংহের সামনে পড়লেই খাঁচায় ঢুকে যায় লেজ গুটিয়ে। সেটিই হয়েছে এবার ইসরাইলের। ইরানের ভয়ংকর থাবায় (ক্ষেপণাস্ত্র) তেল আবিব, হাইফা, বীরসেবায় অভিজাত ফ্যাশন দম্ভের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পশ্চিমা ধাঁচের আবাসিক এলাকাগুলোও গাজার মতোই ইট-পাথরের মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত খোদ পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোই বলছে, মুহুর্মুহু হামলায় এক-তৃতীয়াংশ ভবন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে ইসরাইলের। গাজার মতোই ধ্বংসস্তূপের মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে ইসরাইল। লজ্জায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ধামাকায় বিধ্বস্ত অবকাঠামোর ছবি প্রকাশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। আলজাজিরা দেখামাত্রই পুলিশে দেওয়ার ‘পরোয়ানা’ জারি করেছেন জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গাভি।