Image description

যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনবহুল অঙ্গরাজ্য নিউইয়র্কের রাজধানী শহর নিউইয়র্ক সিটির মেয়র হওয়ার পথে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন দেশটির ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম প্রার্থী জোহরান মামদানি। এই অগ্রযাত্রা অবশ্যাহত থাকলে সামনের নভেম্বরে চূড়ান্ত নির্বাচনে তার জয় প্রায় অবশ্যম্ভাবী।

৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানির জন্ম উগান্ডায়। তার বাবা মাহমুদ মামদানি ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন লেখক, তাত্ত্বিক, অধ্যাপক এবং উগান্ডার নাগরিক। তার মা মীরা নায়ার একজন সুপরিচিত ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক।

এর আগে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে নিউ ইয়র্কের কুইনস জেলার প্রার্থিতা করে জয় পেয়েছিলেন জোহরান। সে সময় তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা ও মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট সদস্য বার্নি স্যান্ডার্স এবং নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের এমপি আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্টেজ। এরা উভয়েই ডেমোক্রেটিক পার্টির বামপন্থি বলয়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। জোরান মামদানিও নিজেকে ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কে হবেন— তা নির্ধারণে দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন ছিল ছিল আজ বুধবার। এ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ২ জন— ডেমোক্রেটিক পার্টি নিউইয়র্ক শাখার জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিউইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র অ্যান্ড্রু কুয়োমো এবং জোহরান মামদানি।

ডেমোক্রেটিক পার্টি নিউইয়র্ক সিটি শাখার কর্মী-সমর্থকরা ছিলেন এই নির্বাচনের ভোটার। এর বাইরেও ‘ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটার’ পরিচয়ে যারা নিবন্ধন করেছিলেন, ভোট দিয়েছেন তারাও।

ভোটের পর ব্যালট গণনা শেষে দেখা যায়, জয়ী হয়েছেন জোহরান। কুয়োমোর সঙ্গে তার প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ৭ দশমিক ১ শতাংশ।

যৌন হয়রানির অভিযোগে গত চার বছর আগে নিউইয়র্কের মেয়রের পদ থেকে অব্যাহতি নেন কুয়োমো। আগামী নভেম্বর নিউইয়র্ক সিটির নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের রাজনীতিতে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের পর সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে।

তবে তা সত্ত্বেও মামদানিকে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি কুয়োমো। যদিও ভোটের আগে তিনি মামদানিকে ‘অনভিজ্ঞ’ বলে প্রচার করেছিলেন— কিন্তু ফলাফল প্রকাশের পর তিনিই প্রথম জোহরান মামদানিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

আর জয়ের পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মামদানি বলেছেন, “নিউইয়র্ক সিটির বাসিন্দাদের জয় হয়েছে আজ। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যদি আসন্ন মেয়র নির্বাচনে জয়ী হই—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো পলিসি এই শহরে চলবে না। নিউইয়র্ক সিটি হবে ডেমোক্রেটিক পার্টির মডেল।”

‘ডেমোক্রেটির পার্টির ভোটার’ পরিচয়ে বুধবারের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন ২৮ বছর বয়সী অভিনেতা ইগনাসিও ট্যামবান্টিং। মামদানিকেই ভোট দিয়েছেন— উল্লেখ করে রয়টার্সকে বলেন, “আমি মনে করি এখন আমাদের একজন তরুন, বর্ণময় এবং খানিকটা আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মেয়র প্রয়োজন।”

জাতীয় নির্বাচনেও সবচেয়ে জনপ্রিয় জোহরান

ঐতিহাসিকভাবে নিউইয়র্কে জনপ্রিয় দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। দলের মনোনয়ন পেলে স্বভাবতই শক্ত অবস্থানে থাকবেন উগান্ডায় জন্ম নেওয়া জোহরান মামদানি।

বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস আবারও পুনর্নিবাচনের জন্য ভোটে দাঁড়াবেন। তবে ডেমোক্র্যাট নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি লড়বেন। ট্রাম্পের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও একাধিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে অনেকাংশেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন এরিক।

রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন কার্টিস স্লিওয়া। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সুপরিচিত তিনি। ২০২১ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে এরিক অ্যাডামসের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন কার্টিস স্লিওয়া।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, ডেমোক্র্যাট ভোটাররা জোহরানের সম্ভাব্য বিজয়কে দলের জন্য 'নতুন যুগের সূচনা' হিসেবে দেখছেন।

লেহ জোহানসন নামের এক নারী ভোটার রয়টার্সকে বলেছেন, 'জোহরান মামদানি বেশি উদারপন্থি তবে প্রার্থী হিসেবে কুয়েমো আমার পছন্দ নয়। যার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে, তাকে আমি কখনোই ভোট দেব না।'

'ফিলিস্তিনপন্থি' জোহরান

জোহরানের পূর্বপুরুষ ভারত থেকে আসলেও তার জন্ম উগান্ডায়।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—১৯৯১ সালের ১৮ অক্টোবর ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার নাগরিক মাহমুদ মামদানি ও স্বনামধন্য ভারতীয়-মার্কিন চিত্রনির্মাতা মীরা নায়ারের ঘরে জন্ম নেন জোহরান কোয়ামে মামদানি। উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় তার জন্ম হয়।

বাবা মাহমুদ মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

মা মীরা নায়ারের নাম বিশ্বজুড়ে মানুষের মুখে মুখে। তিনি 'সালাম বম্বে' ও 'মনসুন ওয়েডিং'সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমার পরিচালক।

জোহরান মামদানির শৈশব কাটে কেপটাউনে। এরপর সাত বছর বয়সে যান নিউইয়র্কে। ব্রংক্স হাই স্কুল অব সায়েন্স ও ব্যাংক স্ট্রিট স্কুল অব চিলড্রেনে পড়ালেখা করেন। ২০১৪ সালে বাউডুইন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক নেন তিনি।

কলেজে পড়ার সময় তিনি 'জাস্টিস ফর প্যালেস্টাইন' সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

আরব নিউজের প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৭ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মেয়র প্রার্থী খাদের আল ইয়াতিমের নির্বাচনী প্রচারণায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন জোহরান মামদানি।

জোহরানের মতো খাদের জয়ী হলেও ইতিহাস সৃষ্টি হোত। তিনিই হতেন প্রথম আরব-ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মেয়র।

নিউইয়র্ক টাইমস জোহরান মামদানিকে 'ইসরায়েল সরকার ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের আচরণের' সরব সমালোচক হিসেবে অভিহিত করেছে। ২০২৩ সালে তিনি পশ্চিম তীর ও ফিলিস্তিনের অন্যান্য অংশে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিদের সঙ্গে নিউইয়র্কের যেসব দাতব্য সংগঠনের যোগসূত্র আছে, তাদের কর-রেয়াত সুবিধা বাতিলের বিল উত্থাপন করেন। সে সময় জোহরান বলেন, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে।

তিনি একাধিকবার গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছেন। বিডিএস (বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংশানস) উদ্যোগের সমর্থক। বিডিএস উদ্যোগের দাবি ছিল ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চলে কাজ করা সংগঠনগুলোকে বর্জন, সেগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জোহরান 'জায়নবাদ-বিরোধিতা' ও 'ইহুদিবিদ্বেষের' মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজনের বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে তার বক্তব্যে তুলে ধরছেন।

ইসরায়েলবিরোধী ও ফিলিস্তিনপন্থি বক্তব্যের কারণে বাইডেনপন্থি ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভরাডুবির পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে।

এর আগে, বৈশ্বিক শহর লন্ডনের প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন পাকিস্তান-বংশোদ্ভূত সাদিক খান। তিনি ২০১৬ সাল থেকে এই মহানগরীর মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। লেবার পার্টির এই সদস্য ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।